ঠিক একশো বছর আগে ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগে বর্বর গণহত্যা চালিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের সেনাবাহিনী৷ সরকারি মতে মৃত ৩৭৯ হলেও বাস্তবে নিহতের সংখ্যা ছিল হাজারের বেশি৷ আহত হয়েছিলেন ২ হাজারেরও বেশি মানুষ৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা৷ যাতে ক্রমবর্ধমান স্বাধীনতার আকাঙক্ষা দেশব্যাপী অভ্যুত্থান রূপে ফেটে পড়তে না পারে৷ ব্রিটিশের উদ্দেশ্য সফল হয়নি, সাময়িকভাবে কিছু মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত আতঙ্কে আন্দোলন থেমে যায়নি৷ সেদিন অভূতপূর্ব সেন্সরশিপ জারি করে সংবাদপত্রে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবরটুকুও বেরোতে দেয়নি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকার৷ মুখে মুখে ছড়িয়েছে খবর৷ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন কিছু জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক এই সংবাদকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেন৷ দেশের মানুষ এই বর্বরতার খবরজানতে পারে বহু দেরিতে৷
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন সবে শেষ হয়েছে, হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য যারা ব্রিটিশের হয়ে ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যে লড়তে গিয়েছিল তাদের অনেকে প্রাণ হারিয়েছে৷ ঘরে ফিরেছে যারা, তাদের মধ্যে অসংখ্য আহত, চিরতরে পঙ্গু৷ তাদের অন্নসংস্থানের সামর্থ্যটুকুও নেই৷ দেশের মধ্যে নিদারুণ অভাব, খাদ্যের আকাল, গ্রামে শহরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় জমিদার ও কলকারখানা মালিকদের অত্যাচার আরও বেড়েছে৷ এই পরিস্থিতিতে বাংলা এবং পাঞ্জাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড তখন বারবার ফেটে পড়ছে৷ গদর পার্টির নেতৃত্বে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডায় প্রবাসী ভারতীয় বিশেষত পাঞ্জাবীদের মধ্যে আন্দোলন দানা বাঁধছে৷ ১৯১৫ সালে রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে ভারতের নানা স্থানে সেনা বিদ্রোহের চেষ্টার অভিযোগে কর্তার সিং সারাভা, বিষ্ণু গণেশ পিংলে সহ সাত বিপ্লবীর ফাঁসি হয়৷ ব্রিটিশ সরকার আশঙ্কা করছিল পাঞ্জাবের গদর পার্টি এবং বাংলা, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যের অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে সোভিয়েত বিপ্লবীদের যোগাযোগ ঘটছে৷ ইতিমধ্যে ১৯১৭–র সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যতটুকু সংবাদ ভারতে পৌঁছেছিল তার প্রভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তীব্রতা আসে৷ ভারতের শ্রমিক আন্দোলনও জোর পায়৷ ১৯১৮–১৯ সালে বোম্বের শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা এই ক্ষেত্রে আরও মাত্রা যোগ করে৷ এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয় এই ভেবে যে, সোভিয়েত বিপ্লবের প্রভাবে ভারতের বিরাট অংশ সহ আফগানিস্তানে তীব্র জনজাগরণ ঘটে যেতে পারে৷ এই অগ্ণিগর্ভ পরিস্থিতি দেখে বিপ্লবের বিস্ফোরণ ঘটার ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিল তারা৷
তাই ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালে বিচারপতি সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে নিয়োগ করেছিল৷ তাদের উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক আন্দোলন এবং জনগণের মধ্যে বেড়ে ওঠা সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের প্রভাবকে দমন করার পথ খুঁজে বার করা৷ রাওলাট কমিটি ১৯১৫–র ভারত রক্ষা আইনকে আরও কঠোর এবং আক্রমণাত্মক করার সুপারিশ করে৷ এর মাধ্যমে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, বাকস্বাধীনতা হরণ, রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া, বিনা বিচারে যে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে যত দিন খুশি আটক রাখার অধিকার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া সহ নানা ধরনের দমনমূলক ব্যবস্থা নেয় সরকার৷
