২৫ জুন ‘সংবিধান হত্যা দিবস” পালন করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিজেপি। তার জন্য রাজ্যে রাজ্যে রীতিমতো সরকারি নির্দেশ পাঠিয়েছে তারা। ১৯৭৫-এর এই দিনটিতেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জারি করেছিলেন, ‘জরুরি অবস্থা’। এই ঘোষণায় স্থগিত হয়ে যায় সংবিধান প্রদত্ত সমস্ত মৌলিক অধিকার, নিষিদ্ধ হয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ, নিষিদ্ধ হয় সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা, গলা টিপে ধরা হয়বাক স্বাধীনতার, সংবাদমাধ্যমের উপর জারি হয় সেন্সরশিপ, প্রায় সমস্ত বিরোধী নেতা রাতারাতি গ্রেপ্তার হন। বিচারবিভাগ, সংসদ সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা খর্ব করে তাদের প্রশাসনের আজ্ঞাবহ করে তোলা হয়। জরুরি অবস্থার ২১ মাস ভারতের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত।
ঘোষিত এবং অঘোষিত জরুরি অবস্থা
২৫ জুন ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ পালনে বিজেপি নেতারা নিশ্চয়ই এই উপলক্ষে নানা ভাষণ দেবেন, অনুষ্ঠান করবেন। কংগ্রেস কত অগণতান্ত্রিক তার ফিরিস্তি দেবেন। কিন্তু কী উদ্দেশ্যে? ইন্দিরা গান্ধীর দল কংগ্রেস এবং নরেন্দ্র-মোদি অমিত শাহের দল বিজেপি– কে বড় গণতন্ত্র হত্যাকারী, তার তুলনার জন্য কি? বিজেপি কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষার শপথের কথা বলেনি, সংবিধান হত্যার প্রশ্ন তুলেছে। উল্লেখ্য যে সিপিএম-এর মতো বামপন্থী দলও এখন সংবিধান রক্ষার জন্য শপথ নিচ্ছেন। এর ভিত্তিতেই তাঁরা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু এ কথা কি ভোলা যায় যে, ইন্দিরা গান্ধী তাঁর যাবতীয় ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সংবিধানকে যথারীতি মাথায় করে রেখেই। আবার সংবিধানে মাথা ঠেকিয়ে, তাকে প্রণাম করতে করতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল দেশে গণতন্ত্র হত্যার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তা অঘোষিত জরুরি অবস্থা ছাড়া কিছু নয়। আজকের ভারতে শাসকের বিরুদ্ধে সোশাল মিডিয়ায় একটা পোস্ট, সংবাদমাধ্যমে একটা সরকার বিরোধী লেখা, এনআরসি-সিএএ-র মতো আইনের বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ সভায় অংশগ্রহণই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর কোনও সমালোচক ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত হলে তো সন্ত্রাস দমন আইন ‘ইউএপিএ’ এড়ানো তাঁর পক্ষে মুশকিল।
বিজেপি শাসনের দশ বছরে এ দেশে ১৩ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, ১৫৪ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছেন শুধু সংবাদ পরিবেশন করার কারণে। গত ৪ মে ‘আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দিবস’ উপলক্ষে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ লিখেছে, ভারতে কোনও মন্ত্রী সরাসরি বাকস্বাধীনতা হরণের নির্দেশ জারি করেননি ঠিক কথা, কিন্তু সাংবাদিকদের একটা ভয়ের বাতাবরণেই কাজ করে চলতে হয়। সেই কারণেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১-তে নেমেছে। বিজেপি আজ জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে ভাষণ দিচ্ছে, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোটে লড়তে তাদের এই প্রচার প্রয়োজন। অথচ, দু-জনের কাজের পার্থক্য কোথায়? কংগ্রেস সরকার সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখিয়ে দেশের মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল দানবীয় আইন ইউএপিএ। বিজেপি সরকার তাকে আরও মারাত্মক দমনমূলক করে তুলেছে। বিজেপি রাজত্বে ২০১৪ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ৮ হাজার ৭০০-র বেশি মামলা ইউএপিএ-তে রুজু করা হলেও তার মাত্র ২ শতাংশের ক্ষেত্রে কোনও ফয়সলা হতে পেরেছে। যা দেখিয়ে দেয় সন্ত্রাস দমন নয়, অপছন্দের ব্যক্তিকে জেলে ভরে রাখার জন্যই এই আইনকে কাজে লাগিয়ে চলেছে বিজেপি সরকার। কংগ্রেসের হাত ধরে ফ্যাসিবাদের যে ভিত ভারতে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল এ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি, সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে বিজেপি তাকে আরও দৃঢ় করছে।
প্রচার আছে যে, জরুরি অবস্থার সময় নাকি আরএসএস তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে এগিয়ে ছিল! কিন্তু ইতিহাস খুঁটিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে বিজেপির অভিভাবক আরএসএস জরুরি অবস্থার সময় নানা পর্যায়ে কার্যত ইন্দিরা গান্ধীকে সাহায্যই করেছে। একদল এখন বামপন্থার নাম করে ‘নয়া’ এবং ‘পুরাতন’ ফ্যাসিবাদী শাসনের পার্থক্য টেনে কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ভোটসঙ্গী খুঁজছেন। কিন্তু পার্থক্য কোথায়, যে তা খুঁজে পাওয়া যাবে।
সে দিনের প্রেক্ষাপট
কংগ্রেসের অপশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৬০-এর দশকের শেষ থেকেই রাজ্যে রাজ্যে বিক্ষোভ আন্দোলন মাথা তুলছিল। কংগ্রেস দ্রুত জনসমর্থন হারাচ্ছিল। ফলে, ১৯৭১-এ ইন্দিরা গান্ধী তথা কংগ্রেসকে লোকসভা এবং কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা ভোটে জিততে ব্যাপক রিগিং ও নির্লজ্জভাবে প্রশাসন যন্ত্রকে কাজে লাগাতে হয়। এর বিরুদ্ধে মামলা হলে ১৯৭৪-এর ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহনলাল সিনহা নির্বাচনে সরকারি ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেন। সে সময় সমাজবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে কংগ্রেসের অপশাসন ও দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন সারা দেশে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট সহ একাধিক রাজ্যে পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়েও ছাত্র-যুবরা আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন জরুরি অবস্থা জারি করে একদিকে এই আন্দোলনকে গলা টিপে মারতে, অন্যদিকে আদালতের রায়অগ্রাহ্য করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। সে দিন জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে কংগ্রেস বিরোধী আন্দোলনের পাশে একমাত্র এস ইউ সি আই (সি) ছাড়া অন্য কোনও বামপন্থী দল দাঁড়ায়নি। বামপন্থীরা সম্মিলিত ভাবে এই আন্দোলনে এলে আন্দোলনে বামপন্থী প্রভাব তৈরির সুযোগ তৈরি হতে পারত। কিন্তু সিপিএম-সিপিআই না আসায় সে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। এই শূন্যতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনসংঘ এবং আরএসএস সর্বভারতীয় স্তরে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা কিছুদিন ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে নানা গরম গরম স্লোগানও তোলে।
আরএসএস প্রধানের ইন্দিরা স্তুতি
ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থার শুরুতেই বহু সংগঠনের সাথে আরএসএসকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। প্রথমে আরএসএস-জনসংঘ এর বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহের ডাক দিলেও নেতা-কর্মীরা গ্রেপ্তার হওয়ার পরেই তাদের নেতারা পিছনের দরজা দিয়ে ইন্দিরা সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার ব্যবস্থা করতে থাকেন। ২৫ জুন মধ্য রাতেই অটল বিহারী বাজপেয়ী, মোরারজি দেশাই সহ অন্যান্য নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু সত্যটা হল, ওই একই সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া লোহিয়াপন্থী, সমাজবাদী, কিংবা বামপন্থী দলগুলির অনেক নেতা দীর্ঘ সময় কারাবাসে কাটালেও গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক দিন বাদেই বাজপেয়ীজি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে প্যারোলে ছাড়া পেয়ে যান। বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী তাঁর ‘দ্য আনলার্ন্টলেসনস অফ ইমার্জেন্সি’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, বাজপেয়ীজি প্রতিশ্রুতি দেন, মুক্তি পেলে তিনি কোনও রকম সরকার বিরোধিতা করবেন না। তিনি পরবর্তী ২০ মাস গৃহবন্দি থাকলেও তাঁর সাথে কারও দেখা করার ওপরেও কার্যত কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। স্বামী দেখিয়েছেন, ইন্দিরা গান্ধী ঠিক যেমনটা চেয়েছিলেন বাজপেয়ীজি সে সময় ঠিক সেই রকম আচরণই করেছেন (দ্য হিন্দু, ১৩.০৬.২০০০) ।
আরএসএসের তৎকালীন প্রধান বা সরসংঘচালক বালাসাহেব দেওরস গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিন তিনটি চিঠি লিখে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে কার্যত কাকুতি মিনতি করেছেন, আরএসএস-এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিন এবং আমায় ক্ষমা করুন। ১৯৭৫-এর ২২ আগস্ট, ১০ নভেম্বর এবং পরের বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি লেখা তিনটি চিঠির সবকটিতেই তিনি ইন্দিরা গান্ধীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। তিনি ইন্দিরাজির সঙ্গে দেখা করার অভিলাষও প্রকাশ করেছিলেন। কখনওই তিনি জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেননি। বরং তিনি লিখেছেন, নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে আরএসএসের লক্ষাধিক সদস্য সরকারের কাজে সাহায্য করতে প্রস্তুত। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ আচার্য বিনোবা ভাবেকে কাতর অনুরোধ জানিয়েছিলেন, আপনি ইন্দিরা গান্ধীকে বোঝান– আরএসএস ইন্দিরাজির পরিকল্পনায় এবং নেতৃত্বে দেশের অগ্রগতির কাজে অংশ নিতে প্রস্তুত। (হাউ আরএসএস বিট্রেড অ্যান্টি ইমার্জেন্সি স্ট্রাগল, সামসুল ইসলাম, ফ্রন্টিয়ার, ১৪.০৬.২০১৯ এবং দ্য ওয়্যার, শিবসুন্দর লিখিত প্রবন্ধ, ২৯.০৬.২০২৪)
‘মাফিনামা’
জরুরি অবস্থা জারির এক বছর পূর্তিতে ২৫ জুন ১৯৭৬ উত্তরপ্রদেশের জনসঙ্ঘ ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে জানায়, তারা আর ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করবে না। উল্লেখ্য যে, এই জনসঙ্ঘই ১৯৮০-তে নাম পাল্টে হয় বিজেপি। একাধিক লেখক এবং সাংবাদিক দেখিয়েছেন, আরএসএস কর্মীরা জেলে যাওয়ার পর থেকেই তাদের নেতৃত্ব বন্দি কর্মীদের জন্য তাঁরা ‘মাফিনামা” বা ক্ষমার আবেদন পেশ করার ব্যবস্থা করে দেন। বালাসাহেব দেওরসের সাথে পুণের ইয়েরাভাদা জেলে থাকা বাবা আদভ তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, একাধিকবার রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য জেলে ক্ষমার আবেদনের প্রোফর্মা বিলি করা হয়েছে। অন্য দলের নেতা-কর্মীরা বেশিরভাগই তা প্রত্যাখ্যান করলেও আরএসএস কর্মীরা সংগঠিতভাবে এই ‘মাফি নামা’য় সই করে সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে এক-দুই মাসের মধ্যেই জেলের বাইরে বেরিয়ে আসেন। জরুরি অবস্থার শেষ দিকে ১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে আরএসএস এবং ইন্দিরাজির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ চুক্তির ফলে বাকি সব আরএসএস কর্মীরই ‘মাফি নামা”-তে সই করার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও কিছু দিনের মধ্যই ইন্দিরাজি জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ায় তার আর দরকার হয়নি।
