করোনা বিপর্যয়ে গোটা দেশ যখন সন্ত্রস্ত, বিপদগ্রস্ত, সেই সময়ে রাজ্য সরকারগুলি এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংগঠনের সঙ্গে কোনও রকম আলাপ-আলোচনা ছাড়াই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ ঘোষণা করে দিল। এই শিক্ষানীতিটির খসড়া যখন প্রকাশিত হয়েছিল, তখন থেকেই যুক্তির আলোয় সেটি পর্যালোচনা করে সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও এর নানা ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক দিক চিহ্নিত করা ও সে সম্পর্কে জনমত গড়ে তোলার কাজ চালিয়ে আসছিল। কেন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বিপজ্জনক, সে সম্পর্কে এই সংগঠন সংক্ষেপে যে সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলি তুলে ধরেছে, বিষয়টি বুঝতে সাহায্য হবে মনে করে আমরা তা প্রকাশ করলাম।
শিক্ষা আমাদের অধিকার। দেশের শাসকরাও অন্তত মুখে স্বীকার করে, শিক্ষার অধিকার দেশের মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু সরকারি নীতিতে তার প্রতিফলন কতটুকু? দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত, সেই শিক্ষাবিদ, শিক্ষকসমাজ, গবেষক, অভিভাবক, ছাত্রসহ ব্যাপক অংশের শিক্ষানুরাগী মানুষের তুলে ধরা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ তে কেন্দ্রীয় সরকার সিলমোহর লাগিয়ে দিল এমন একটা সময়ে যখন গোটা দেশ করোনা অতিমারির ফলে অর্থনৈতিকভাবে চরম সংকটগ্রস্ত এবং জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে ব্যস্ত।
ভারতের মতো একটি বিশাল এবং বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে জাতীয় শিক্ষানীতির মতো বিষয়কে রূপ দেওয়া নিঃসন্দেহে একটি কঠিন এবং ব্যাপক পরিসরের কাজ। তাই প্রয়োজন দেশের সমস্ত স্তরের শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা, যে কমিটি এই বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত সমস্যাগুলির নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানসম্মত সমাধান বের করবে। এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক কর্তব্যটি জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া প্রস্তুতকারী কমিটি তাদের চিন্তাতেই রাখেনি। তাই এই জাতীয় শিক্ষানীতি-কে সরকারপন্থী আমলাদের চিন্তাপ্রসূত খসড়ার বাইরে আর কিছু বলা যায় না। এমনকি জাতীয় শিক্ষানীতির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খসড়া প্রস্তুত করার আগে, শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় স্তরে একটি বিতর্ক আয়োজনের কথাও তাঁরা ধর্তব্যের মধ্যে রাখেননি। শিক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের যৌথ আওতায় থাকা সত্তে্বও, শিক্ষানীতি প্রণয়নে রাজ্য সরকারগুলির মতামত, খসড়া প্রণয়নকারী কর্তাব্যক্তিরা সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। উপরন্তু শিক্ষার বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরন, ব্যয় বৃদ্ধি, অপরিমিত সরকারি অনুদান কমানোর সমস্যাগুলি সমাধানের কোনও উল্লেখ না করে জাতীয় শিক্ষানীতি এই সমস্যাগুলোকে আইনসিদ্ধ করার দিকে এক ঘৃণ্য পদক্ষেপ।
যে পদ্ধতিতে এই শিক্ষানীতির খসড়া তৈরি করা হল এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রক তা গ্রহণ করল, তা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এবং একতরফা ভাবেই এই শিক্ষানীতিকে রাজ্যগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এআইডিএসও স্পষ্ট ভাবে এই শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি জানাচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ, কেন্দ্রীকরণ এবং সর্বাত্মক ফ্যাসিবাদ কায়েমের ছক এই শিক্ষানীতিকে বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করার আন্দোলনে ভারতের প্রতিটি মানুষকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
এখন এই নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির বিভিন্ন দিকগুলি খতিয়ে দেখা যাক।
১) যে পদ্ধতিতে এই শিক্ষানীতির খসড়া তৈরি হল এবং যেভাবে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, শিক্ষক ও ছাত্রদের মতামত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দেশের সাধারণ মানুষ ও রাজ্য সরকারগুলির ওপর তা চাপিয়ে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক, তা চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক ও একতরফা।
২) পূর্বের স্কুল পাঠ্যক্রম ১০+২ -এর পরিবর্তে তিন বছরের প্রাক-প্রাথমিক যুক্ত করে গোটা প্রক্রিয়াটিকে ৫+৩+৩+৪ -এর পুনর্গঠন প্রক্রিয়াটিকে বর্তমান শিক্ষানীতিকে ‘বৈপ্লবিক’ বলে সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ এই শিক্ষানীতির বাস্তব রূপ নিয়ে কোনও ‘বৈপ্লবিক’ দৃষ্টিভঙ্গি তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। এই স্তরের শিক্ষার দায়িত্ব তারা তুলে দিচ্ছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির হাতে, যেখানে তাদের এই রঙিন নকশা রূপদানের ন্যূনতম পরিকাঠামোটুকুও নেই, সুপ্রশিক্ষিত শিক্ষক তো দূরের কথা। প্রাক-বিদ্যালয় পঠন-পাঠন এবং সর্বজনীন শিক্ষার স্বার্থে সরকারের উচিত ছিল পঠন-পাঠনের সমস্ত দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করে শিক্ষার যাবতীয় খরচ বহন করা। যেহেতু জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ দায়িত্ব গ্রহণের ব্যাপারে নীরব এবং তারা শিক্ষার ব্যয় বহনের কোনও উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেনি, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তাদের এই ‘বৈপ্লবিক’ শিক্ষানীতি প্রাক-প্রাথমিক স্তরে সর্বাত্মক বেসরকারিকরণকেই উৎসাহিত করবে।
