জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষার প্রাণসত্তাকেই ধবংস করবে

ঝাড়গ্রাম

গত ২৯ জুলাই জাতীয় শিক্ষানীতি–২০২০ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় গৃহীত হয়ে ঘোষণার পর থেকে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় শুরু হয়েছে৷ সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটি থেকে শুরু করে নানা ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠন, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী মহল এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন৷ খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতির নানা দিক, বিশেষ করে লকডাউনের সুযোগ নিয়ে অনলাইন শিক্ষা চালু করার যে ষড়যন্ত্র কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির তরফ থেকে করা হচ্ছিল তার বিরুদ্ধে সেভ এডুকেশন কমিটির তরফ থেকে প্রতিবাদ চলছিলই৷ এই শিক্ষানীতিতে সরকারি সিলমোহর পড়ার পর সেভ এডুকেশন কমিটি ১৮ আগস্ট দেশজুড়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ সহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে৷ ৮ আগস্ট সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটি থেকে এই নয়া নীতির বিরুদ্ধে যে অনলাইন প্রতিবাদ সভা হয় তাতে প্রায় আটশোর বেশি শ্রোতা উপস্থিত থেকে ফেসবুক মন্তব্য প্রদানের মাধ্যমে সমালোচনায় মুখর হন৷ অন্যান্য রাজ্যেও এমন সভাগুলিতে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ লক্ষিত হয়৷ বিভিন্ন রাজ্য সরকারও বিরোধিতা করে৷ লকডাউন সত্ত্বেও প্রতিবাদের মাত্রা এত তীব্রতায় পৌঁছায় যে প্রধানমন্ত্রী যিনি হাজার সমালোচনা থেকে নিজেকে আড়াল করতে মৌনতা অবলম্বন করাকেই শ্রেয় বলে মনে করেন তাঁকেও রাস্তায় নামতে হয় ও গত ৭ আগস্ট শিক্ষানীতির পক্ষে বিবৃতি দিতে বাধ্য হন৷

বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার এই শিক্ষানীতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করছে তা নজিরবিহীন৷ তারা ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর নতুন একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রবর্তন করার চেষ্টা শুরু করে৷ ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকেই এ বিষয়ে নানা কথাবার্তা তাঁরা বলছিলেন৷ ২০১৬ সালের মে মাসে প্রাক্তন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি সুব্রামনিয়াম কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি রিপোর্ট পেশ করেন৷ সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ঐ বছর একটি নথি প্রকাশ করে৷ তারপর ২০১৭ সালের জুন মাসে কস্তুরিরঙ্গনের নেতৃত্বে ‘খসড়া জাতীয় শিক্ষনীতি’ রচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়৷ এই কমিটি ২০১৯ সালের ৩১ মে ‘খসড়া জাতীয় শিক্ষনীতি–২০১৯’ মন্ত্রীর কাছে জমা দেয়, যা গত ২৯ জুলাই মন্ত্রীসভার অনুমোদন পেয়ে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি–২০২০’ নামে আত্মপ্রকাশ করে৷

অন্য কোনও মতই নেওয়া হয়নি

এই গোটা প্রক্রিয়ায় সরকার দাবি করেছে দেশের ৬৭৬টি জেলার ৬৬০০ ব্লকের আড়াই লক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে দু’লক্ষ মতামত তাঁরা সংগ্রহ করেছেন৷ আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, ‘বাঃ,  তা হলে তো সরকার বেশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জাতীয় শিক্ষানীতি রচনা করেছে’ প্রধানমন্ত্রীও বুক ফুলিয়ে বাহবা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু মতদানকারীদের তালিকা দেখলে যে কারোরই চক্ষু চড়কগাছ হবে৷ কস্তুরিরঙ্গন রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, মুখ্যত তারা হল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান, নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান৷ সংগঠন হিসাবে তাঁরা বিজেপির ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ এবং আরএসএস ঘনিষ্ঠ শিক্ষক সংগঠন ‘ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল’ ছাড়া দেশে আর কোনও ছাত্র বা শিক্ষক সংগঠনের খোঁজ পাননি৷ নানা ভিন্ন মতের ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠন এবং গণতান্ত্রিক মনন সম্পন্ন শিক্ষাবিদরা যে তাঁদের মত কয়েক দফায় হাজারে হাজারে কেন্দ্রীয় সরকারকে পাঠিয়েছিলেন তা তো অজানা নয়৷ তা হলে কমিটি কি সেগুলো বাজে–কাগজের–ঝুড়িতে নিক্ষেপ করল?

