ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী ধারার সংগ্রামী, এস ইউ সি আই (সি)-র প্রতিষ্ঠাতা শিবদাস ঘোষের জন্মশতবর্ষ চলছে। শিবদাস ঘোষ শুধু এ দেশেরই নন, বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আন্দোলনের নেতা। জীবনের সমস্ত দিক ঘিরে যে সমস্যা মানুষকে, সমাজকে প্রতি মুহূর্তে পিষ্ট করছে, তিনি তার সমাধানের বিজ্ঞানসম্মত পথ দেখিয়েছেন। প্রতিটি সমস্যায় উত্তরণের যথার্থ পথ দেখিয়ে তিনি শ্রমজীবী জনসাধারণের আদর্শগত নেতায় পরিণত হয়েছেন। জন্মশতবর্ষে তাঁর মূল্যবান শিক্ষাগুলি বারবার উচ্চারিত করা ও আত্মস্থ করা জরুরি। এই সংখ্যায় থাকছে স্বাধীনতা আন্দোলন ও তার নানা দুর্বলতা সম্পর্কে শিবদাস ঘোষের বিশ্লেষণ।
ব্রিটিশের অধীনতা থেকে ভারতের মুক্তি অর্জনকে শিবদাস ঘোষ বলেছেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন। কারণ শাসকের বদল ছাড়া এই স্বাধীনতা শোষিত জনগণকে আর কিছু দিতে পারেনি। স্বাধীনতার যে মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল তা এই পালা বদলের মধ্য দিয়ে হয়নি। কেন হয়নি, কোথায় কোথায় এর দুর্বলতা ছিল, তা নানা দিক থেকে ব্যাখ্যা করে শ্রমজীবী মানুষের সামনে কর্তব্য কী, তা নির্ধারণ করে গেছেন শিবদাস ঘোষ। ব্রিটিশের চলে যাওয়াকে একটা মৌলিক পরিবর্তন, বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন বলেছেন তিনি। ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব। সঠিকভাবে বলতে গেলে বুর্জোয়া বিপ্লব–যার নেতৃত্বে ছিলেন বুর্জোয়াদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি গান্ধীজি। আর এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণি।
এই স্বাধীনতা দেখতে দেখতে ৭৫টি বছর পার করে ফেলল। সম্প্রতি মহা সমারোহে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তী। বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা, ক্লাব, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন রাজ্য সরকার এই অনুষ্ঠান নানা ভাবে পালন করেছে। কেন্দ্রের সরকারে আসীন বিজেপি, যার আদর্শগত গুরু আরএসএস তাত্ত্বিকরা ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রামকে জাতীয়তাবাদ বলে মানতে চাননি, যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াইকে মনে করতেন আসল জাতীয়তাবাদ, তাঁরা আজ ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ আওয়াজ তুলে মহা আড়ম্বরে স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’ পালন করলেও সে কলঙ্ক ঢাকা পড়ছে না। বরং কেন্দ্রের সরকারে আসীন হয়ে বিজেপি যে ভাবে আজ মত প্রকাশের অধিকার, সমালোচনার অধিকারকে প্রতি মূহূর্তে হরণ করছে, এমনকী একটা ব্যাঙ্গাত্মক ছবি বা কার্টুন আঁকার মতো কার্যক্রমকে দেশদ্রোহিতা আখ্যা দিয়ে শিল্পীকে কারারুদ্ধ করছে, তাতে কার স্বাধীনতা, কার গণতন্ত্র প্রশ্নগুলিই মূর্ত হয়ে উঠছে।
কার স্বাধীনতা, শাসকের না শোষকের
সঠিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে স্বাধীনতা কার? ব্যক্তির না দেশের? ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যতিরেকে দেশের স্বাধীনতার মানেই বা কী? দেশ মানে তো শুধুমাত্র একটা কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া ভৌগোলিক এলাকা নয়, তার সাথে দেশের মানুষও। সেই মানুষের কতটুকু স্বাধীনতা আছে স্বাধীন ভারতে? স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আত্ম-জিজ্ঞাসা–আমরা অগণিত শহিদের আকাঙ্খিত স্বাধীনতা পেলাম কি?
