গত ২৯ জুলাই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ক্যাবিনেট ২০১৯–এর খসডা জাতীয় শিক্ষানীতিকেই চালু করার কথা ঘোষণা করে৷ খসডা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সারা দেশ থেকে অসংখ্য প্রতিবাদ, সংশোধনী, পরামর্শ শিক্ষামন্ত্রকে পৌঁছালেও তার একটিও গ্রহণ না করে, জনমতের কোনও মূল্য না দিয়ে সম্পূর্ণ একতরফা ভাবে নরেন্দ্র মোদির সরকার এই সর্বনাশা শিক্ষানীতি গ্রহণ করল৷ এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ‘অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটি’ ৮ আগস্ট ‘অনলাইন প্রতিবাদ সভা’র আয়োজন করে৷ এই কর্মসূচিতে আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন প্রসারভারতীর প্রাক্তন সিইও জহর সরকার, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চ্যাটার্জী ও অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অনীশ রায়৷ এ ছাড়া বক্তব্য রাখেন পশ্চিমবাংলার শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা এবং অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটির সম্পাদক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর৷ প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রাক্তন উপাচার্য এবং অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী৷
জহর সরকার তাঁর বক্তব্যে বলেন, এই শিক্ষানীতি দেখে মনে হয় এটা একটা তুঘলকি কাণ্ডকারখানা৷ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বিচার বিবেচনা না করে কেন্দ্রীকরণের চেষ্টা৷ কেন্দ্র ক্রিয়েটিভিটির কথা বলছে, কিন্তু তারা একটা নির্দিষ্ট ফরম্যাট বা ছাঁচে ঢালা শিক্ষার দিকে ঠেলতে চাইছে৷ ভারতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে এই শিক্ষানীতি তৈরি করার নাম করে শিক্ষার গৈরিকীকরণের আকাঙক্ষা প্রকাশ পেয়েছে৷ শিক্ষানীতিতে এত বড় বড় কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তার জন্য আর্থিক সংস্থানের কোনও ব্যবস্থার উল্লেখ নেই৷ তিনি বলেন, ‘এটা একটা আদ্যোপান্ত আমলাতান্ত্রিক ডকুমেন্ট ছাড়া আর কিছু নয়’৷
বিমল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘আমি মুক্ত, স্বাধীন শিক্ষার পক্ষে৷ তাই এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে৷’ এই সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১৪ সাল থেকেই শিক্ষা সম্পর্কিত যে প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল সেখান থেকে মুক্ত মনের মানুষদের তাড়িয়ে নিজেদের লোক বসিয়েছে৷ সিবিএসই সিলেবাস থেকে যা যা বাদ দিয়েছে, তাতে গৈরিকীকরণের ঝোক স্পষ্ট৷ অতিমারিকে ঢাল করে শিক্ষার সিলেবাস থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও তার বৈচিত্র্য, গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার–এ সমস্ত অংশগুলো বাদ দেওয়া হচ্ছে৷ এই শিক্ষানীতি চালু হলে যাদের বিত্ত আছে তারাই কেবল শিক্ষা পাবে৷ যে ১০০টি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে এ দেশে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, সেখানে গরিব ছেলেমেয়েরা কোনও সুযোগ পাবে না, পড়বে আদানি, আম্বানির ছেলেমেয়েরা৷
অধ্যাপক অনীশ রায় বলেন, এই শিক্ষানীতি রচয়িতারা আধুনিক শিক্ষার জনক রামমোহন–বিদ্যাসাগরের নামটি পর্যন্ত কোথাও উল্লেখ করেননি৷ স্বাধীনতার পর থেকেই দেশে শিক্ষিত বেকার কমাতে সরকারগুলি শিক্ষা সংকোচন করে এসেছে৷ তার সাথে এখন শিক্ষাকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তাদের মুনাফার জন্য৷ সুসংহত শিক্ষা যাতে না হয়, তার জন্য এই শিক্ষানীতিতে ফিজিক্সের সাথে ফ্যাশন ডিজাইনিং, নবম–দ্বাদশে সেমেস্টার প্রথা আমদানি করা হচ্ছে৷ ক্লাস থ্রি, ফাইভ, এইটে পরীক্ষা নেওয়ার নীতিতে ড্রপআউট বাড়বে৷ টেন–টুয়েলভের পরীক্ষা একসাথে হওয়ার জন্যও ড্রপ–আউট বাডবে৷ এর সাথে শিক্ষার বৃত্তিমুখীকরণ করা হচ্ছে যা অত্যন্ত বিপজ্জনক৷
সভার সভাপতি অধ্যাপক চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী বলেন, সুসংহত শিক্ষা না দিয়ে এরা পদার্থবিদ্যার সঙ্গে নাচ, সংস্কৃত বা বাংলা বা যে কোনও বিষয় শেখানোকে holistic শিক্ষা বলেছেন৷ ক্লাস্টার স্কুল তৈরির মাধ্যমে স্কুল শিক্ষার সর্বনাশ করবে৷ তারা কোনও মডেল তৈরি ও এক্সপেরিমেন্ট না করেই, তার ফলাফল কী হবে তা না দেখেই প্রচলিত ব্যবস্থাটা পুরোটাই বাদ দিচ্ছে৷ এর ফল খুবই বিপর্যয়কর হতে পারে৷
কমিটির সম্পাদক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর বলেন, মূল্যবোধ ভিত্তিক শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে শিক্ষানীতিতে৷ মূল্যবোধ কারা দিতে পারে, যারা উন্নত মূল্যবোধের চর্চা করে তারা৷ তিনি এই সর্বনাশা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে ১৮ আগস্ট শিক্ষাপ্রেমী সকল মানুষকে সারা ভারত বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাল৷