শিক্ষক–শিক্ষাবিদ–ছাত্র বা তাঁদের সংগঠনগুলির মূল্যবান মতামতগুলি কেবল বর্জ্য–পদার্থ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে তাই নয়৷ গত ২১ সেপ্টেম্বর দিল্লির বিজ্ঞান ভবনের সেন্ট্রাল অ্যাডভাইসরি বোর্ড অফ এডুকেশনের (CABE) সভায় মানব সম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী খসড়া শিক্ষানীতির উপর রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীদের মত যখন চেয়েছিলেন তখন গুজরাট, দিল্লি কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, মিজোরাম প্রভৃতি রাজ্য খসড়া নীতির বহু দিকের সমালোচনা করেছিল৷ প্রধানমন্ত্রীর সাধের ‘রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়োগ’ (আরএসএ) যার মাধ্যমে শিক্ষার উপর চূড়ান্ত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব খসড়ায় ছিল তার তীব্র বিরোধিতা হয়েছিল ঐ সভায়৷ যদি সত্যিই তাঁরা গণতান্ত্রিক হতেন তা হলে এই মতামতের কোনও প্রতিফলন ঘোষিত শিক্ষানীতিতে পড়ত না?

মোড়কটাই নতুন

আমরা কী দেখছি? ২০১৬ সাল থেকে একের পর এক যে নথি পেশ হয়েছে তার সঙ্গে সর্বশেষ নথি যা জাতীয় শিক্ষানীতি–২০২০ হিসাবে ঘোষিত হল তার মূল সুরের কোনও পার্থক্য নেই৷ মৌলিক শিক্ষার পরিবর্তে কর্মমুখী শিক্ষার উপর জোর, মাধ্যমিক পরীক্ষার অবলুপ্তি, স্কুলে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সেমেস্টার, সংস্কৃত শিক্ষার উপর জোর, ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব হ্রাস, শিক্ষক–ছাত্র পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিচালিত শ্রেণি–কক্ষ শিক্ষার পরিবর্তে অনলাইন শিক্ষার উপর জোর, কিছু স্কুল একত্র করে গুচ্ছ–স্কুল ব্যবস্থার প্রবর্তন, তিনটি অসম মানের বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি, ইউজিসি–এআইসিটিই প্রভৃতি ঐতিহ্যমণ্ডিত উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রক সংস্থার অবলুপ্তি ঘটিয়ে হায়ার এডুকেশন কমিশন নামে একটি সংস্থা তৈরি করা, ‘ভারতীয়ত্ব’ ও ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ প্রভৃতি হিন্দুত্ব–সুলভ আবেগে সুড়সড়ি দেওয়ার মতো শব্দের আড়ালে শিক্ষার গৈরিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণের ঝোঁক, শিক্ষার জন্য জিডিপি–র ৬ শতাংশ বা কেন্দ্রীয় বাজেটের ১০ শতাংশ বরাদ্দ করা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতির অনুপস্থিতি, শিক্ষাকে দেশি–বিদেশি কর্পোরেট সংস্থার মুনাফা তৈরির মৃগয়াক্ষেত্রে পর্যবসিত করা তথা শিক্ষার বেসরকারিকরণ–বাণিজ্যিকীকরণ-কর্পোরেটিকরণ ইত্যাদি এসবই তো পূর্বের সকল নথির অংশ ছিল৷ চূড়ান্ত নথিতেও সেগুলির সবই অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে৷ এগুলির সিংহভাগ শিক্ষায় আরএসএস–সঙঘ পরিবারের অ্যাজেন্ডা৷ তা হলে প্রশ্ন হল, তাঁরা অন্যদের কোন মত গ্রহণ করলেন? যে দু’লক্ষ মতামতকে ভিত্তি করে তাঁরা এই শিক্ষনীতি প্রণয়ন করলেন বলে দাবি করছেন তার সবগুলোই কি তা হলে বিজেপির ইচ্ছা–আকাঙক্ষার অনুসারী বলে ধরে নিতে হবে?

