সারা দেশে সরকারি কাজে ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে হিন্দিকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটির উদ্যোগে ১১ মার্চ মৌলালি যুব কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হল ‘ভাষা বাঁচাও কনভেনশন’। মূল প্রস্তাব পাঠ করেন অধ্যাপিকা সোমা রায়। প্রস্তাবে বলা হয়– কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারি ভাষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের ১১তম রিপোর্ট পেশ করেছে। সংসদীয় কমিটির রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে– এত দিন পর্যন্ত হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা সরকারি কাজে ব্যবহৃত হত, তা বাতিল করে হিন্দিকেই একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হবে। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে হিন্দি শেখা আবশ্যিক করা হয়েছে। আইআইটি, আইআইএম সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিন্দিকে মাধ্যম হিসাবেও চালু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
শুধু এইটুকুই নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি সংক্রান্ত সকল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলিতে ইংরেজি আর আবশ্যিক রাখা হবে না এবং কেবলমাত্র হিন্দিতে প্রশ্নপত্র করার বিষয়টিও আলোচনাধীন। ভারতের মতো বহু ভাষাভাষী দেশে এইভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপর হিন্দি চাপিয়ে দিলে তা বিভেদ ও বিদ্বেষের জন্ম দেবে। ইতিপূর্বে জোর করে চাপানোর চেষ্টার সময়ে আমরা যা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, আবার তার পুনরাবৃত্তি হবে। চাকরির ক্ষেত্রে নানা কৌশলে হিন্দিকে এমনভাবে আবশ্যিক করা হচ্ছে যে হিন্দি না জানলে বর্তমানে সংকুচিত চাকরির বাজারে কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরে চাকরি পাওয়া যাবে না। যাঁরা ইতিমধ্যে চাকরি করছেন তাঁদেরও হিন্দিতে কাজ না করলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে।
কনভেনশনের আমন্ত্রিত বক্তা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ লিঙ্গুইস্টিকসের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান এবং বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মহীদাস ভট্টাচার্য তাঁর আলোচনায় বলেন, জোর করে হিন্দি চাপানোর এই প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবার পরিষ্কার ভাবে বলেছেন, হিন্দি দিয়ে ইংরেজিকে নির্বাসিত করা হবে। অথচ ইংরেজিকে নির্বাসিত করলে হিন্দি সহ ভারতীয় ভাষাগুলির বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অরুণ ঘোষ ভাষার বিকাশ সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর বক্তব্য রাখেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমির বিজ্ঞানী অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় বলেন, ভাষা শুধু একটি বিষয় নয়, ভাষা চিন্তার বাহন। ভাষা অনুন্নত থাকলে সেই ভাষায় উন্নত চিন্তা করা সম্ভব নয়। ইংরেজির নির্বাসন হলে আধুনিক আবিষ্কারগুলি জানা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ভারত পিছিয়ে পড়বে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত ক্ষেত্রে ভারতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য নানা বৈচিত্র্যকে ধবংস করে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বদলে চূড়ান্ত কেন্দ্রীয়করণের যে নীতি ‘এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা’ যে স্লোগান তারা তুলছে তাকেই রূপ দেওয়ার জন্য জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দিতে চাইছে। এর ফলে ফ্যাসিবাদকেই তারা শক্তিশালী করবে। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ভাষা বিষয়ক উত্থাপিত প্রস্তাব গৃহীত হয়। অপর একটি প্রস্তাবে এই রাজ্যে ৮২০৭টি স্কুলকে ছাত্র সংখ্যার স্বল্পতার অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়ার তীব্র নিন্দা করা হয়।
কনভেনশনের সভাপতি অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটির সভাপতি এবং প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতিতে মাতৃভাষার বিকাশ ও সংরক্ষণ সম্পর্কে কিছু ভাল কথা থাকলেও তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কোনও অর্থই বরাদ্দ করেনি। বরং শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই মাল্টিলিঙ্গুয়ালিজম এর কথা বলা হলেও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে শিক্ষা দেওয়ার সুপারিশ করেছে। যেখানে বহু ভাষা কেন, কোনও কিছুই শিক্ষা দেওয়ার মতো কোনও রকম পরিবেশ নেই। তিনি জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।