জার্মানিতে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক কারখানা

জার্মানিতে ফক্সভাগেন কারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট

(অর্থনৈতিক সংকটে জেরবার গোটা পুঁজিবাদী বিশ্ব। জার্মানির মতো উন্নত পুঁজিবাদী দেশও ব্যতিক্রম নয়। এ বিষয়ে সে দেশের মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী দল এমএলপিডি-র একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হল।)

বাজার সংকট সামাল দিতে জার্মানির বিশ্ববিখ্যাত মোটরগাড়ি শিল্প ‘ভক্সওয়াগন’ তার তিনটে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার কর্মচ্যুত শ্রমিক সপরিবারে পথে বসবে। ইতিমধ্যেই চলছে লে-অফের বন্যা এবং দশ শতাংশ থেকে আঠেরো শতাংশ পর্যন্ত বেতন হ্রাস। মালিকপক্ষ অবশ্য অজুহাত দিচ্ছে যে, লাভজনক ভাবে কারখানা চালানো এবং শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার প্রয়োজন থেকেই এই পদক্ষেপ। কিন্তু শ্রমিক সংগঠনগুলো একে শ্রমিকদের সপরিবারে অনাহারের মুখে ঠেলেদেওয়ার চূড়ান্ত শ্রমিকবিরোধী পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করছেন।

শুধু ভক্সওয়াগনই নয়, থাইসেন, বস্চ, জেডএফ, ফোর্ড, ওপেল, মার্সিডিজ-বেনজ, এয়ারবাস প্রভৃতি একটার পর একটা জার্মান কর্পোরেট সংস্থায় হাজার হাজার কর্মসংকোচন চলেছে। জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, কিন্তু সে তুলনায় যতটুকু বেতনবৃদ্ধি হচ্ছে তা খুবই সামান্য। একচেটিয়া মালিকানাধীন ধাতু ও বৈদ্যুতিন শিল্পে মাত্র ১.৭ শতাংশ বেতনবৃদ্ধি ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু তাও কার্যকর হবে ২০২৫ সালের জুলাই থেকে। আইজি মেটাল শ্রমিক ইউনিয়ন মাত্র ৭ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি করেছে কিন্তু সেটাও বিগত বেশ কয়েক বছরের বেতন হ্রাসের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য।

একচেটিয়া পুঁজিপতিদেরই মালিকানাধীন পত্রিকাগুলো শ্রমিক-কর্মচারীবিরোধী প্রচারে নেমে পড়েছে। প্রখ্যাত ‘বিল্ড’ সংবাদপত্র ভক্সওয়াগন শ্রমিক-কর্মচারীরা কত সুযোগসুবিধে পায় তার অর্ধসত্য তথ্য প্রচার করে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে জনমানসে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। অথচ প্রকৃত তথ্য হল এই কারখানার একজন অ্যাসেম্বলিং শ্রমিক বোনাস সহ সমস্ত রকম ভাতা মিলিয়ে মাসে গড়ে ৩৬৫০ ইউরো মাইনে পান। ম্যানেজমেন্ট কর্মচারীদের বেতন সহ ভক্সওয়াগনের মোট বেতন-বাবদ খরচ হল তার মোট বার্ষিক আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ। এ দিকে মাত্র দশজন বোর্ড মেম্বারের বার্ষিক বেতন হচ্ছে বছরে ৪ কোটি ইউরো। এই শিল্পের বাউনাটাল শহরের একটি শাখায় আবার মোট আয়ের মাত্র ১.৫ শতাংশ বেতন খাতে খরচ হয়। হিসেবে দেখা গেছে একজন ভক্সওয়াগন শ্রমিক প্রতি ঘন্টায় যা বেতন পান সেই পরিমাণ মূল্য তিনি ৫ থেকে দশ মিনিটের মধ্যেই উৎপাদন করে ফেলেন। এর থেকেই বোঝা যায় ভ’ওয়াগন কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা কী নির্মমভাবে শোষিত হচ্ছেন! তাদের শ্রমশক্তির ২০ শতাংশ বেতন দিয়ে ৮০ শতাংশই লুটছে মালিক।