স্বাধিকার কেড়ে নেওয়া হল

যে ‘আরএসএ’ গঠনের বিরুদ্ধে গোটা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ হল, এমনকি গুজরাটের মত রাজ্যও প্রতিবাদ করল, তাকেও এই শিক্ষানীতিতে বেনামে রাখার ব্যবস্থা হল৷ এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত চালাকির আশ্রয় তাঁরা নিলেন৷বর্তমানে যে সেন্ট্রাল অ্যাডভাইসরি বোর্ড অফ এডুকেশন আছে তার হাতেই প্রভূত ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব এল অর্থাৎ যেহেতু প্রতিবাদ হয়েছে তাই ‘আরএসএ’ নয়, CABE কেই আইনি ক্ষমতা দিয়ে আরও শক্তিশালী করে চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে দেশের সমস্ত স্তরের শিক্ষার উপর ছড়ি ঘোরানোর ব্যবস্থা তাঁরা করতে চাইছেন৷ শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারের ছিঁটেফোটাও এতে অবশিষ্ট থাকবে না৷ এটা গণতন্ত্র না চরম শঠতা? শুধু মোদিজির স্বপ্নটা পূরণ হল না – শিক্ষার সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা হিসাবে ‘আরএসএ’ গঠন করে তার চূড়ায় নিজেকে আসীন করার পরিকল্পনা তাঁর ছিল৷ হল না, কার CABE–র চেয়ারম্যান শিক্ষামন্ত্রী৷ কিন্তু এই পরিস্থিতিতে CABE যে প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গুলিহেলনে চলবে তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না৷

প্রাথমিক শিক্ষার সর্বনাশ হবে

কেন এই শিক্ষানীতি দেশের বিপদ ডেকে আনবে বলে আপামর শিক্ষাপ্রেমী জনসাধারণ মনে করছেন? এখন সরকারি নিয়মে বিদ্যালয় স্তর ৬ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু হয় এবং ১০+২ বা ১২ বছরে তা শেষ হয়৷ দশমের পর মাধ্যমিক এবং দ্বাদশের পর উচ্চমাধ্যমিক হিসাবে দুটি বোর্ডের পরীক্ষা হয়৷ প্রথম শ্রেণির আগে নার্সারি বা প্রি–স্কুল গ্রামে সরকারিভাবে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত৷ যদিও বেসরকারিভাবে নার্সারি স্কুল সারা দেশজুড়ে আছে৷ নতুন নীতিতে (১০+২)–র পরিবর্তে (৫+৩+৩+৪) প্রথা প্রবর্তন করা হচ্ছে৷ এর ফলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র যা ৩–৫ বছর তাকে স্কুল–শিক্ষার মধ্যে আনা হল, তার সঙ্গে ২ বছর অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করা হল৷ এই হল তাদের প্রথম ৫৷ আমরা জানি, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মী বা সহায়িকাদের আসলে শিশু, তাদের মায়েদের দেখাশোনা ও রান্না করা খাবার দেওয়ার দায়িত্ব আছে এবং তার জন্য তাঁরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত৷ কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস নেওয়ার জন্য যে যোগ্যতামান, তা তাঁদের থাকে না৷ তাঁদের উপর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিকে পড়ানোর দায়িত্ব পড়ল৷ এর জন্য পরিকাঠামোগত বা উপযুক্ত শিক্ষকের সমস্যা যে হবে সে কথা বলাই বাহুল্য৷ উপরন্তু এর ফলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলো যা এমনিতেই অর্থাভাবে ধুঁকছে সেগুলি আরও বিপর্যস্ত হবে, প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিরও সর্বনাশ হবে৷ ৩–৫ বছরকে স্কুল পর্যায়ে নিয়ে এসে তাঁরা যখন আন্তর্জাতিক স্তরে দেশকে উন্নীত করেছেন বলে গর্ব করছেন তখন এই সর্বনাশের কথা খেয়াল রাখছেন না৷

নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তাঁরা ৮টি (৪X২) সেমেস্টারে ভাগ করছেন৷ কিন্তু সেমেস্টার প্রথা যার কলেজ স্তরের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে৷ তাতে সর্বাঙ্গীন শিক্ষা ও জ্ঞানের গভীরতা যে ব্যাহত হচ্ছে তা আমরা জানি৷ এ বিষয়ে শিক্ষক–শিক্ষাবিদ মহল সমালোচনায় মুখর৷ তার প্রতি কর্ণপাত না করে সরকার সেই প্রথাকে বিদ্যালয় স্তরে প্রবর্তন করছে কী কারণে? স্কুলের বুনিয়াদী শিক্ষার বুনিয়াদটাই এর ফলে নড়বড়ে হয়ে যাবে৷ দশমের পর মাধ্যমিক হিসাবে যে বোর্ডের পরীক্ষা আছে এবং যে পরীক্ষায় পাশ করলে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় তার অবলুপ্তি ঘটানো হচ্ছে৷ মাধ্যমিক–পাশ এ দেশে সরকারি বেসরকারি নানা চাকরি পাওয়ার একটা যোগ্যতা মান৷ দশম শ্রেণির পর বোর্ড পরীক্ষার অবলুপ্তি ঘটিয়ে বিদ্যালয় স্তরের শেষ পরীক্ষা দ্বাদশে নিয়ে যাওয়ার ফলে দু’ধরনের বিপত্তি তৈরি হবে৷ দশমের পর বহু ছাত্রের ‘ড্রপ–আউট’ হবে এবং যারা টিকে থাকবে তাদের আরও দু’বছর অপেক্ষা করতে হবে এই সংশাপত্র পাওয়ার জন্য৷ এ দেশের কোটি কোটি নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য কোন সুসংবাদ এই শিক্ষানীতি বহন করে আনল? প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ ফেল প্রথা চালু করার দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে তাঁরা কেবল তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলেছে৷

