‘প্রগতিশীল’ ‘বৈপ্লবিক’ বুলির আড়ালে বিজেপি সরকারের নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি যে শিক্ষা ব্যবসার ব্লু-প্রিন্ট, তা এতদিন বলে আসছিলেন শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষাপ্রেমী জনগণ। এবার তাতে একেবারে সিলমোহর বসিয়ে দিল একটি চিঠি।
উচ্চশিক্ষার অনলাইন কোর্সের বৃহৎ কোম্পানি ‘আপগ্রাড’ সারা দেশের নানা কেন্দ্রীয় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে চিঠি লিখে অনলাইন শিক্ষা ব্যবসাকে যৌথ উদ্যোগে সম্প্রসারিত করার আহ্বান জানিয়েছে। কোম্পানির অন্যতম কর্তা রনি স্ক্রুয়ালা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ব্যবসায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন ‘শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলি আমাদের সাথে আপনাদের দৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলার রাস্তা করে দিয়েছে।’ তিনি লিখেছেন ‘আমাদের কোম্পানি এখন মুম্বাই ইউনিভার্সিটি, জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি, আইআইটি ম্যাড্রাস সহ ১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হিসাবে পূর্ণ সময়ের অনলাইন ডিগ্রি কোর্স চালু করার কাজ করছি। নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণার সাথে সাথে আপনাদের মতো প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অনলাইন কোর্স চালু করার মতো বৈপ্লবিক পরিবর্তনে আমরা প্রথম সারিতে থেকেছি। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন ইউজিসি আপনাদের মতো প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অনলাইন ডিগ্রি কোর্স চালু করার সুযোগ করে দিয়েছে।’
ফলে একটা জিনিস পরিষ্কার করোনা মহামারি জনিত পরিস্থিতিতে আর কোনও উপায় নেই, এই অজুহাতে কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষক-ছাত্র সরাসরি সম্পর্ক রহিত অনলাইন শিক্ষাকেই প্রধান করে তুলতে চাইছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যে বহু যুগ পরীক্ষিত সম্পর্ক ছাত্রকে সামগ্রিকভাবে শিখতে সাহায্য করে সেই বিষয়টাকেই অস্বীকার করছে সরকার। শিক্ষা মানে জ্ঞানার্জন, শিক্ষা মানে মানুষ হওয়া, চরিত্রবান হওয়া– জাতীয় শিক্ষানীতিতে অনেক বড় কথা বলা হলেও এইগুলিকে কার্যত অস্বীকার করে শিক্ষাকে করে তোলা হয়েছে নিছক কারিগর়ি দক্ষতা গড়ে তোলার ট্রেনিং।
অনলাইন শিক্ষার উপর জোর কি কেবল মাত্র করোনা মহামারিজনিত পরিস্থিতিতে জরুরি বলে ভেবেছে সরকার? আসলে ২০১৯ থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় শিক্ষানীতিতে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ছাত্রকে অনলাইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে। এর সলতে পাকানো শুরু ২০১৫-১৬ সাল থেকে। এই অনলাইন শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য সার্টিফিকেট বেচা। কে কী শিখল তা নিয়ে মাথা ব্যথার দরকার নেই। বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে গঠিত বিড়লা-আম্বানি কমিশন ২০০০ সালে মন্তব্য করেছিল, ‘এডুকেশন সেক্টর ইজ মাচ মোর প্রফিটেবল দ্যান ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড এগ্রিকালচার’। শিল্পে সর্বাত্মক সংকটের কারণে একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের এখন লক্ষ্য শিক্ষা এবং স্বাস্থে্যর মতো পরিষেবাগুলিকে করপোরেট ব্যবসার আওতায় আনা। এ জন্যই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাও এ দিকে মন দিয়েছে। এই শর্ত মেনে ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের শিক্ষা বিপণী নিয়ে অন্য দেশের বাজারে ঢুকতে গেলে, নিজের দেশের বাজারে বিদেশি শিক্ষা ব্যবসায়ীদের ঢোকার ছাড়পত্র দিতে হবে। সেই লক্ষে্যই সাজানো হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতিকে। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদির সাথে গুগল কোম্পানির সিইও সুন্দর পিচাইয়ের বৈঠকে ভারতের ডিজিটাল শিক্ষায় গুগল ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চেয়েছে। নিশ্চয়ই এই বিনিয়োগ গান্ধী আশ্রমের কম্বল বিলির জন্য হবে না! হবে অতি মুনাফার সন্ধানেই। শিক্ষার সংশ্লিষ্ট মহলের অভিজ্ঞতা হল অনলাইন শিক্ষা, দূরশিক্ষা বিক্রির একটা চক্র এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে তাকে ‘শিক্ষা মাফিয়া’ আখ্যা দেওয়া যায়।
ভারতের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে এই ডিজিটাল শিক্ষা এক নতুন বৈষম্যের জন্ম দেবে। দুই তৃতীয়াংশ ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষে এই শিক্ষা কেনার সামর্থ্য বহু দূরের কল্পনা। আর যারা কিনবে তারাও পাবে প্রাণহীন একটা শিক্ষার খোলস। যার় চকচকে মোড়কটুকুই আসল সম্বল। এ দিয়ে ছাত্রদের না হবে শিক্ষা, না হবে কারিগরী দক্ষতা। প্রকৃত শিক্ষার অভাবে মরবে মনুষ্যত্ব, মরবে জ্ঞান সাধনা। স্তব্ধ হবে চরিত্র গঠনের শিক্ষা।