৩) এই শিক্ষানীতি প্রাক-প্রাথমিকের তিন বছর এবং গ্রেড ১ ও ২, অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি– এই দু’বছর মিলিয়ে মোট পাঁচ বছরকে একটি ভিত্তিমূলক স্তর হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং প্রথাগত শিক্ষার পরিবর্তে শিশুদের জন্য খেলাধুলা ভিত্তিক শিক্ষার সুপারিশ করেছে, যা সর্বশিক্ষা অভিযান, ডিপিইপি-এর ধারাবাহিকতায় সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে পাঠরত লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষণ ও শিক্ষাদানকেই বিপন্ন করে তুলবে।
৪) তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিকে তারা প্রস্তুতি ধাপ বলছেন। সেখানে কিছু কিছু পাঠ্যবই থাকলেও প্রস্তাব অনুযায়ী বিষয় ভিত্তিক নিয়মিত পাঠ শুরু হবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে। অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা প্রায় কিছুই পড়বে না। বিশ্বব্যাঙ্ক অনুমোদিত ডিপিইপি কর্তৃক শিক্ষাদান পদ্ধতিতে যে বিতর্কমূলক পরিবর্তন করা হয়েছিল তা ভারত সহ গোটা বিশ্বে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। শিক্ষাগ্রহণের সময়-পরীক্ষিত প্রক্রিয়াতে হস্তক্ষেপ করা বিপর্যয় ডেকে আনছে এবং তা ইতিমধ্যেই শিক্ষার মানকে তলানিতে ঠেলে দিচ্ছে।
আজকের বিদ্যালয়গুলিতে বিপর্যস্ত শিক্ষা ব্যবস্থার মূল কারণগুলি হল, ক) দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল না থাকা, খ) শূন্যপদ পূরণ করতে ব্যর্থতার ফলে স্থায়ী শিক্ষকের তীব্র ঘাটতি এবং পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাব, গ) সরকারি অনুদানের ক্রমাগত সংকোচন এবং ঘ) অ্যাকাডেমিক কাজের বাইরে শিক্ষকদের ব্যস্ত থাকা ইত্যাদি।
শিক্ষার এই মূল সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা না করে আজ পর্যন্ত সব জাতীয় শিক্ষানীতি নির্ধারক কমিটি এবং সরকারগুলি শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন কিংবা শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে কাটাছেঁড়া এবং সিলেবাস পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই তাদের শাসনকে সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেছে।
৫) মাধ্যমিক স্তরে (নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি) এই শিক্ষানীতির সুপারিশ– পড়াশোনার ধরন হবে মাল্টিডিসিপ্লিনারি। অর্থাৎ বিজ্ঞান, কলা, সাহিত্য, খেলা, গান সহ সকল বিষয় এক সঙ্গে চর্চার সুযোগ। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও প্রথাগত বই থাকবে না। অথচ অষ্টম শ্রেণির পর শিক্ষার্থীর উপর চাপানো হবে ১২টি বিষয়ের বোঝা, সাথে ৪০টি ঐচ্ছিক বিষয়। এই নীতি শুধু অবৈজ্ঞানিকই নয়, ছাত্রস্বার্থ বিরোধী, যা শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপকেই আরও বাড়িয়ে তুলবে। স্কুলস্তর থেকে শুরু করে কলেজস্তর পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষার্থীদের মাল্টিডিসিপ্লিনারি পদ্ধতিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগ করে দেওয়াকে তারাল ‘বৈপ্লবিক’ বলে অভিহিত করেছে। বিজ্ঞান বিভাগে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ও গণিত, কলা বিভাগের ইতিহাস, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়গুলি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং একে অপরের পরিপূরক। এই বিষয়গুলি দীর্ঘ সময় ধরে সিলেবাসে যথার্থ কম্বিনেশন হিসেবে পরীক্ষিত। বিজ্ঞান বিভাগে গণিত এবং রসায়নকে আলাদা করে দিলে কিংবা কলা বিভাগে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে আলাদা করে দিলে শিক্ষার্থীদের বিষয় সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে তা বাধা তৈরি করবে। মাল্টিডিসিপ্লিনারি শিক্ষায় একজন ছাত্র বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে পারে, কিন্তু তাকে কি শিক্ষা বলা যায়? স্মরণ করা যেতে পারে ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘শুধু লেখা, পড়া শেখা, অঙ্ক করাটাকেই শিক্ষা বলে না। শিক্ষার্থীর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান প্রদান করার প্রয়োজনে ভূগোল, জ্যামিতি, সাহিত্য, প্রাকৃতিক দর্শন ও নৈতিক দর্শনের পাঠ, পলিটিক্যাল ইকোনমি ইত্যাদি পড়ানো দরকার। আমাদের এমন শিক্ষক চাই যারা বাংলা এবং ইংরেজি জানে এবং সমস্ত ধর্মীয় সংস্কার থেকে মুক্ত।’
৬) জাতীয় শিক্ষানীতি ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইন্টার্নশিপ সহ বৃত্তিমুখী শিক্ষা চালু করার সুপারিশ করেছে। সমস্ত বড় মানুষই বলেছেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে চিন্তায় মননে চরিত্রে যথার্থ মানুষ তৈরি করা। শিক্ষানীতির এই প্রস্তাবকে শুধু বৃত্তিমুখী শিক্ষার উপরে জোর দেওয়া বললে ভুল হবে, এটা হল শিক্ষার বৃত্তিমুখীকরণ। শিক্ষার এই বৃত্তিমুখীকরণ দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষিত প্রথাগত পদ্ধতিতে পঠন-পাঠন ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করবে। কেবলমাত্র কিছু বিষয়ে বৃত্তিমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়া শিক্ষা হতে পারে না। ‘কোনও একটি বিষয়ে মানুষকে বিশেষজ্ঞ বানানোই যথেষ্ট নয়। সুপ্রশিক্ষিত করে তাকে ভালো যন্ত্র বানানো যেতে পারে, কিন্তু তার মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। একজন শিক্ষার্থীর সুন্দর-অসুন্দরের চেতনা, ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা এবং মূল্যবোধের প্রতি আকর্ষণ থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। না হলে কেবল কিছু বিষয়ে বিশেষত্ব অর্জন করলে তাকে প্রশিক্ষিত কুকুর বলা যায়, উন্নত মানুষ নয়। অপরিণত অবস্থাতেই বিশেষজ্ঞ করবার প্রচেষ্টা এবং প্রতিযোগিতামূলক বিষয়গুলিতে অত্যাধিক গুরুত্ব দেওয়া মানবিক দিক থেকে একজনকে মুষড়ে ফেলে এবং তার সংস্কৃতি জগতের পরিবর্তন ঘটায়’ (এডুকেশন ফর ইন্ডিপেন্ডেন্ট থট : অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, ১৯৫২)। মহান মানবতাবাদী বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের এই ঐতিহাসিক উক্তির মর্যাদা আমরা কীভাবে দেব?