১৯১৮–১৯ সালে পাঞ্জাবে অনাবৃষ্টিতে চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়৷ বিভিন্ন অঞ্চলে প্লেগ মহামারীর আকার নেয়, চার–পাঁচ মাসে ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা যায় অসংখ্য মানুষ৷ লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ার পাঞ্জাবে লোকমান্য তিলক ও বিপিনচন্দ্র পালের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেন৷ নিউ ইন্ডিয়া, অমৃতবাজার পত্রিকা, ইন্ডিপেন্ডেন্ট সহ অনেক সংবাদপত্র পাঞ্জাবে বন্ধ করে দেন৷ প্রতিবাদে আগুনের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল সত্যাগ্রহ আন্দোলনে৷ ৩০ মার্চ, ১৯১৯ অমৃতসরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হল৷ ৬ এপ্রিল দেশের হিন্দু ও মুসলমান সহ সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ একযোগে সারা ভারতজুড়ে হরতাল পালন করে৷ শ্রমিক কৃষক সহ সাধারণ মানুষ তীব্র আবেগ ও উন্মাদনা নিয়ে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে৷ হরতালে পাঞ্জাবের জনজীবন অচল হয়ে পড়ে৷ ১০ এপ্রিল টেলিগ্রাফ পোস্ট, রেললাইন উপড়ে দিয়ে, রাস্তা কেটে মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে থাকে৷ অমৃতসরে ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগের সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন বেশ কয়েক হাজার নিরস্ত্র নরনারী৷ শিখ নববর্ষ ও বৈশাখী মেলার আনন্দের সাথে মিলে গিয়েছিল রাওলাট কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ৷ তাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা এতটাই আতঙ্কিত হয় যে, অমৃতসরের মিলিটারি কম্যান্ডার রেজিন্যাল্ড ডায়ার মেশিনগান, রাইফেল সহ সামরিক বাহিনী নিয়ে জমায়েত স্থলে পৌঁছে কোনও হুঁশিয়ারি না দিয়েই চারিদিক ঘেরা পার্কের সংকীর্ণ পথগুলি আটকে বাহিনীকে গুলি চালাতে আদেশ দেন৷ হাজার হাজার মানুষ লুটিয়ে পড়েন গুলির আঘাতে৷ পার্কের মধ্যেকার একটি কুয়োতে লাফিয়ে পড়ে অনেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন৷ সেখান থেকে পরে শতাধিক মৃতদেহ উদ্ধার হয়৷ পরে কর্নেল ডায়ার তদন্ত কমিশনের সামনে বলেছিলেন, দেশ জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য৷ বলশেভিক বিপ্লবের ভয়েই যে এমন উন্মত্ত আক্রমণ, তাও বিচারের সময় তিনি বলেছিলেন৷ ডায়ার নির্বিকার চিত্তে জানিয়েছিলেন, মেশিনগানগুলি গাড়ি থেকে নামিয়ে ভিতরে নিয়ে যেতে পারেননি বলে কম লোকের মৃত্যু হয়েছে৷ ‘আমি আরও চেয়েছিলাম’৷
সেদিন দেশের মানুষ চাইছিল এর তীব্র প্রতিবাদ৷ কিন্তু আশ্চর্যজনক হল, এই বর্বরতার বিরুদ্ধে গান্ধীজি সহ গান্ধীবাদী কংগ্রেস নেতৃত্ব জোরদার প্রতিবাদ করলেন না৷ রবীন্দ্রনাথের কাছে যখন এই সংবাদ পৌঁছাল, কবি তখন অসুস্থ৷ তার মধ্যেও তিনি দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজের মাধ্যমে গান্ধীজিকে অনুরোধ জানালেন প্রতিবাদ সভা করার৷ গান্ধীজি রাজি হলেন না৷ রবীন্দ্রনাথ বাংলার নেতাদের কাছেও গিয়েছিলেন প্রতিবাদের আশায়৷ কিন্তু সাড়া না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, ব্রিটিশের দেওয়া ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করে ভাইসরয়কে চিঠি লেখার৷ সেই চিঠি বহু জাতীয়তাবাদী মানুষকে সেদিন প্রেরণা দিয়েছিল৷ সদ্য গঠিত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে উত্তর ভারতের বলশেভিক ব্যুরোর প্রধান এম অ্যালেক্সেই অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদককে চিঠিতে লিখেছিলেন, লেনিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবরণ থেকে জালিয়ানওয়ালাবাগের বর্বর হত্যাকাণ্ডের কথা জেনেছেন৷ তিনি আমায় নির্দেশ দিয়েছেন, ভারতীয় জনগণের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে একথা জানাতে যে, এই ন্যায়সঙ্গত লড়াইয়ে সোভিয়েত সরকার ভারতীয় জনগণের পাশে আছে৷
পরবর্তীকালের বিপ্লবীদের কাছেও জালিয়ানওয়ালাবাগ হয়ে উঠেছিল প্রেরণার উৎস৷ বিপ্লবী ভগৎ সিং ছিলেন তখন নিতান্ত কিশোর৷ তিনি খবর শুনে ছুটে গিয়েছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগে৷ শহিদের রক্তমাখা পবিত্র মাটি নিয়ে এসেছিলেন, তা মেখেছিলেন কপালে, শপথ নিয়েছিলেন, এর প্রতিশোধ একদিন নিতেই হবে৷
