রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে, দেশে এখন জাল নোটের রমরমা। গত এক বছরে দেশে মোট জাল নোট মিলেছে ২,৩০,৯৭১টি। তার আগের বছরে ছিল ২,০৮,৬২৫টি। শুধু পাঁচশো আর দু’হাজার নয়, দুশো থেকে দশ–সব নোটই জাল হচ্ছে।
অথচ নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, এটা কালো টাকা এবং জাল নোটের কারবার সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। ২০১৬ সালে ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় আচমকা ঘোষণা করে রাত ১২টা থেকে ১০০০ ও ৫০০ টাকার সরকারি নোট বাতিল করে তিনি বলেছিলেন, এখন থেকে দেশের অভ্যন্তরে চলমান সমস্ত কালো টাকার কারবার বন্ধ হয়ে গেল। কারণ ওই দুটি নোট যার কাছে যত পরিমাণ আছে তা অবিলম্বে ব্যাঙ্কে জমা দিতে হবে। কালো টাকা অর্থাৎ বেহিসাবি টাকা কেউ ব্যাঙ্কে জমা দিতে পারবে না। এক ধাক্কায় তা খারিজ হয়ে যাবে। এর ফলে বাজারে চলমান জাল নোটও ধরা পড়ে যাবে। দেশে এখন থেকে কেবল সাদা টাকাই বহাল থাকবে। এর ফলে আর কেউ কর ফাঁকি দিতে পারবে না। আরও বলা হয়েছিল, এর ফলে কালো টাকার মদতে চলে আসা দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হবে। সাথে সাথে তিনি এও ঘোষণা করেছিলেন, বিদেশে বিপুল পরিমাণ লুকিয়ে রাখা কালো টাকা উদ্ধার করে এনে দেশের প্রতিটি পরিবারের হাতে ১৫ লক্ষ টাকা করে পৌঁছে দেবেন। এই পদক্ষেপের ফলে দেশের এবং দেশের বাইরের কালো টাকার কারবারিদের জায়গা হবে জেল। উনি বলেছিলেন মাত্র ৫০ দিনের মধ্যে এর সুফল প্রমাণিত হবে, না হলে প্রকাশ্য রাস্তায় দেশের জনগণ তাঁকে যা শাস্তি দেবেন তা মাথা পেতে নেবেন তিনি।
তারপর ৬ বছর কেটে গেছে। কালো টাকা উদ্ধার হয়নি। একজন কালোটাকার কারবারিও গ্রেফতার হয়নি। অবশেষে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সরকারি তথ্য দেখাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেওয়া ওই সব প্রতিশ্রুতি ছিল স্রেফ মিথ্যা। কারণ বাজারে জাল টাকা রমরমিয়ে চলছে এবং তা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা হলে নোট বাতিল করে লাভ কী হল?
সে সময়েই খবরে প্রকাশিত হয়েছিল, নতুন নোট ছাপাতে ও ব্যাঙ্কগুলিতে তা পৌঁছে দিতে সরকারি কোষাগার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। তা ছাড়া, বিভিন্ন ব্যাঙ্কে যে বিপুল টাকা জমা পড়েছিল তার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে সেই সব ব্যাঙ্কগুলিকে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা সুদ দিতে হয়েছিল। তাহলে এত খরচ ও হম্বিতম্বিতে লাভটা কী হল? নোট বাতিলের সময় আরএসএস-বিজেপি বাহিনী প্রচার তুলেছিল, পাকিস্তান ভারতের বাজারে জাল নোট ছেড়ে দেবে জানতে পেরে আগেই মাস্টারস্ট্রোক দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাতারাতি পাঁচশো ও হাজার টাকার প্রচলিত নোট বাতিল করে দিলেন। আদতে এর দ্বারা তিনি গোটা দেশের সাধারণ জনতাকে টাকা বদলের লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, একবার লাইনে দাঁড়ালে সারা জীবনে আর লাইনে দাঁড়াতে হবে না। কমবে দুর্নীতি। এগোবে দেশ। আরও বলেছিলেন, সীমান্তে দাঁড়িয়ে সেনারা দেশের জন্য প্রাণ দিচ্ছে, আপনারাও কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়তে ক’দিন লাইনে দাঁড়িয়ে একটু কষ্ট করুন। এই ‘একটু কষ্ট’ করতে গিয়ে মাস দেড়েকের মধ্যে শতাধিক মানুষের অকালমৃত্যু ঘটেছিল। সেদিন সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই জমা পড়া টাকার পরিমাণের হিসাব দেওয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ওই দু’রকম নোটের ৯৭ শতাংশই ব্যাঙ্কে জমা পড়েছিল। পুরোটাই পড়ত, কিন্তু আকস্মিক ভাবে জমা নেওয়া বন্ধ করে সরকার নিজের মুখ রক্ষার চেষ্টা করেছিল। কোনও কালো টাকা যদি উদ্ধার না হয়ে থাকে, জাল নোটের সমস্যা যদি না মিটে থাকে তা হলে এই অকালমৃত্যুগুলি তো ঘটেছিল অকারণে। আর তার দায় তো পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় সরকারের। এই দায় সরকার এড়াতে পারে?