৭) এই শিক্ষানীতিতে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। দেশে হাজার হাজার আইটিআই এবং ডিপ্লোমাধারীরা চাকরির জন্য রাস্তায় রাস্তায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, নার্স সহ আরও অনেকে কর্মহীন হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই পেটের তাগিদে এমন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন যা তাঁদের বিষয় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই যখন অবস্থা, তখন কী করে বৃত্তি শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীর জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারে? এভাবে চাকরির মিথ্যা ফানুস ওড়ানোর দ্বারা শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষার সুযোগ থেকে যেমন বঞ্চিত হবেন, তেমনই তাঁদের কর্মসংস্থানও হবে না।
৮) স্কুল কমপ্লেক্স স্থাপনে জোর দেওয়া হয়েছে এই শিক্ষানীতিতে। জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়ায় স্কুল কমপ্লেক্স-এর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত স্কুলগুলিকে এই স্কুল কমপ্লেক্স-এর মাধ্যমে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা হবে। বলা হচ্ছে এখানে কারও কোনও সমস্যা হলে অন্যেরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। এক কথায় স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগ, পরিকাঠামো তৈরি, গ্রন্থাগার তৈরি সহ বহু বিষয়ে সরকারি ব্যর্থতা স্বীকার করে, সংশ্লিষ্ট সমস্ত বিষয় থেকে সরকারের হাত গুটিয়ে নেওয়ার নামই হল স্কুল কমপ্লেক্স। সমস্ত গালভরা কথার আড়ালে সরকারের গোপন অভিসন্ধি হল, স্কুলগুলিতে সরকারি অনুদান প্রদান, পরিকাঠামো তৈরি, নতুন শিক্ষক নিয়োগ এবং নতুন স্কুল গঠনের সরকারি দায়িত্ব অস্বীকার করা। এই নীতি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে। বলা হয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে ৩০ জনের কম ছাত্র থাকলে সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হবে (সম্মিলিত জেলা শিক্ষা দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৬০ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার মুখে)। আরও বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে কেবলমাত্র সেই সমস্ত জেলায় একটি বৃহৎ মাল্টিডিসিপ্লিনারি কলেজ স্থাপন করা হবে যে সমস্ত জেলায় ছাত্র সংখ্যা ন্যূনতম তিন হাজার। বলা হচ্ছে, ২০৪০ সালের মধ্যে জেলায় একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হওয়া নির্ভর করবে সেই জেলায় ছাত্র সংখ্যা তিন হাজারের বেশি না কম, তার ওপরে। এর ভয়ঙ্কর পরিণতিতে দেশজুড়ে লক্ষাধিক স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। কাছাকাছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুযোগ কমবে এবং শিক্ষার্থীরা বঞ্চনার শিকার হবে।
৯) জাতীয় শিক্ষানীতি পুনরায় ত্রি-ভাষা ফর্মুলার পক্ষেই প্রস্তাব করেছে। আগের শিক্ষানীতিগুলির মতোই জাতীয় শিক্ষানীতিও ন্যূনতম পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে আঞ্চলিক ভাষা অথবা মাতৃভাষার কথা বলেছে এবং সুপারিশ করেছে, যে তিনটি ভাষায় শিক্ষার্থীরা শিখবে তার মধ্যে দুটি ভাষা ভারতীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই ভ্রান্ত ভাষানীতি এবং ইংরেজি ভাষা চর্চা পঞ্চম শ্রেণি থেকে শুরু করার সুপারিশ ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ অভিভাবককে বাধ্য করেছে তাদের সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে পাঠাতে যেখানে ইংরেজি চর্চার সুযোগ রয়েছে প্রথম শ্রেণি থেকেই। কিন্তু অবাক করার মতো ঘটনা এই যে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি এই ভাষানীতির সুপারিশ মেনে তো চলেইনি বরং মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয়টিকেও তারা এড়িয়ে গেছে সরকারের নাকের ডগায় বসে। ফলে পঠন-পাঠনের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই থেকে গেলল। দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ে তারা এই ভাষানীতিকে ঠাট্টায় পর্যবসিত করেছে। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতি সরকারি স্কুলগুলিতে প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি ভাষা চালুর বিষয়ে একটি মাত্র কথা খরচেরও প্রয়োজন বোধ করেনি। মাতৃভাষা ও ইংরেজি নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত ‘দ্বি-ভাষাতত্ত্বের কথা এআইডিএসও ছয় দশক ধরে জানিয়ে আসছে। এই ‘দ্বি-ভাষাতত্ত্ব’ অনুযায়ী প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পাঠদানের মাধ্যম হবে মাতৃভাষা এবং ইংরেজি ভাষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রথম শ্রেণি থেকেই পড়াতে হবে। কারণ ইংরেজি ভাষা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং অবশ্যই তা বিশ্বের সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডারে বিচরণের মূল চাবিকাঠি। এছাড়াও বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম।