কর্পোরেট সংবাদপত্রগুলির দ্বিতীয় মিথ্যাচারটি হল, জার্মানির মোটরগাড়ি, ইস্পাত, রাসায়নিক প্রভৃতি শিল্পে নাকি পরিবেশ রক্ষা খাতে অতিরিক্ত খরচ করা হচ্ছে যার বিরূপ প্রভাব গোটা অর্থনীতির উপর পড়ছে। চরম দক্ষিণপন্থী জার্মান রাজনৈতিক দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) বলছে, পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করার জন্য কর্পোরেট সংস্থাগুলো ঈপ্সিত লাভ করতে পারছে না এবং এই জন্য তারা যানবাহনের বৈদ্যুতিকীকরণের বিরোধিতা করছে। কিন্তু মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার জন্যই পরিবেশ দূষণ রোধ করা আজ সারা পৃথিবী জুড়েই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান। এজন্য ডিজেল চালিত গাড়ি কমিয়ে বেশি বেশি করে বিদ্যুৎচালিত যানবাহনের ব্যবহার বাড়ানো একান্তই প্রয়োজন। তবে দেখতে হবে এর ফলে যেন কর্মসংকোচন না ঘটে। পেট্রল-ডিজেলে চালিত যানবাহনের পরিবর্তে বিদ্যুৎ, হাইড্রোজেন চালিত গাড়ি ব্যবহার, রেলপথকে পরিবহণের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার এবং তার সম্প্রসারণ প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর ফলে বরং আরও অসংখ্য কর্ম সৃষ্টি করা সম্ভব হবে এবং সপ্তাহে তিরিশ ঘন্টা কাজের বিনিময়েই শ্রমিক কর্মচারীদের পুরো বেতন দেওয়া সম্ভব হবে।

মোটরগাড়ি, বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশ সহ জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিখ্যাত শিল্পে এই অভূতপূর্ব সংকটকে সামাল দিতে জার্মান সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিপতিরা বিশ্ববাজারে ‘জার্মানির স্বার্থই প্রথম’ এই ধুয়ো তুলছে। হুবহু যেরকম ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ধুয়ো তুলে সম্প্রতি ভোটে বাজিমাত করলেন সে দেশের সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু জার্মানির মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী দল এমএলপিডি এই উগ্র দক্ষিণপন্থী স্লোগানকে ধিক্কার জানিয়ে বলেছে যে, এ কথা সত্য জার্মানি এখন গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই সংকট পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত নিয়মেরই সংকট। তাই এই সংকটের দায় শ্রমিক শ্রেণির ওপর চাপানো চলবে না। সে দেশের শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আপসকামী সোস্যাল ডেমোক্রেটিক শ্রমিক সংগঠনগুলি মুখে সংগ্রামের কথা বললেও কার্যত শিল্পক্ষেত্রে ধর্মঘটের বিরোধিতা করছে। ক্রমবর্ধমান শ্রমিক বিক্ষোভকে একটু প্রশমিত করতে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শুল্জও ভক্সওয়াগন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন যেন কর্মসংকোচন না করা হয়। অতীতেও তিনি এই ধরনের আবেদন করেছেন। কিন্তু শিল্পপতিরা তাতে কর্ণপাত করেনি বরং ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাই করেছে।

এই অবস্থায় এমএলপিডি দল পুঁজিপতি শ্রেণির সর্বাত্মক শ্রমিকস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। সর্বস্তরে কমপক্ষে ৭ শতাংশ বেতনবৃদ্ধি, সপ্তাহে ৩০ ঘন্টা কাজ, সমস্ত অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের স্থায়ী করা প্রভৃতি দাবি তুলেছে এবং এই সব দাবিতে গোটা জার্মানি জুড়ে সমস্ত শিল্পক্ষেত্রের শ্রমিকদের যুক্ত করে সর্বাত্মক ধর্মঘট ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে। তারা আরও দাবি করেছে যে, ধর্মঘট করা শ্রমিক শ্রেণির ন্যায়সঙ্গত অধিকার। সেই অধিকার খর্ব করা চলবে না এবং ধর্মঘটকারী শ্রমিকদের বেতন কাটা বা তাদের বিরুদ্ধে অন্য কোনও রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা চলবে না। তাদের দাবি, একচেটিয়া পুঁজিপতি ও ধনকুবেরদের কাছ থেকে পরিবেশ কর আদায় করে পরিবেশ রক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে। সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য দায়ী পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে যথার্থ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের বিপ্লবী আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণিকে সামিলের আহ্বান জানিয়েছে এমএলপিডি।