পরবর্তীকালে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্টে্র সরকারে থাকার সময় বিজেপি জরুরি অবস্থায় জেল বন্দিদের জন্য পেনশন চালু করেছে। যারা এক মাসের বেশি জেলে থেকেছেন, তাদের জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা, একমাস বা তার কম থাকলে ৫ হাজার টাকা। এক-দেড়মাস জেল-বাস করেই আরএসএস কর্মীরা সরকারি পেনশন ভোগ করে চলেছেন। যদিও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পেনশনের তালিকায় একজন আরএসএস কর্মীর নামও পাওয়া যাবে না, কারণ আরএসএস আগাগোড়া ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল। ইন্দিরা গান্ধীও আরএসএস নেতাদের প্রকৃত মনোভাব জানতেন। ১৯৭১-এ প্রবল কংগ্রেসী সন্ত্রাসে সারা দেশে সমস্ত বিরোধী দলের টুঁটি টিপে মারার সময়কালেও কংগ্রেস তথা ইন্দিরাজির অকুণ্ঠ প্রশংসায় সোচ্চার ছিলেন আরএসএস নেতারা। ইন্দিরা জমানার সবচেয়ে ঘৃণিত কাজগুলির একটি ছিল ইন্দিরা-সঞ্জয় গান্ধীর যৌথ পরিকল্পনায় ‘২০ দফা কর্মসূচি’-র নামে গরিব বস্তিবাসী মানুষ ও সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার চালানো। এর জন্য আরএসএস ইন্দিরা গান্ধীর প্রশংসা করেছিল। ১৯৭৪-এ আরএসএসের গুরুজি মাধবরাও সদাশিব গোলওয়ালকর এক চিঠিতে পারমাণবিক বিস্ফোরণের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর প্রচুর প্রশংসা করে বলেছিলেন, আপনার হাতেই সামরিক তাকতে শক্তিশালী ভারত তৈরি হচ্ছে। (এনডি টিভি, ১.০৮.২০২৩)
ইন্দিরাজি জানতেন, দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা কমছে। তিনি তাই হিন্দুত্বের তাস খেলতে চাইছিলেন হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে। এ জন্য আরএসএস- জনসংঘের থেকে বড় হিন্দুত্বের মুখ হয়ে ওঠার চেষ্টায় তিনি জনসমক্ষে তাদের় সাথে দূরত্ব বজায় রাখতেন। অন্য দিকে, জরুরি অবস্থার শেষ দিকে আরএসএস বোঝে, ইন্দিরাজি যেভাবে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, তাঁর পাশে আপাতত থাকা চলে না। তারা তখন পুঁজিপতিদের টাকায় জনতা পার্টি খাড়া করার কাজে হাত লাগায়। উল্লেখ্য যে, বামপন্থী দল সিপিএম-সিপিআই জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনে না থাকলেও আরএসএস-জনসংঘকে নিয়ে গড়া জনতা পার্টির সাথে একত্রে ভোটে ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী জোটে শামিল হয়। ১৯৭৭-এ লোকসভা ভোটে জনতা পার্টি কংগ্রেসকে হারিয়ে সরকারে বসে।
আবার ১৯৮০-তে জনতা পার্টির সরকার ভেঙে গেলে লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরাজির নেতৃত্বে কংগ্রেস (ই) বিপুল ভোটে জয়ী হয়। সাংবাদিক এবং লেখিকা নীরজা চৌধুরী তাঁর ‘হাউ প্রাইম মিনিস্টারস ডিসাইড’ বইতে ইন্দিরা গান্ধীর অতি বিশ্বাসভাজন অনিল বালির স্মৃতিচারণা তুলে ধরে দেখিয়েছেন, ইন্দিরাজি ঘনিষ্ঠ মহলে বারবার বলতেন, আরএসএস পাশে না থাকলে ১৯৮০-তে তিনি লোকসভায় ৩৫৩ আসনে কোনওমতেই জিততে পারতেন না। জরুরি অবস্থার আগে থেকেই ইন্দিরা গান্ধী বলতে শুরু করেছিলেন, এতদিন আমরা সংখ্যালঘুদের বাঁচিয়েছি, কিন্তু তারা আমাকে ভোট দেয়নি। এবার আমি সংখ্যাগুরুদের দেখব। অনিল বালি বলছেন, বালাসাহেব দেওরস মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী বহুৎ হিন্দু হ্যায়’। ওই সময় আরএসএস মনে করেছিল ইন্দিরা গান্ধীর হাতেই তাদের ভবিষ্যৎ বেশি সুরক্ষিত। সে জন্য ১৯৮০-র নির্বাচনে তারা ইন্দিরা গান্ধীকেই জেতাতে চেয়েছিল। (এনডি টিভি, ১.০৮.২০২৩)