জনস্বার্থের কথা ভেবে এই ‘দ্বি-ভাষানীতি’ প্রবর্তনের পরিবর্তে ১৯৬০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সমস্ত ক্ষমতাসীন সরকারগুলি ‘ত্রি-ভাষাতত্ত্ব’ -কে জোর করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। যে ‘ত্রি-ভাষানীতি’-র সুপারিশ জাতীয় শিক্ষানীতি করেছে তা বৈষম্যমূলক এবং দরিদ্র মানুষের প্রতি বঞ্চনার নামান্তর।
১০) বলা হয়েছে, সংস্কৃত হবে ঐচ্ছিক এবং তিনটি শিক্ষণীয় ভাষার মধ্যে একটিয ঐচ্ছিক করার অজুহাতে সংস্কৃতকে আবশ্যিক হিসেবে আরোপিত করার অনেক ইঙ্গিত রয়েছে এই নীতিতে। যেকোনও ভাষা শিক্ষার নির্ণায়ক দিকগুলি হল, ক) সেই ভাষাকে হতে হবে সজীব এবং একটি বড় অংশের মানুষ যেন সেই ভাষায় কথা বলে। খ) সেই ভাষা হতে হবে বোধগম্য এবং বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে আয়ত্ত করতে সেই ভাষা সাহায্য করবে। গ) সেই ভাষা আমাদের চাকরি ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। যেহেতু সংস্কৃত একটি বিলুপ্ত ভাষা, লোকে আর সে ভাষায় কথা বলে না, তাই সংস্কৃত শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার আয়ত্ত করা বা চাকরি ক্ষেত্রে সাহায্য– কোনওটাই সম্ভব নয় এবং সে কারণে এই ভাষার শিক্ষা সময় ও সম্পদ উভয়েরই অপচয়। এই অবস্থায়, কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকারের সংস্কৃত ভাষার প্রসারণের চেষ্টা নিন্দনীয় এবং সাধারণ মানুষের টাকার অপব্যবহার। ভাষা হিসেবে সংস্কৃত সমৃদ্ধ হলেও গ্রিক বা ল্যাটিনের মতো প্রাচীন ভাষাগুলির মতোই বিলুপ্ত। অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, সংস্কৃত ভাষা আরোপ এবং ‘শিক্ষানীতির ভারতীয়করণ’ আসলে বিজেপির রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছাড়া কিছু নয়।
প্রায় দু’শো বছর আগে ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম উদগাতা রাজা রামমোহন রায় সংস্কৃত সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘… আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে সরকার হিন্দু পণ্ডিতদের অন্তর্গত সংস্কৃত স্কুল স্থাপন করে জ্ঞান জ্ঞাপনের চেষ্টা করছে। এই ধরনের শিক্ষালয়গুলির বাস্তবিক ক্ষেত্রে সমাজে কোনও গ্রহণযোগ্যতা বা উপকারিতা থাকবেনা। সংস্কৃত শিক্ষা এই দেশকে অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখার জন্য সর্বোত্তম উপায় হিসেবে গণ্য হবে’ (সূত্র : ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে লেখা চিঠি, ১১ ই ডিসেম্বর ১৮২৩)।
১১) এই শিক্ষানীতি স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং সাম্মানিক (ফেলোশিপ)-এর সাধারণ প্রবেশিকা পরীক্ষা পরিচালনার জন্য আমলাতান্ত্রিক সংস্থা ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। ভারতে প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলি সব সময়েই দরিদ্র ছাত্রদের স্বার্থবিরোধী। এগুলি কোচিং সেন্টারগুলির মুনাফা লাভে সাহায্য করে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর অত্যন্ত মানসিক চাপ সৃষ্টি করে তাদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। এটি শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরিত করে। শিক্ষার বিপুল ব্যয় ও কোচিং সেন্টারের খরচের বোঝা বইতে না পেরে হাজার হাজার মেধাবী দুঃস্থ ছাত্রছাত্রী শিক্ষাজগৎ থেকে দূরে চলে যায়। অভাবী ছাত্রদের স্বার্থের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে জাতীয় শিক্ষানীতি স্নাতক স্তরেও প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রবর্তনের সুপারিশ করছে যা নিঃসন্দেহে হতাশাজনক।
১২) এই শিক্ষানীতি ‘ম্যাসিভ ওপেন অনলাইন কোর্সেস’, ই-কোর্স, ভার্চুয়াল ল্যাব প্রবর্তনের ওপর জোর দিয়েছে। অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি মূল প্রথাগত শিক্ষার সহায়ক হতে পারে কিন্তু বিকল্প হতে পারে না। অনলাইন শিক্ষাকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে যা শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ ও বেসরকারিকরণকে আরও দ্রুততার সঙ্গে ত্বরান্বিত করবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই অনলাইন শিক্ষা ক্লাসরুমের মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ও তাদের মধ্যে আদান-প্রদানের ভূমিকাকে নষ্ট করে শুধু শিক্ষার প্রাণসত্তাকে মেরেই ক্ষান্ত হবে না, প্রথাগত শিক্ষাকে এভাবে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হলে শিক্ষা বিস্তারের নতুন নতুন প্রথাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয়টিও গুরুত্ব হারাবে। এতে সরকারের দায়িত্ব কমবে এবং শিক্ষায় সরকারি ব্যয় কমানো সহজ হয়ে দাঁড়াবে। প্রসঙ্গত ভারতবর্ষে যখন দুর্দশাগ্রস্ত আর্থসামাজিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রী কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন এবং আধুনিক প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত, তখন সর্বাত্মক অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ।