নোট-বাতিলের আর একটি কারণ হিসাবে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, এর ফলে নগদের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। দেশের বাজারে নগদের লেনদেন ও চাহিদাও কমবে। তথ্য বলছে, পরের বছরগুলিতে নগদ লেনদেন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন, আদতে সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রায় সমস্ত নগদ লেনদেনকে নজরদারির আওতায় আনা এবং সেই সঙ্গে শাসকদল ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিরা ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়ার ফলে রুগ্ন হয়ে পড়া ব্যাঙ্কগুলিতে মূলধনের পরিমাণ বাড়ানো। তার জন্যই কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদকে ছল হিসাবে নিতে হয়েছে। সুপরিকল্পিত ভাবেই এমন একটা প্রচার তোলা হয়েছিল যেটাতে মানুষ ভেসে যাবে। বাস্তবে বাজারে নোটের জোগান কমাতে হলে যেভাবেই হোক প্রচলিত নোট তুলে নিতে হবে। এটা করতে গিয়ে যদি ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের বলা হয়, টাকা দেওয়া সম্ভব নয় কারণ টাকা আসছে না, তা হলে তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। তাই, এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আগে থেকে মানসিক প্রস্তুতি গড়ে দেওয়া দরকার। তা করতে কালো টাকা ও তার কারবারিদের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক ঘৃণা এবং তাদের দেশপ্রেমকে হাতিয়ার করেছিল মোদি সরকার।
মানুষ জানতেও পারল না যে, পুরোটাই আগাগোড়া ছিল একটা পরিকল্পিত ধাপ্পা। এই নোট বাতিলের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে জমা ক্ষোভ চাপা দিতে ২০১৭-র উত্তরপ্রদেশ ভোটের আগে একটা চমক দেওয়া। এছাড়া নোট বাতিলের বিশেষ গোপন লক্ষ্য ছিল ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানো। কারণ, এতে সরকারের এবং পুঁজিপতিদের অনেক সুবিধা। তার মধ্যে অন্যতম হল, যন্ত্রনির্ভরতা বাড়িয়ে বহু কর্মী তারা ছাঁটাই করতে পারবে, সরকারি স্থায়ী পদ বিলোপ করতে পারবে। জনগণের এতে কী সুবিধা? কেউ কেউ মনে করছেন, ভালোই তো, লম্বা লাইনে না দাঁড়িয়ে ইলেকট্রিক বিল ইত্যাদি দিতে পারছি, এমনকি একটা সিঙাড়া খেয়েও অনলাইন পেমেন্ট করতে পারছি। কিন্তু তারা সমস্যার মূল ধরতে পারেননি। ডিজিটাল লেনদেনের নামে আদতে সরকার সকলের উপর নিখুঁত নজরদারি বহাল করতে চাইছে। এটা পুঁজিপতি শ্রেণির বিশেষ চাহিদা। আবার সরকারি কর্তৃপক্ষও চাইলে যে কোনও ব্যক্তির আয়-ব্যয়ের হিসাব জানতে পারে। জানতে পারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগত তথ্যও। ফলে গ্রাহকের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এর ফলে যে সাইবার প্রতারণাও বাড়ছে তা আজ অজানা তথ্য নয়।
সাধারণ মানুষ কি ব্যাঙ্কে টাকা রেখে চোরের হাত থেকে বাঁচতে পারছেন? সরকার সে ব্যাপারে কি উদ্যোগী? আদৌ নয়। ডিজিটাল লেনদেনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষই। বছর পাঁচেক আগে ন্যাশনাল ক্রিটিক্যাল ইনফর্মেশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোটেকশন সেন্টারের তথ্য বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৬-র মধ্যে ইন্টারনেটে আর্থিক হ্যাকিংয়ের সংখ্যা ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যে হ্যাকিংয়ের ঘটনার মধ্যে ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই নিশানায় ছিল স্মার্টফোন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ভারতে ১১৫৯২টি হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছে, যা ২০০৫ সালের তুলনায় ২৬ গুণ বেশি। এখন তার মাত্রা আরও তীব্র। তা হলে, কী দাঁড়াচ্ছে? কালো টাকা বা জাল নোট ইত্যাদি কোনও ব্যাপারে সরকারের কোনও উদ্বেগ নেই। এসবই লোক ঠকানোর বাহানা। আদতে সে চায় মালিক শ্রেণির চাহিদা মিটিয়ে চলতে। সরকারের সমস্ত কার্যকলাপ তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।