আরএসএস-এর প্রচারিত ‘রাষ্ট্রবাদিতা’-র মূল কথা হল, শক্তিশালী রাষ্ট্র জনগণকে দমিয়ে রেখে দেশ চালাবে। শক্তিশালী দেশ বলতে তারা বোঝে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান দেশ। যেখানে দুর্বলকে পায়ের তলায় রাখবে সবল অংশ। জনগণের ইচ্ছা নয়, প্রাধান্য পাবে শাসকদের ইচ্ছাই। তাদের গুরু গোলওয়ালকর কল্পিত হিন্দু রাষ্টে্র সংখ্যালঘু অংশের মানুষের জন্য কোনও নাগরিক অধিকারও থাকবে না। নিম্নবর্ণের মানুষ থাকবে উচ্চবর্ণের পায়ের তলায়। এটা ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির একটা রূপ। ১৯৩৪-এ আরএসএস নেতা মুঞ্জে, হেডগেওয়ার ইত্যাদি নেতারা ফ্যাসিবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ার প্রস্তাব রেখেছিলেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চরম সংকটের দিনে পুঁজির শাসনকে শক্তপোক্ত রাখতে শাসক শ্রেণি ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছে। তারা জনগণকে বোঝায়, সমস্যা সমাধানের জন্য চাই প্রশাসনিক দৃঢ়তা–এই ধুয়ো তুলে একে একে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি কেড়ে নেয়। সংসদীয় গণতন্তে্রর ঠাটবাট বজায় রেখেই তার সমস্ত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রক্রিয়াকে শেষ করে দেয়। জনগণকে কোনও এক ‘মহা শক্তিশালী’ শাসকের অনুগামীতে পরিণত করার চেষ্টা করে। আজকের যুগে যারাই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সেবা করবে তারাই ফ্যাসিবাদের ধারক বাহক হতে বাধ্য। সে জন্য আজ সমস্ত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী রাষ্টে্র ফ্যাসিবাদ সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখা দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির ধারক বাহক হিসাবে আরএসএস যেমন পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে চলেছে, আবার স্বাধীন ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারের মধ্যে তারা বন্ধু খুঁজে পেয়েছিল। আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা হিসাবে বিজেপি আজ সেই ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারী রাস্তাই নিয়েছে। মনে রাখা দরকার, ফ্যাসিবাদ কোনও বিশেষ দল আনে না, ফ্যাসিবাদ আনে পুঁজিপতি শ্রেণি। তারা কোন দলকে সামনে রেখে কোন রূপে তা কায়েম করবে তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর।
কংগ্রেস এবং বিজেপি উভয়েই ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী মূল দুটি দল। তাদের যতটুকু বিরোধিতা তা ক্ষমতার মসনদের ভাগ নিয়ে। বিজেপি এখন জরুরি অবস্থার পঞ্চাশ বছরে কংগ্রেস বিরোধী স্লোগান তুলছে ভোটের বাজার গরম করার লক্ষে্য। কিন্তু জরুরি অবস্থার মতো স্বৈরাচারী ব্যবস্থার প্রতিবাদ করতে গেলে কোনও অজুহাতেই কংগ্রেস-বিজেপির মতো পুঁজিবাদের সেবক কোনও একটি দলকে অপরটির বিকল্প হিসাবে তুলে ধারা যায় না। জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে সামনে রেখে একমাত্র সঠিক রাস্তায় বাম-গণতান্ত্রিক গণআন্দোলনই সেই কর্তব্য সাধনে সক্ষম।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা ২৭ জুন – ৩ জুলাই ২০২৫ এ প্রকাশিত