১৩) জাতীয় শিক্ষানীতিতে একাধিক প্রবেশ-প্রস্থান বিকল্প সমেত ৪ বছরের স্নাতক ডিগ্রির সুপারিশ করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে যে ৪ বছরের ডিগ্রি প্রোগ্রামটি হবে খুবই নমনীয়। যদি কোনও ছাত্রছাত্রী মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয়, তবে সার্টিফিকেট প্রদানের ব্যবস্থাটি হবে এইরকম : ১ বছরের জন্য একটি ডিপ্লোমা, ২ বছরের পর একটি অ্যাডভান্সড ডিপ্লোমা, ৩ বছরের জন্য ডিগ্রি এবং ৪ বছরের পর ব্যাচেলরস প্রোগ্রাম। দুঃখের বিষয় হল, এই নীতিটি সরকারকে উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব থেকে খুব সুচারুভাবে মুক্ত করে দেবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলি পরিণত হবে বিভিন্ন রকম ‘সার্টিফিকেট’ কেনাবেচার একটি বাজারে। চাকরি ও সার্টিফিকেটের খুড়োর কল দেখিয়ে নির্লজ্জের মতো ড্রপ আউটকে আইনসিদ্ধ করে দেওয়া হল এই শিক্ষানীতির দ্বারা। শিক্ষিত বেকারের এই বাহিনীতে যে কোনও বেসরকারি সংস্থাই সন্দেহাতীত ভাবে একজন ডিপ্লোমা বা অ্যাডভান্সড ডিপ্লোমাধারীর চাইতে একজন ৪ বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রিধারীকে বেছে নিতে চাইবে। উপরন্তু, কোর্সটি মাঝপথে ছেড়ে দেবার পর কোনও ছাত্রী বা ছাত্র আবার পরবর্তীকালে পড়াশুনোয় ফিরবে, এই দাবিটি করার মাধ্যমেই এই নীতি প্রণেতাদের দারিদ্র্য ও বেকারত্বের প্রতি নিছক অসংবেদনশীলতাই প্রকাশ পায় মাত্র। সার্টিফিকেটের অফারগুলি যতই লোভনীয় হোক, অর্থনৈতিক সংকট অধিকাংশ পরিবারে এত প্রকট যে, যারা একবার পড়া ছেড়ে দেয়, তারা শিক্ষাপ্রাঙ্গণে সাধারণত আর কখনই ফিরতে পারে না, যদি না বিনামূল্যে স্কলারশিপ ও নিশ্চিত চাকরি তাদের দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তা হলে এই ৪ বছরের ডিগ্রি প্রোগ্রামটি আনার পেছনে উদ্দেশ্য একটাই দাঁড়ায় যে, যেহেতু পশ্চিমি দেশগুলিতে শিক্ষাব্যবস্থা এভাবে চলে, তাই এই জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও এভাবে ৪ বছরের কাঠামোতে পুনর্বিন্যাস করা হলে একজন ভারতীয় ছাত্রী “ছাত্র একটি বিদেশি ডিগ্রি কিনতে পারবে, এবং একজন বিদেশি ছাত্রী“ ছাত্র একটি ভারতীয় সার্টিফিকেট কিনতে পারবে। এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে ভারতীয় কলেজ“বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাত মেলানো সহজতর করে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ উচ্চশিক্ষার মূল সমস্যাগুলি এবং বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার সমস্যাগুলির কথা আদৌ বলে না। উচ্চশিক্ষার ব্যয়নির্বাহের দায় থেকে সরকারের অব্যাহতি পাওয়ার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই নীতির ফলেই চারদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি কলেজ গজিয়ে উঠেছে। এর ফলে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ৭০ শতাংশেরই মালিকানা বেসরকারি সংস্থার হাতে এবং ক্রমাগত টিউশন ফি ও ভর্তির ফি বৃদ্ধি সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের কলেজেই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই, উচ্চশিক্ষায় কমসংখ্যক ছাত্রের যুক্ত হওয়ার পিছনের মূল কারণগুলি, যথা– বেকারত্ব, দারিদ্র্য, অস্বাভাবিক বেশি ফি, শিক্ষার সার্বিক বেসরকারিকরণ, সেগুলির সমাধানের কোনও চেষ্টা না করে ডিগ্রি প্রোগ্রামটিকে একটি আন্তর্জাতিক পণ্যে পরিণত করার উদ্দেশ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি নির্লজ্জভাবে ৪ বছরের ডিগ্রি প্রোগ্রামের পক্ষে সওয়াল করছে। আমরা যেন ভুলে না যাই, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীরা ইতিমধ্যেই এই প্রোগ্রামকে বর্জন করেছেন এবং সেখানে এটির ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে। তাই যেহেতু এই ৪ বছরের প্রোগ্রামটি বৈষম্যমূলক এবং এটি ড্রপ আউটকে আইনি বৈধতা দেয়, তাই এটি বর্জন করতে হবে। স্মরণ করা যেতে পারে, আধুনিক শিক্ষার জনকদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব জন স্টুয়ার্ট মিলের কথা। তিনি বলেছেন, ‘‘জীবিকা নির্বাহের কিছু বিশেষ ধারায় শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষিত করে তোলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য নয়, সুচতুর আইনজীবী বা চিকিৎসক বা ইঞ্জিনিয়ার গড়ে তোলা নয়, সুযোগ্য ও সুশিক্ষিত মানুষ গড়ে তোলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আইনজীবী বা চিকিৎসক হওয়ার আগে একজন শিক্ষার্থী একজন মানুষ। যদি তাকে যোগ্য ও বিচক্ষণ মানুষ করে গড়ে তোলা যায়, তারা নিজেরাই নিজেদের যোগ্য ও বিচক্ষণ আইনজীবী বা চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তুলবে”।