ধনীগরিব বৈষম্য আরও বাড়বে

এই শিক্ষানীতি অনলাইন শিক্ষার উপর জোর দিয়েছে৷ ৫০ শতাংশর বেশি পডুয়াকে সেই ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করবে বলে সরকার পরিকল্পনা করেছে৷ এমনকি ১০০ শতাংশ অনলাইন শিক্ষা ভিত্তিক স্নাতক–ডিগ্রি প্রদানের কলেজও তাঁরা খোলার অনুমতি দিচ্ছেন৷ কম্পিউটার–ল্যাপটপ ভিত্তিতে এই শিক্ষা প্রদান করা হবে৷ এখানে স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে হবে না, লাইব্রেরি–ল্যাবরেটরি তৈরি করতে হবে না, শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে না৷ ফলে সরকারের আর্থিক দায়িত্ব অনেক কমবে৷ অনলাইন শিক্ষার ‘অ্যাপ’ থাকবে অথবা পাঠদানরত শিক্ষকদের লেকচারের ভিডিও থাকবে যা ইন্টারনেট সম্পন্ন কম্পিউটার–ল্যাপটপ পাওয়া যাবে৷ তা শুনে পড়াশোনা হবে৷ বিত্তশালীরা ছাড়া অন্যরা এই শিক্ষা পাবে না৷ এই যন্ত্রের অভাবে লকডাউনের সময়ে ইতিমধ্যে পাঁচ জন পডুয়া ও একজন অভিভাবক আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন৷ যদি কম্পিউটার–ল্যাপটপ সবার থাকেও তাতেও কি আমরা দীর্ঘদিনের প্রচলিত ও সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষক–ছাত্রের সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শ্রেণিকক্ষ শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে অনলাইন শিক্ষাকে বিকল্প হিসাবে বেছে নিতে পারি? অনলাইন শিক্ষা শ্রেণিকক্ষ ভিত্তিক মূলধারা শিক্ষার সহায়ক হতে পারে, কিন্তু তা তার বিকল্প হতে পারে না৷ ‘শিক্ষাবিধি’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘মানুষ মানুষের কাছ হইতেই শিখিতে পারে  … প্রাণের দ্বারাই প্রাণ সঞ্চারিত হইয়া থাকে, … গুরু–শিষ্যের পরিপূর্ণ আত্মীয়তার সম্বন্ধের ভিতর দিয়াই শিক্ষা কার্য সজীব দেহের শোণিত স্রোতের মত চলিতে পারে’’৷ যে অনলাইন শিক্ষার ওপর এই নীতি জোর দিয়েছে তাতে প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রই হল ‘গুরু’ বা শিক্ষক৷ প্রশ্ন হল যন্ত্র কি কিশোর মনে ‘প্রাণ সঞ্চার’ করবে? ‘গুরু–শিষ্যের আত্মীয়তার’ সম্পর্ক গড়ে তুলবে? তাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখাবে? মননশীলতা সৃষ্টি করবে? না যন্ত্র কেবল ‘রোবোটিক’ কিছু মানুষের জন্ম দেবে? অন্যদিকে কম্পিউটার ইত্যাদি কেনার আর্থিক সামর্থকে ভিত্তি করে যে ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ তার ফলে দু’ধরনের ছাত্রেরও সৃষ্টি হবে৷ আবার ১৩৭ কোটি দেশের ছাত্র সমাজকে যদি ল্যাপটপ–স্মার্টফোন কিনতে বা আম্বানিদের মতো ব্যবসায়ীদের ‘ডেটা’ সিম ব্যবহার করতে বাধ্য করা যায় তাতে কর্পোরেট হাউসগুলির আশীর্বাদও জুটবে শাসক গোষ্ঠীর মাথায়৷

