বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার জিএসটি–র বর্ষপূর্তি পালন করল৷ মন্ত্রীসভার সদস্যরা একে ঐতিহাসিক বলে আখ্যায়িত করলেন৷ কিন্তু কেন তা ঐতিহাসিক? সরকার কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি৷ ২০১৭–র ১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী মহা সমারোহে চালু করেছিলেন জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স)৷ সরকার বলেছিল, পণ্য বিক্রি ও পরিষেবার জন্য কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর, ভ্যাট, পরিষেবা কর ইত্যাদি নানা নামের করের বদলে শুধুমাত্র একটি কর জিএসটি দিতে হবে৷ বলেছিল, জিএসটি চালু হলে জিনিসপত্রের দাম কমবে৷ ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা হবে, ফলে বাজার সংকট কাটবে৷ জিএসটি–র বর্ষপূর্তিতে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা কী? জিনিসপত্রের দাম কমেছে? ছোট ব্যবসা, ছোট কারখানার কিছু সুবিধা হল, না লাটে ওঠার জোগাড়?
বাস্তব হল জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে৷ ওষুধ, দুধ, আটা, ভোজ্য তেল, খাদ্যশস্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য জিনিসের উপর জিএসটি ধার্য হওয়ায় দাম বেড়েছে অনেক৷ ব্যাঙ্ক বা কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পরিষেবা নিতে গেলেই গ্রাহককে জিএসটি বাবদ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে৷ বেড়েছে এটিএম ব্যবহারের খরচ, ক্ষুদ্র ঋণ সহ সব ধরনের ব্যাঙ্কঋণের প্রসেসিং চার্জ৷ জীবনবিমার প্রিমিয়াম বেড়েছে৷ পরিবহণে বহু ক্ষেত্রে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত জিএসটি দিতে হচ্ছে৷ ফলে পণ্য ও যাত্রী পরিবহণের খরচ বাড়ছে৷
জিএসটি রিটার্নের গোলমেলে জটিলতার সুযোগে যে হাওয়ালা লেনদেন বেড়েছে তা বিশেষজ্ঞরাই বলছেন৷ ফলে কালো টাকার কারবার বেড়ে উঠেছে৷ কিছু অর্থনীতিবিদ সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের জমা টাকা বিপুল হারে বেড়ে ওঠার সাথে জিএসটি রিটার্নের ফাঁকফোকরের সম্পর্ক আছে এমনও বলছেন৷
কেন্দ্রীয় সরকারের অবশ্য আয় বেড়েছে বলে ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী পীযূষ গয়াল বলেছেন৷ কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক পরিসংখ্যান দিয়ে বলছে, জিএসটি চালু হওয়ায় রাজস্ব বাবদ আয় কমেছে রাজ্য সরকারগুলির৷ এই ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা করতে সাধারণ মানুষের পরিষেবা খাতে সরকারি ব্যয় কমছে৷ আবার এই অজুহাতে শিক্ষা–স্বাস্থ্য থেকে সড়ক নির্মাণের খরচ এমনকী পানীয় জলের দায়িত্বও সরকার তুলে দিচ্ছে বেসরকারি মালিকদের হাতে? তার খরচ জোগাচ্ছে সাধারণ মানুষই৷ অর্থাৎ ঘুরিয়ে বাড়তি বোঝা মানুষের ঘাড়ে চাপল৷
অন্য দিকে খুচরো বিক্রেতা, ছোট ব্যবসায়ী, ছোট কারখানার মালিক, ছোট কন্ট্রাক্টর যাদের জিএসটি–র আওতাতে থাকার কথাই ছিল না, তারা জিএসটি রেজিস্ট্রেশন না করলে বড় ব্যবসাদার, বড় কারখানা তাদের সাথে চুক্তি বা লেনদেন করছে না৷ ফলে তাদের জিএসটি বাবদ মোটা অর্থ আগাম জমা করতে হচ্ছে৷ এমনিতেই তাদের হাতে পুঁজি কম, তার উপর একটা মোটা টাকা এভাবে দীর্ঘদিন আটকে থাকায় তারা বাজার থেকে সরে যতে বাধ্য হচ্ছে৷ তার জায়গা নিচ্ছে বড় পুঁজি৷ খুচরো ব্যবসা থেকে শুরু করে ছোটখাট কারিগরের কাজেও এই বড় পুঁজির থাবা বসছে৷ ঠিক এর আগে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নোট বাতিলের জন্য মার খেয়েছিলেন, এরপর জিএসটির ধাক্কায় তাদের নাভিশ্বাস উঠছে, তাদের সঙ্গে যুক্ত লক্ষ লক্ষ কর্মচারী রুটি–রুজি হারাচ্ছেন৷
সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগাতে কংগ্রেস জিএসটি নিয়ে বিজেপি সরকারের বিরোধিতা করলেও তারা নিজেদের আমলে জিএসটি চালুর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল৷ তখন বিরোধী বিজেপির বাধায় তা চালু করতে পারেনি৷ সেদিন বিজেপির বিরোধিতাও কোনও নীতিগত কারণে ছিল না, কংগ্রেসের এখনকার বিরোধিতাও যেমন নীতিগত কারণে নয়৷ এরা সকলেই একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে কাজ করে৷ সব ক্ষেত্রেই এই দলগুলি যখন ক্ষমতায় থাকে না সাধারণ মানুষের বন্ধু সেজে খুব বিরোধিতার খেলা করে, ভোট পেরোলে ক্ষমতায় যেতে পারলেই তাদের স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে৷ তাই পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসও প্রথম দিকে জিএসটি–র বিরোধিতা করলেও পরে তা মেনে নিয়েছে৷
সব মিলিয়ে বলা যায়, জিএসটি–র সুফল যদি মিলে থাকে, তবে তা মিলেছে শিল্পপতিদেরই৷
(৭০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা ২০ জুলাই, ২০১৮)