এ বিষয়ে বিস্তারিত এবং সমৃদ্ধ আলোচনা রেখেছেন শিবদাস ঘোষ, যিনি তাঁর কৈশোরেই স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় আপসহীন বিপ্লবী ধারার অনুশীলন সমিতির এই বিপ্লবী ২৫বছরের যুবক। যে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে অগণিত যুবক ডিগ্রি, চাকরি, কেরিয়ার, ব্যক্তিজীবনে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সব কিছু বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তা ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। স্বাধীনতার নামে যা প্রাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে তা যে শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুবক তথা সাধারণ মানুষকে শোষণ থেকে মুক্তি দেবে না–ব্রিটিশের কারাগারে বন্দি অবস্থাতেই তিনি তা উপলব্ধি করেন। ১৯৪২-‘৪৫ এই তিন বছর কারারুদ্ধ ছিলেন তিনি। কারাগারে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের নিবিড় চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন এতবড় মহৎ স্বাধীনতা সংগ্রাম কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারল না শ্রমিক শ্রেণির হাতে নেতৃত্ব না থাকার জন্যই। তিনি গান্ধীজির সংগ্রাম, তাঁর ত্যাগ, সততা, নিষ্ঠা সব কিছু স্বীকার করে নিয়েও বললেন, চিন্তার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান অনুসরণ না করার ফলে গান্ধীজি ধরতেই পারলেন না দেশটা যে শ্রেণিবিভক্ত–শোষক-শোষিতে বিভক্ত। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের ফসল কুক্ষিগত করল ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণি এবং তারাই ক্ষমতাসীন হল। এই অবস্থায় দেশীয় পুঁজিপতিদের শোষণ-নির্যাতন থেকে জনগণের মুক্তি চাই, এটাই হয়ে ওঠে শ্রমজীবী মানুষের সামনে সংগ্রামের প্রধান ধারা। এই উপলব্ধি থেকেই শোষণ মুক্তির নতুন সংগ্রামের জন্য তার উপযোগী কমিউনিস্ট দল গঠন করতে জেলের ভিতরেই তীব্র আদর্শগত সংগ্রাম শুরু করেন তিনি। এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার ৮ মাস পরেই শোষণ মুক্তির দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) গঠন করেন।
স্বাধীনতার পরপরই সিপিআই যখন বলছে, ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়’, তখন শিবদাস ঘোষ তার সাথে একমত হতে পারেননি। বলেছেন, ‘‘স্বাধীনতা দেশে আসেনি–এ কথা আমরা বলতে চাইছি না, বা আমরা তা বিশ্বাসও করি না। আমরা মনে করি, দেশ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার ত্রুটি-বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা, দেশের শাসক গোষ্ঠীর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির প্রতি আনুগত্য ও নমনীয় মনোভাব, তাদের সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা নীতি, সামন্ততন্ত্রের সাথে আপসমুখী মনোভাব ও সর্বোপরি শাসনব্যবস্থাকে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে পরিচালনা– এ সব সত্ত্বেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, দেশ রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হয়েছে” (১৫ই আগস্টের স্বাধীনতা ও গণমুক্তির সমস্যা, শিবদাস ঘোষ নির্বাচিত রচনাবলি, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৩)।
পুঁজিপতিদের লক্ষ্য ছিল লুটের বাজার, শ্রমিক শ্রেণির ছিল মুক্তি
কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনে শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাই তো জনগণের লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য ছিল পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্থাৎ, শোষিত না হওয়ার স্বাধীনতা, জাতিগত অবদমনের শিকার না হওয়ার স্বাধীনতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকে মুক্তি, পুরুষের অধীনতা থেকে নারীর মুক্তি, মানুষ হিসাবে মাথা উঁচু করে মর্যাদা নিয়ে বাঁচার স্বাধীনতা– যাকে এক কথায় বলা হয় গণমুক্তি। তা আসেনি। তাই এই দিনটিকে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) পালন করে ‘গণমুক্তি সংকল্প দিবস’ হিসাবে। শিবদাস ঘোষ বলেছেন, ‘‘আমরা পার্টির তরফ থেকে স্বাধীনতা দিবসকে ‘গণমুক্তি সংকল্প দিবস’ হিসাবে পালন করে আসছি। …তার কারণ, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা অন্যতম লক্ষ্য জনসাধারণের সামনে ছিল স্বাধীনতা লাভ ও সর্বপ্রকার শোষণ থেকে মুক্তি অর্জন। সেই উদ্দেশ্য, সেই লক্ষ্য বর্তমান স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক কাঠামো জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের বুকের উপর চেপে বসেছে, তার দ্বারা পরিপূরিত তো হয়ইনি, উপরন্তু জনসাধারণের সে আশা-আকাঙ্খা রূপায়িত করার পথে তা আজ একটা প্রচণ্ড বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই বাধা হঠাতে না পারলে শোষণ থেকে জনসাধারণের মুক্তি অসম্ভব” (ওই, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৩-২৪)।