শিক্ষানীতির অত্যন্ত বিস্ময়কর দিক হল, উপক্রমণিকায় যা বলা হয়েছে এবং পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে যা আছে তাদের সম্পূর্ণ বৈপরীত্য৷ প্রতি পদেই স্ববিরোধিতা প্রকট৷ সচেতনভাবে না পড়লে যে কেউ বিভ্রান্তও হতে পারেন৷ কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে৷ ‘ন্যায়ের ভিত্তিতে সকলের জন্য সমমানের শিক্ষা প্রদান’ জাতীয় শব্দগুলি শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য–লক্ষ্য হিসাবে ছত্রে ছত্রে উল্লেখ আছে৷ গ্রামে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি অন্তর্ভুক্তির ফলে সরকার পোষিত বুনিয়াদি শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হবে এই আশঙ্কায় বিত্তশালী পরিবারের অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বেসরকারি স্কুল বেছে নেবে৷ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দেশি–বিদেশি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠিত ঝাঁ চকচকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রমরমা বাড়বে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খুলতে দেওয়া হবে৷ কোন পরিবারের পড়ুয়াদের স্থান সেখানে হবে? অন্য দিকে সরকার নিজেই তিনটি অসম মানের বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করবে– প্রথমটি গবেষণা কেন্দ্রিক, দ্বিতীয়টি কেবল শিক্ষণের জন্য এবং তৃতীয়টি ডিগ্রি প্রদানকারী অটোনমাস কলেজ স্তরের– যার ফলে চূড়ান্ত বৈষম্যের শিকার হবে পড়ুয়ারা৷ এত কিছুর পরেও তাঁরা ন্যায় ও সমতার তত্ত্ব আওড়াবেন?

বৈচিত্র্যের মধে ঐক্যবিঘ্নিত হবে

এই শিক্ষানীতি ‘বহুত্ববাদিতা’, ‘বৈচিত্র্য’ প্রভৃতি শিক্ষায় পডুয়াদের শিক্ষিত করে তুলবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ অথচ এই কথাগুলো উচ্চারণ করতে করতেই তাঁরা বহু জাতি, বহু ভাষাভাষী, বহু সংস্কৃতির দেশে এক পাঠ্য–বিষয়, এক পরীক্ষা, এক প্রবেশিকা পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে চলেছে৷ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর জোর দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা যখন আওড়াচ্ছেন তখন শিক্ষা যে যুগ্ম তালিকায় আছে তা তাঁরা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছেন৷ রাজ্যগুলির মতামত না নিয়ে শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে বহু রাজ্য সরকার তার প্রতিবাদ করেছে৷ ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’–এর শিক্ষা ছাত্রদের দেবেন যখন বলছেন তখন সংসদ এড়িয়েই জাতীয় শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করে ফেললেন৷ যখন সংসদ চলছে না, সংসদের উভয় কক্ষে আলোচনার কোনও সুযোগ নেই, বিরোধীদের মতামত দেওয়ার পরিস্থিতি নেই তখন এত তাড়াহুড়ো করে জাতীয় শিক্ষানীতির মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ক্যাবিনেটে পাশ করিয়ে তাকে চালু করার মধ্যে হীন উদ্দেশ্য ছাড়া আর কী থাকতে পারে? উপরন্তু লকডাউন ও করোনা সংক্রমণের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যখন ছাত্র–ছাত্রী–শিক্ষক–অভিভাবকদের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের কোনও উপায় নেই তার সুযোগ সরকার গ্রহণ করল যা গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক।  কোন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিক্ষা তাঁরা পড়ুয়াদের দেবেন? তামাশার বিষয় হল, প্রধানমন্ত্রী এরপর দাবি করলেন তাঁদের শিক্ষানীতিতে দেশের কোথাও কোনও বিরোধিতা নেই৷