১৪) জাতীয় শিক্ষানীতি চায় হায়ার এডুকেশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া (এইচইসিআই) নামে একটি নিয়ন্ত্রক আমলাতন্ত্র তৈরি করতে। ইউজিসি (ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন), এআইসিটিই (অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিকাল এডুকেশন), এনসিটিই (ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন), বিসিআই (বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া), এবং পিসিআই (ফার্মাসি কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া) ইত্যাদির মতো অপেক্ষাকৃত স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলির বদলে একমাত্র এই এইচইসিআই কাজ করবে। এই পথে শিক্ষার ফ্যাসিবাদী কেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হবে এবং এই বিপজ্জনক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে দেশি ও বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলির কাছে শিক্ষাক্ষেত্রকে একটি লাভজনক ব্যবসাক্ষেত্রে পরিণত করা হবে।
১৫) শিক্ষামূলক ও প্রশাসনিক সংস্থাগুলির বিলুপ্তি ও শিক্ষারীতির পুনর্বিন্যাস করবে এই শিক্ষানীতি। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্য হলো ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি আন্তর্জাতিক পণ্যে পরিণত করা। এর ফলে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির গণতান্ত্রিক কাঠামোর সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটবে, এবং শিক্ষার উপর সম্পূর্ণ আমলাতান্ত্রিক সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে, শিক্ষারীতির পুনর্বিন্যাসের ফলে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও আধুনিকতা প্রসারের প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটবে।
১৬) জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশে সারা পৃথিবীর সাথে সমস্তরে আসার নামে ১০০টি বিদেশি কলেজকে ভারতে নিজেদের ক্যাম্পাস খোলার অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে সম্পূর্ণ এফডিআই (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা সরাসরি বিদেশি লগ্নিকরণ) আসতে চলেছে। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, ইয়েল, এমআইটির মতো স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির এত দূরে ক্যাম্পাস খোলার কোনও গরজ নেই। কারণ মূল বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন। এভাবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলিকে এত সহজে এ দেশে ক্যাম্পাস খোলার অধিকার দেওয়ার ফলে শুধুমাত্র নিম্নমানের প্রতিষ্ঠানগুলিই ভারতে লগ্নি করবে ও সর্বোচ্চ লাভের লক্ষ্যে ভারতের জনগণের উপর বিপুল লুঠ চালাবে। আমাদের ইতিমধ্যেই এরকম সন্দেহজনক ব্যবসামূলক প্রতিষ্ঠানের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে, যারা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে তাদের হাতে মূল্যহীন একটি সার্টিফিকেট ধরিয়ে চম্পট দিয়েছে।
১৭) ভারতীয় শিক্ষা পরিষেবা (ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস) নামে একটি স্থায়ী আমলাতন্ত্র গঠনের পক্ষে জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশ হল, সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারদের জন্য সংরক্ষিত পদ থাকবে এবং একটি অ্যাপে’ অ্যাডভাইসরি বডি বা শীর্ষ উপদেষ্টা সংস্থা ‘রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়োগ’ গঠন করা হবে, যার শীর্ষে থাকবেন শিক্ষামন্ত্রী। এটি পরিচালনা করবেন শিক্ষামন্ত্রীর স্থায়ী সচিবেরা। এভাবে সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘আরএসএ’ নামে একটি কেন্দ্রীয় আমলাতান্ত্রিক সংস্থার অধীনে নিয়ে আসার ফলে শিক্ষার স্বায়ত্তশাসন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তা ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর’ পক্ষেও ক্ষতিকারক। এরকম সর্বশক্তিসম্পন্ন একটি সংস্থা ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে বাধ্য এবং এর ফলে আরএসএ হয়ে উঠবে শাসকদলের হাতের একটি ধারালো অস্ত্র, যার সাহায্যে তারা নিজেদের ভাবাদর্শ অনুযায়ী পাঠ্যসূচি তৈরির মাধ্যমে সারা দেশের শিশুদের চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।
১৮) ‘জ্ঞানমূলক অর্থনীতির’ ভেক ধরে, ভারতকে ‘জ্ঞান-বিজ্ঞানের পীঠস্থান’ রূপে তুলে ধরার চমকপ্রদ, স্লোগানসর্বস্ব কথার আড়ালে সরকারের উদ্দেশ্য দেশি-বিদেশি অর্থপিপাসু ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের কাছে এ দেশের বাজার খুলে দিয়ে তাদের অবাধ লুণ্ঠনের রাস্তা করে দেওয়া। ভারতে বর্তমানে অনধিক ২৬ বছর বয়স্ক শিশু-যুবকদের সংখ্যা ৬০ কোটি, যা শিক্ষা বিক্রি করার একটি অত্যন্ত লোভনীয় এবং সম্ভাবনাময় বাজার।