ঠিক এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছিল ‘পাঞ্জাব হিন্দু সভা’র কাছ থেকে৷ প্রসঙ্গত, এই পাঞ্জাব হিন্দু সভার পথ বেয়েই ১৯২১ সালে সর্বভারতীয় স্তরে হিন্দু মহাসভা নামক সংগঠন তৈরি হয়৷ যার ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি আজকের বিজেপির৷ তারা রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহের বিরোধিতা করেছিল শুধু তাই নয়– জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার পর ‘সত্যাগ্রহের নামে এই অরাজকতার নিন্দা’ করে তারা ব্রিটিশের প্রতি ‘গভীর আনুগত্যের’ শপথ নিয়েছিল ( কে এল তুতেজা–‘দ্য পাঞ্জাব হিন্দু মহাসভা অ্যান্ড কমিউনাল পলিটিক্স, ১৯০৬–১৯২৩’৷ ফ্রন্ট লাইন ১৪ মার্চ ২০০৩)৷ ব্রিটিশ রাজের ভারত আগমণকে প্রণতি জানিয়ে তারা বলেছিল, ‘ঈশ্বরের অসীম কৃপায় আর্যজাতির গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখা যা সুদূর অতীতে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, আবার এক হতে পেরেছে৷ এক জাতি অপরটিকে রাজনৈতিক পথনির্দেশ এবং সুরক্ষা প্রদান করছে৷ যে সাম্রাজ্যের সূর্য কখনও অস্ত যায় না, তার প্রজা হিসাবে আমরা গর্বিত এবং এই প্রাপ্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রমাণ করতে আমরা সর্বদাই সচেষ্ট৷’ (ওই)
অন্য দিকে, জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিশোধ নিতে পাঞ্জাবের প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ারকে লন্ডনে গুলি করে হত্যা করেছিলেন যিনি, সেই উধম সিং, তাঁর বিচারের সময় নিজের নাম বলেছিলেন, ‘মহম্মদ সিং আজাদ’৷ তিনি বলেন, ভারতের সকল মানুষের প্রতিনিধি আমি৷ সব ধর্ম–বর্ণ মিলে আমরা লড়ছি৷ এ কথা হিন্দু মহাসভার বক্তব্যের ঠিক বিপরীত৷ ভারতের অগণিত যুবক যখন বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে স্বাধীনতার বেদিমূলে, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে হিন্দুত্ববাদের চ্যাম্পিয়ান আরএসএস বারবার ব্রিটিশের আনুগত্য ভিক্ষা করেছে৷ তাদের মাথা গোলওয়ালকার ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনকে বলেছিলেন, প্রতিক্রিয়াশীল৷ আরএসএস প্রধান হেডগেওয়ার থেকে শুরু করে হিন্দু মহাসভা ও জনসংঘের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত ১৯৪২–এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন৷ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যখন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন এই সংগঠনগুলি চেয়েছে ব্রিটিশের সাথে ‘নিবিড় সহযোগিতা’৷
আজ জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই আত্মত্যাগের শতবর্ষ পালন নিছক একটি অনুষ্ঠান নয়৷ দেখা গেল ১০০ বছর পরেও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের উত্তরসূরি সে দেশের সরকার ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করল৷ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে কেবলমাত্র একটি শুকনো দুঃখপ্রকাশ করে দায় সেরেছেন৷ পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদের চোখে গণতন্ত্র, মানুষের জীবনের দাম এর থেকে বেশি হতে পারে না৷ রাষ্ট্রীয় স্বার্থের নামে নিপীড়ন তাদের চোখে অমানবিক লাগে না৷
কিন্তু ভারতে? সেদিন ডায়ারকে যারা সমর্থন করেছিল, আজ সেই হিন্দু মহাসভার ধারাবাহিকতায় সৃষ্ট বিজেপি দেশভক্তির চ্যাম্পিয়ান সেজেছে৷ কোথায় এ জন্য দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইবে,তা নয়, বরং তারাই দেশভক্তির ঠিকাদার অত্যাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই দেশপ্রেমিক মানুষের কর্তব্য৷ রাষ্ট্রের উৎপত্তির পর থেকে বারবার মানুষ তা করেওছে৷ আজকের হিন্দু মহাসভার উত্তরসূরি বিজেপি তা ভুলিয়ে দিতে চায়৷ আজ তারা মানুষকে বোঝাচ্ছে দেশ মানে দেশের মানুষ নয়৷ মিলিটারি আর রাষ্ট্রের দমনপীড়নের যন্ত্রই দেশ৷ তারা সাম্রাজ্যবাদের দালালি সেদিনও করেছে, আজও করে চলেছে৷
জালিয়ানওয়ালাবাগে হাজারো মানুষের আত্মত্যাগ তাই শেখায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই মনুষ্যত্ব৷ জালিয়ানওয়ালাবাগ অত্যাচারীর কাছে মাথা নত করতে লজ্জা দেয়৷ শতবর্ষে এই শিক্ষাকেই আজ চর্চা করতে হবে৷