রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একশো দিনের কাজ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এখন মানুষের মুখে মুখে। যারা এই প্রকল্পের হালচালের খবর এতটুকুও রাখেন, অভিযোগের সত্যতা নিয়ে অন্তত তাদের মনে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। যে প্রকল্পের বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই, তেমন প্রকল্প দেখিয়ে টাকা তোলা হচ্ছে, কিংবা যতজন কর্মী কাজে লেগেছে, তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় খাতায়-কলমে দেখানো হয়েছে, এমন ঘটনা ভুরি ভুরি প্রকাশ পাচ্ছে। কর্মীদের জবকার্ড জমা রেখে শুধু টিপছাপ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, জবকার্ড আছে অথচ কার্ডধারীর কোনও অস্তিত্ব নেই, এমন অভিযোগও বহু। স্বাভাবিক ভাবেই বরাদ্দ অর্থের এমন নয়ছয়ে দরিদ্র মানুষেরই ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। ন্যায্য প্রাপ্য থেকে তারা বঞ্চিত হন। স্বাভাবিক ভাবেই এই দুর্নীতি এখনই বন্ধ হওয়া দরকার।
কিন্তু বন্ধ করবে কে? রাজ্য সরকার শোনামাত্র উড়িয়ে দিচ্ছে এমন অভিযোগ। প্রকল্পটি কেন্দ্রীয় সরকারের। দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্ব এমন অবস্থায় তাদের উপরই এসে বর্তায়। দুর্নীতিগ্রস্ত অপরাধীদের শাস্তি এবং দুর্নীতির সুযোগ বন্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়াই এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম করণীয়। কিন্তু দুর্নীতি হচ্ছে বলে সারা রাজ্যেই প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া বা কাজ হয়ে যাওয়া প্রকল্পের টাকা আটকে রাখা কোনও দায়িত্বশীল সরকারের কাজ হতে পারে কি? যে কোনও বিবেচক মানুষ বলবেন, কোনও দায়িত্বশীল সরকার এমন কাজ করতে পারে না। কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ঠিক এই কাজটিই করছে।
বর্তমান অর্থবর্ষে (২০২২-’২৩) কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের কর্মসংস্থান যোজনায় পশ্চিমবঙ্গকে একটি পয়সাও দেয়নি। ফলে এ রাজ্যের হাজার হাজার গরিব মানুষ কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ এই প্রকল্পে ৭৫০৭ কোটি টাকা পেয়েছিল। এ বছর মোদি সরকারের বঞ্চনায় রাজ্যের হাজার হাজার গরিব মানুষ কার্যত অনাহারের সম্মুখীন। অভিযোগ তদন্ত করে তার ভিত্তিতে শাস্তি দ্রুত হওয়া দরকার। সে কাজে তৎপর না হয়ে টাকা আটকে রাখা কেন?
তাছাড়া এই অভিযোগ যাঁরা তুলছেন, সেই বিজেপি নেতারা আয়নায় নিজেদের মুখগুলি দেখেছেন কি? ৫ ডিসেম্বর মোদি সরকারের কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, উত্তরপ্রদেশে জব কার্ড বাতিল হয়েছে সবচেয়ে বেশি। উত্তরপ্রদেশ বিজেপি শাসিত রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের এই রাজ্যে ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৬৪টি জব কার্ড বাতিল হয়েছে। ওড়িশায় বাতিল হয়েছে ১ লক্ষ ১৪ হাজার, বিহারে প্রায় ৮০ হাজার, অসমে প্রায় ৮ হাজার। পশ্চিমবঙ্গে বাতিল হয়েছে ৫২৬৩টি। জব কার্ড দুর্নীতি যে সর্বভারতীয় চরিত্র নিয়েছে তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদির রাজ্য গুজরাটও রয়েছে। গুজরাটেও বাতিল হয়েছে প্রায় ৩৮০০টি কার্ড। কিন্তু তার জন্য কি এইসব রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী টাকা দেওয়া বন্ধ করেছেন?
দুর্নীতি নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের গলা ফাটানো প্রচার দেখে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, চালুনি কী ভাবে করবে ছুঁচের বিচার? কিন্তু ছুঁচ বা চালুনি যাই হোক, দুর্নীতির ছিদ্রপথ কেন এবং কীভাবে তার ব্যাস বাড়িয়েই চলেছে? ভুয়ো জব কার্ড করার সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মী এবং শাসকদলের প্রভাবশালীদের যোগসাজশ ছাড়া কি এটা ঘটতে পারে? ভুয়ো জব কার্ড বাতিল করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু এটাই কি যথেষ্ট? নাকি এর সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মী ও শাসকদলের হোমরা চোমরাদের চিহ্নিত করে তার ভিত্তিতে শাস্তি জরুরি? কতজনকে শাস্তি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী?
দুর্নীতির সূচকে কোন রাজ্য কোথায় অবস্থিত, কোন রাজ্যে দুর্নীতি বেশি, কোন রাজ্যে কম– তার পরিসংখ্যানগত মূল্য অবশ্যই আছে। কিন্তু গুরুতর প্রশ্নটি হল দুর্নীতি সর্বব্যাপক রূপ নিতে পারছে কী করে? বাস্তবে এর নেপথ্যে রয়েছে এক বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং তা থেকে উদ্ভূত মানসিকতা। এই মানসিকতা এমনকি দরিদ্র মানুষের ক্ষুধার অন্ন কেড়ে খেতেও দ্বিধা করে না, এই মনোভূমিতেই পল্লবিত হচ্ছে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ এবং তা আজ প্রায় সার্বজনীন চরিত্র অর্জন করে ফেলেছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি, ওড়িশায় বিজেডি, বা অন্য রাজ্যে যারাই ক্ষমতায় রয়েছে তারাপ্রত্যেকেই দুর্নীতির পাঁকে ডুবে। জব কার্ড দুর্নীতি তার একটা অংশ মাত্র। কেন্দ্র এবং রাজ্যের প্রতিটি শাসক দল দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ক্ষমতায় বসে দুর্নীতির উৎস পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যারা সেবা করছে তারা প্রত্যেকেই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। বিজেপি পুঁজিবাদের অন্যতম প্রধান সেবক। স্বাভাবিকভাবেই তার শাসিত রাজ্যে দুর্নীতির বহর যথেষ্ট বেশি। এই বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার কোন অধিকারে ১০০ দিনের কর্মসংস্থানের টাকা আটকায়? মানুষের দাবি– দরিদ্র, কর্মহীন মানুষের স্বার্থে তারা দুর্নীতির তদন্ত করে অভিযুক্তদের শাস্তি দিক এবং একই সঙ্গে বরাদ্দ টাকাও মঞ্জুর করুক।