১৯) ‘অত্যাবশ্যক বিষয়, দক্ষতা, এবং ধারণাশক্তির সম্মিলিত পাঠক্রম’ অংশটিতে জাতীয় শিক্ষানীতি জোর দিয়েছে শিক্ষার ভারতীয়করণের ওপর। এতে বলা হয়েছে, ‘‘ভারতীয় জ্ঞান-এর মধ্যে থাকবে প্রাচীন ভারতের জ্ঞান ও আধুনিক ভারতে সেই জ্ঞানের অবদান এবং তার সাফল্য ও সমস্যা এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে ভারতের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য। বিদ্যালয় পাঠক্রমের যে কোনও অংশে, যেখানেই প্রাসঙ্গিক মনে হবে, সেখানেই এই উপাদানগুলি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিশেষত, ভারতের মূলনিবাসীদের জ্ঞানভাণ্ডার সমেত ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা, এবং দেশীয় ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষার ধারার অন্তর্ভুক্ত থাকবে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, যোগশাস্ত্র, স্থাপত্যবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, কৃষি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য, ক্রীড়া, এমনকি শাসনপ্রক্রিয়া, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সংরক্ষণ। সবকিছুর মধ্যেই মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা নিয়ে একটি চিত্তাকর্যক কোর্স ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হবে” (৪.২৭. জাতীয় শিক্ষানীতি চূড়ান্ত নথি)। নৈতিক বিচার, ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় নৈতিকতা এবং প্রাথমিক মানবিক ও সাংবিধানিক নৈতিকতা সমস্ত ছাত্রছাত্রীর মধ্যে বিকশিত করা হবে। শিশুদের পঞ্চতন্ত্র, জাতক, হিতোপদেশ এবং এরকম অন্যান্য উপকথার মূল গল্প, ভারতীয় ঐতিহ্যের উদ্দীপক গল্পগুলি ও পৃথিবীর সাহিত্যক্ষেত্রে তাদের প্রভাব সম্পর্কে জানার সুযোগ দেওয়া হবে।
বর্তমানের যে আধুনিক ভৌগোলিক সীমানাকে আমরা ভারত ভূখণ্ড হিসেবে জানি, সেই ভারতে প্রাচীনকালে গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, অস্ত্রোপচার, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল এবং বিশ্ব দরবারে তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান দেখা দিয়েছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে ভারতের সঙ্গে জ্ঞান ও চিন্তার আদানপ্রদান ঘটেছিল গ্রিস, মিশর, ব্যাবিলন (বর্তমান ইরাক), চীন দেশের সঙ্গে। জ্ঞানের ধারা ও প্রভাব বিস্তার ঘটেছিল দু’তরফেই। তাই আমাদের শিশুদের শুধু ভারতের অবদান ও তার প্রভাব সম্পর্কে জানালে তা নিতান্তই একপেশে জ্ঞান হয়ে যায়। জাতীয় শিক্ষানীতির নির্দেশিকা শুধুই প্রাচীন ভারতের অবদানের কথা বলে। এ হল শিশুদের অন্যান্য সভ্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখার হীন প্রচেষ্টা, যা শিশুদের চিন্তাশক্তির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করবে ও তাদের মধ্যে অন্ধতা ও ধর্মান্ধতার বীজ বপন করবে। আমাদের প্রাচীন অতীতের মিথ্যা মহত্ত্ব প্রচার পূর্বপুরুষদের প্রতি ও তাদের প্রকৃত অবদানের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়। অন্যদের অবদানকে ছোটো করে দেখানো অনৈতিকতা ও ধর্মান্ধতার পরিচায়ক। পাঠক্রমের এই ধারা গণতান্ত্রিক শিক্ষার মূলনীতির বিরোধী, যা মনে করে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও পরীক্ষিত তথ্যই পাঠক্রমের অংশ হওয়া উচিৎ। প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রকৃত অগ্রগতির দিকটি বাদ দিয়ে বিজেপি সরকার অন্ধতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন তার অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক দিকটিকেই তুলে ধরছে এবং তাকেই ঐতিহ্য বলে চালাতে চাইছে। জাতীয় শিক্ষানীতি সেই পুরনো বিচারধারা, প্রাচীন অনুন্নত বিজ্ঞান, গণিত, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা চালু করতে আগ্রহী। আধুনিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলিতে অবৈজ্ঞানিক ও অস্পষ্ট শিক্ষার এই ধারার অনুপ্রবেশ ঘটলে তা শুধুই অন্ধতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, মধ্যযুগীয় মানসিকতাকেই প্রশ্রয় দেবে মাত্র এবং আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানার্জনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এর ফলে রাজা রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জ্যোতিবারাও ফুলে সহ ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎদের দ্বারা প্রচারিত বৈজ্ঞানিক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার বিকাশ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যাবে। এটা পরিষ্কার যে জাতীয় শিক্ষানীতি কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দলের আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং তা আমাদের নবজাগরণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে।
২০) জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুযায়ী তারা স্থানীয় স্তরে স্কুল কমপ্লেক্স-এর মাধ্যমে কিছু শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে এবং বিএড-এর পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে একটি স্বল্প সময়ের সার্টিফিকেট কোর্স/ ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ কলেজ এবং স্কুলগুলোতে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সরকার স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে হাত গোটাতে চাইছে।
