৯ মে দিনটি ছিল মহান মানবতাবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। বিজেপি সরকারের আনা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র বিরুদ্ধে সেদিনই রাস্তায় নামলেন সারা দেশের শিক্ষাবিদরা। ওই দিন অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটির ডাকে নানা রাজ্য থেকে আগত শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী মানুষ সমবেত হয়েছিলেন দিল্লির যন্তর মন্তরে। বহু বাধা অতিক্রম করে দেশের সব প্রান্ত থেকে প্রতিনিধিরা ধরনাস্থলে পৌঁছান। সভা পরিচালনা করেন যৌথভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর, আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস এইচ তিলাগর এবং অধ্যক্ষা সারদা দীক্ষিত। অধ্যাপক নস্কর বলেন, এই ধরনায় মাত্র ২০০ জনকে জমায়েত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যন্তর মন্তরের এই জায়গায় দু’দিক দিয়ে পুলিশ গার্ডরেল দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। চতুর্দিকে প্রহরা। অথচ শিক্ষানীতি গ্রহণ করার সময় শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট কারও মতামত নেওয়ার কোনও চেষ্টা করেনি সরকার। এমনই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র আজ চলছে এই দেশে। ভারত একটা পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে।
শুরুতেই কমিটির সর্বভারতীয় সম্পাদক অধ্যাপক অনীশ রায় এই শিক্ষানীতির নানা বিপজ্জনক দিক উল্লেখ করে একে প্রতিহত করার আহ্বান জানান। তিনি কিসান আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে আন্দোলনকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন। জেএনইউ-র স্কুল অফ সোসাল সায়েন্সের অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ সিনহা বলেন, এই শিক্ষানীতি অভিজাত এবং ধনীদের স্বার্থে। এই শিক্ষানীতি চালু হলে শরহ-গ্রামের দরিদ্র মানুষ শিক্ষার সুযোগ হারাবে। তিনি প্রশ্ন করেন, যে শিক্ষা সরকার দেবে বলছে, তা কি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক হবে? এর বিপরীতে সরকার ধর্মভিত্তিক মধ্যযুগীয় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে।
শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মী জন দয়াল বলেন, এই শিক্ষানীতিতে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে তা দেশের ফেডারেল চিন্তার বিরোধী। শিক্ষাবিদ অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা উল্লেখ করে বলেন, ভারতবাসী যাতে গোটা বিশ্ব থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বনাগরিক হতে পারে তার জন্য তিনি বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হয় আধুনিক শিক্ষা অথবা ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে অন্ধতা– এ দুটোকে মেশানো যায় না। আমাদের ভাবতে হবে, শিক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা মানুষ তৈরি করতে চাই, নাকি হিন্দুত্ববাদী নাগরিক চাই? কর্নাটকের একটি কলেজের অধ্যক্ষ আলামপ্রভু বেত্রাদুরু শিক্ষার কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে বলেন। শিক্ষার বেসরকারিকরণের উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা বেসরকারি স্কুল খুললেই কোটিপতি হওয়া যায়।
মণিপুরের শিক্ষাবিদ প্রেম সিংয়ের মতে, এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করছে সরকার। সংস্কৃত জোর করে চাপানোর চেষ্টা করছে। মণিপুরের ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে। সরকার মতামত নেওয়ার নামে কীভাবে শিক্ষানুরাগী মহলের সাথে প্রতারণা করেছে তা তুলে ধরে শিক্ষাবিদ ডঃ মাইকেল উইলিয়ামস বলেন, মাত্র ৩০-৫০ দিন সময় দিয়েছে মতামত দেওয়ার জন্য। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য তারা ৬৩ ও ৬৬ পাতার দুটি ভিন্ন দলিল প্রকাশ করেছে। এই শিক্ষানীতি বানাতে যেভাবে বিদেশি নানা দলিলের কপি-পেস্ট করা হয়েছে তা লেখা চুরির তুল্য। তাঁর মতে এই শিক্ষানীতি চালু হলে গ্রাম-শহরের দরিদ্র ছাত্রছাত্রীরা আধুনিক শিক্ষা নিতে পারবে না। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিতেন্দ্র মিনার কথায়, প্রধানমন্ত্রী দেশ বেচে দিচ্ছেন, শিক্ষাকেও। এই নীতি শিক্ষার স্বাধিকার ধ্বংস করছে। শিক্ষায় গুজরাট মডেলের স্বরূপ তুলে ধরে সে রাজ্যের শিক্ষাবিদ কালু ভাই খারোদিয়া বলেন, শিক্ষানীতি যেমন কপি করে চালানো হচ্ছে, তেমনই গুজরাটের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষণা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কপি করে চালানো হচ্ছে। গুজরাটে যে কোনও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ার ফলে একজন স্কুল শিক্ষককে একই সাথে ৫টি ক্লাস সামলাতে হয়।
বেসরকারিকরণের ফলে শিক্ষা কীভাবে ব্যয়বহুল হওয়ায় সার্বজনীন শিক্ষা ব্যাহত হবে, তা তুলে ধরেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, এই শিক্ষানীতি বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাকে ব্যাহত করবে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম হবে। শিক্ষার স্বাধিকার ধ্বংস করার উদাহরণ হিসাবে জেএনইউ ও বিশ্বভারতীতে কেন্দ্রীয় সরকার যা করছে সেগুলি তুলে ধরে তিনি বলেন, বোঝা যায় এরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেমন করে চালাবে! শিক্ষাকে কর্পোরেট পুঁজিমালিকদের হাতে বেচে দেওয়ার জন্যই অর্ধেকের বেশি বাজেট ছাঁটাই করা হয়েছে। কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দেবাশিস রায় তাঁর ভাষণে সারা দেশে সেভ এডুকেশন আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সকলের কাছে আহ্বান জানান।