মূল্যবোধের শিক্ষা কারা দিতে পারেন

মূল্যবোধের শিক্ষা তাঁরাই দিতে পারেন যাঁরা নিজেরা সততার সাথে জীবনে তার চর্চা করেন, বিজ্ঞান ভিত্তিক মননের জন্ম তাঁরাই দিতে পারেন যাঁরা সর্বপ্রকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তা এবং অনৈতিহাসিক ভাবনা–ধারণা থেকে মুক্ত৷ যে দলটি কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় বসে প্রতি মুহূর্তে বিধায়ক কেনা–বেচা করে বিরোধী শাসিত রাজ্যের ক্ষমতায় বসার ষডযন্ত্র করে, যে দল ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকার বিরোধী যে কোনও কণ্ঠকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করে, যাদের ‘আইটি সেল’ সাইবার দুনিয়ায় মিথ্যার জাল ছড়িয়ে নিজেদের হীন স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা করে সেই দলের নেতারা মূল্যবোধের শিক্ষা দেবেন? এই শিক্ষানীতিতে ছাত্র মনকে ‘বিজ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর’ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে৷ গত ৬–৭ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী সমেত সাংবিধানিক পদমর্যাদা সম্পন্ন নানা ব্যক্তির মুখনিঃসৃত বাণী হিসাবে আমরা শুনতে অভ্যস্ত হয়েছি যে, ‘মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট’, ‘ডারউইনের তত্ত্ব ভুল’, ‘বেদের যুগে এরোপ্লেন, প্লাস্টিক সার্জারি বা স্টেম সেল’ ইত্যাদি৷ স্রেফ ভোটবাজির জন্য যাঁরা পৌরাণিক কাহিনিকে ইতিহাসে পর্যবসিত করেন তাঁরাই যদি ছাত্রদের মধ্যে বিজ্ঞান সম্মত মনন বিকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তা হলে তার মত রসিকতা আর কী আছে?

শিক্ষার প্রাণসত্তাই ধ্বংস হবে

দুঃখজনক হল, ঐ শিক্ষানীতিতে সিলমোহর লাগাতে যে দিনটা তাঁরা বেছে নিলেন সেই ২৯ জুলাই ছিল বিদ্যাসাগরের ১৩০তম প্রয়াণ দিবস৷ আবার এই বছর প্রভূত উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে৷ বিদ্যাসাগর ছিলেন আমাদের দেশের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার জনক৷ সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে ঊনবিংশ শতাব্দীতেই তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে মধ্যযুগীয় যে শিক্ষা পদ্ধতি চলছিল তাকে বাতিল করে আধুনিক শিক্ষা চালু করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন৷ ধর্মীয় কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক ও যুক্তিবাদী মননসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই তা তিনি করেছিলেন৷ কিন্তু বর্তমান শিক্ষানীতির প্রণেতারা তাঁর নাম উচ্চারণ করার প্রয়োজনও বোধ করেননি৷ বরং একবিংশ শতব্দীতে এসে ‘ভারতীয়ত্ব’, ‘ভারতীয় ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ’ ইত্যাদিকে এই শিক্ষানীতির মূল চালিকাশক্তি ঘোষণা করে তাঁরা বিদ্যাসাগর নির্ধারিত শিক্ষাকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে মধ্যযুগীয় ভাবনা ধারণার চর্বিতচর্বণ করতে চাইছেন, ইতিহাসের গতিপথকে বিপরীতমুখী করতে চাইছেন৷ মোদিজি দাবি করছেন, এই শিক্ষানীতি যুগান্তকারী৷ অথচ আমরা দেখছি, এই নীতিতে শিক্ষা–সংকোচন, বেসরকারিকরণ–বাণিজ্যিকীকরণ ও কেন্দ্রীকরণের যে ত্রিফলা আক্রমণ আনছে তা স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশে ছিল৷ পুঁজিবাদের সেবাদাস যে দলই ক্ষমতায় এসেছে তারাই শিক্ষায় এমন আক্রমণ নামিয়ে এনেছে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে জাতীয় নেতাদের সার্বজনীন, গণতান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা প্রচলনের দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়েছে৷ এই ত্রিমুখী আক্রমণের সঙ্গে বিজেপির অবদান হল শিক্ষার চূড়ান্ত রাজনীতিকরণ ও গৈরিকীকরণ৷ রাজনীতিকরণের মধ্য দিয়ে শিক্ষা প্রশাসনের নানা স্তরে, বিধিসম্মত নানা কমিটিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বডিতে বিজেপি–আরএসএস ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মনোনয়ন সুনিশ্চিত করবে এবং সেই ব্যক্তিদের দিয়ে বস্তাপচা মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ও অনৈতিহাসিক বিষয়বস্তু পাঠ্যতালিকায় অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে কিশোর বয়স থেকে সংঘপরিবার সুলভ মানসিকতার ধাঁচা সৃষ্টি করতে চাইবে৷ শিক্ষার মূল প্রাণসত্ত্বাই এতে ধবংস হবে৷ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০–র বিপদ এখানেই সব থেকে বেশি৷