২১) জাতীয় শিক্ষানীতিতে তিন ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে– রিসার্চ ইউনিভার্সিটি, টিচিং ইউনিভার্সিটি এবং অ্যাকাডেমিক কলেজ। এই ব্যবস্থায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার অধীনস্থ কলেজগুলির যে শিক্ষাগত যোগাযোগ থাকে তা বিঘ্নিত হবে। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শাখাবিহীন কাণ্ডে এবং কলেজগুলি শিকড়বিহীন গাছে পরিণত হবে এবং শিক্ষার কেন্দ্রীকরণে এই নীতি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
২২) জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুযায়ী, একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত ক্রেডিটগুলি একটি ব্যাংকে জমা করে রাখতে পারবে, যাকে তারা বলছে একাডেমিক ব্যাংক অফ ক্রেডিট। এই দেউলিয়া নীতি শুধুমাত্র শিক্ষাকে ব্যবসায় পরিণত করার ক্ষেত্রে সহায়ক। এই ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জনে সহায়ক তো নয়ই, বরং একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে সুবিধাবাদী মনোভাবের জন্ম দেবে।
২৩) জাতীয় শিক্ষানীতির লক্ষ্য প্রসঙ্গে সরকার বলছে, এই শিক্ষানীতি ছাত্রদের মধ্যে মৌলিক কর্তব্যবোধ এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। শিক্ষক শিক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সমস্ত বিএড কোর্সগুলি মৌলিক কর্তব্যের চর্চায় জোর দেবে। কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতি কোথাও মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে একটি শব্দ খরচ করারও প্রয়োজন বোধ করেনি। যেখানে দেশের সরকারের উচিত শিক্ষক এবং ছাত্রদের নিজেদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সজাগ করা, যেখানে নীতিনির্ধারকদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হল, সরকার যাতে দেশের নাগরিকদের তাদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে, তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা, সেখানে আজকের ‘আত্মনির্ভর ভারতে’ মৌলিক অধিকারের প্রসঙ্গ জাতীয় শিক্ষানীতিতে সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
‘শক্তি ধরে যে তাকে সজাগ করো কর্তব্যে আজ
দুর্বলকে আজ জাগিয়ে তোল দিয়ে অধিকারের পাঠ,
তুমি জ্ঞানী তুমি সত্য, ইহাই তোমার কাজ …’
– বিশিষ্ট কবি সুব্রহ্মন্যভারতীর এই কথাগুলো কি আজ প্রাসঙ্গিক নয়?
২৪) জাতীয় শিক্ষানীতিতে জাতীয় গবেষণা সংস্থা এনআরএফ প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশ করা হয়েছে। ইউজিসি, ডিএসটি, আইসিএআর, আইসিএমআর, ডিবিটি, ডিএই ইত্যাদি সরকারি অর্থ সরবরাহকারী সংস্থাগুলোকে বন্ধ করে এনআরএফ প্রতিষ্ঠার দ্বারা আইআইটি, এনআইটি, জেএনইউ-এর মতো কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হবে। পাশাপাশি শিক্ষা-মাফিয়াদের দ্বারা পরিচালিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে ফুলেফেঁপে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় সংস্থার দ্বারা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান– সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে একই মানদণ্ডে দেখতে হবে এবং একইভাবে উৎসাহ জোগাতে হবে। গবেষণার ক্ষেত্রে অনুদানের প্রশ্নে তারা বলছে, ‘সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, সমাজসেবামূলক সংগঠনগুলিও ‘তাদের ইচ্ছে ও প্রয়োজনের পরিপূরক’ গবেষণাতে ‘ব্যক্তিগতভাবে’ অনুদান দিতে পারবে। শিল্পগোষ্ঠী বা বেসরকারি মালিক গোষ্ঠী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত অনুদান ব্যবস্থা সামাজিক প্রয়োজনে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে কেবলমাত্র প্রযুক্তিগত গবেষণাকে উৎসাহিত করবে, যা বাস্তবে মৌলিক গবেষণা ও সামাজিক সমস্যার মতো বিষয়ের উপর গবেষণার মৃত্যু ডেকে আনবে।
২৫) এই শিক্ষানীতি মেডিকেল শিক্ষা কোর্স, কারিকুলাম, পরীক্ষা পদ্ধতিতে যে সর্বাত্মক পরিবর্তনের প্রস্তাব এনেছে তা মেডিকেল শিক্ষাকে সামগ্রিকভাবে অবনমনের রাস্তার দিকে ঠেলে দেওয়ার পাশাপাশি এই শিক্ষায় বেসরকারিকরণের অবারিত দ্বার খুলে দেবে। শিক্ষানীতিতে ‘আয়ুষ’ নামে পাঁচটি পুরনো চিকিৎসা পদ্ধতিকে এমবিবিএস কোর্সে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই পাঁচটি চিকিৎসা পদ্ধতি হল আয়ুর্বেদ, যোগ, নেচারোপ্যাথি, সিদ্ধা ও হোমিওপ্যাথি। একজন এমবিবিএস ছাত্রকে চিকিৎসাশাস্ত্রের এতগুলি বিভাগ বা সিস্টেম অফ মেডিসিন অধ্যয়ন করতে বাধ্য করা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক। কারণ এগুলির প্রত্যেকটির পড়াশোনা এবং চিকিৎসা পদ্ধতি অন্যটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সরকারের যদি সত্যিই আয়ুষ বিভাগকে উন্নত করার সদিচ্ছা থাকে, তাহলে তাদের উচিত এতে ফান্ডিং বাড়িয়ে এ সংক্রান্ত গবেষণাকে উৎসাহিত করা। এর সাথে মেডিকেল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া বা এমসিআই-কে ভেঙে সরকার ইতিমধ্যেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন বা এনএমসি বিল এনেছে যা মেডিকেল শিক্ষার কেন্দ্রীকরণ ও আমলাতান্ত্রিক পরিচালনাকে আরও শক্তপোক্ত করবে।