শোষণ মুক্তি বা গণমুক্তি কথাটিকে আরও ব্যাখ্যা কর়ে শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন– ‘‘জনসাধারণ স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল এই জন্য যে, ইংরেজকে না তাড়ালে এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না, যে সমাজে অন্যায়-অবিচার এবং পুঁজিবাদী জুলুম, ব্যবসাদারদের জুলুম, জমিদারদের জুলুম, ব্যুরোক্রেসির জুলুম– এই সমস্ত জুলুমের চিরতরে অবসান ঘটবে এবং যে সমাজে আমাদের সর্বাঙ্গীন মুক্তির সুযোগ, ব্যক্তির বিকাশের সমান সুযোগ, সমস্ত স্তরের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সুযোগ, জনগণের স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রাখার জন্য সব রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ, আর সর্বাত্মকভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী আর্থিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে সমাজের কল্যাণ অর্থাৎ, জনগণের অর্থে সামগ্রিক কল্যাণের দ্বার খুলে দেওয়া যাবে”। (ওই, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৩-২৪)। জনগণের সামনে স্বাধীনতার এই যে লক্ষ্য ছিল স্বাধীন পুঁজিবাদী ভারতে তা পূরণ তো হয়ইনি, বরং এই পুঁজিবাদ যত শক্তিশালী হচ্ছে, সংহত হচ্ছে এই সমস্ত সমস্যা আরও তীব্র হয়ে উঠছে।
স্বাধীনতার সুফল তা হলে পেল কারা? পেয়েছে ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণি। স্বাধীনতা সংগ্রামে শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, ছাত্রযুবক লড়লেও, প্রাণ দিলেও কোনও দেশীয় পুঁজিপতি এদের মতো করে আন্দোলনে ছিল না। তারা ছিল আন্দোলনের সমর্থক মাত্র। এই সংগ্রামে জনসাধারণের আকাঙ্খার সাথে এই মালিক শ্রেণির আকাঙ্খার সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। মালিক শ্রেণির একাংশ যে আন্দোলনে কখনও কখনও ফান্ড জোগাত, তার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে শিবদাস ঘোষ বলেছেন, ‘‘আমাদের দেশের এই তেতাল্লিশ কোটি লোক অধ্যুষিত যে লুটের বাজার, সেটি নিংড়ে নিয়ে তার পুরো রসটি নিয়ে যাচ্ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা, বিদেশি পুঁজিপতিরা। আর দেশীয় পুঁজিপতিরা ছিল তাদের ছোট হিস্যেদার। বিদেশি শাসনের জন্য এই বিরাট লুটের বাজারে ভারতবর্ষের পুঁজির অবাধ বিস্তার, শোষণ এবং লুণ্ঠনের বাজারটি তারা পাচ্ছিল না। তাই তাদের দরকার ছিল দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতাকে পাওয়া, শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রটি ব্রিটিশের হাত থেকে নেওয়া…” (ওই, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৭)। স্বাধীনতা বলতে পুঁজিপতি শ্রেণি এটিই বুঝেছিল। পুঁজিপতি শ্রেণির এই আকাঙ্খা পুরণ হয়েছে। তারা শোষণের স্বাধীনতা পেয়েছে। আর দেশের জনসাধারণ ব্রিটিশের শোষণের স্থলে দেশীয় পুঁজিপতিদের শোষণের মধ্যে পড়েছে। ১৫ আগস্টের স্বাধীনতা ব্রিটিশের কবল থেকে মানুষকে মুক্ত করলেও দেশীয় পুঁজিপতিদের শোষণের শৃঙ্খলে পুনরায় বন্দি করেছে। এখানেই বুর্জোয়া নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যর্থতার ছায়া।
ভারতে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট
এই ব্যর্থতা কি অনিবার্য ছিল? এরও উত্তর খুঁজেছেন শিবদাস ঘোষ। কী ভাবে ভারতে দেশাত্মবোধ গড়ে উঠল, জাতীয়তার উন্মেষ হল, সেই জাতীয়তার মধ্যে দুর্বলতার দিক কোথায় ছিল এবং কেন, তার ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনে কী ক্ষতিকর প্রভাব পড়ল, এ ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের কী ভূমিকা নেওয়া দরকার ছিল, তার নানা দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘‘ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই জানেন যে, পুঁজিবাদের বিকাশের পথেই সমস্ত আধুনিক জাতিগুলির (নেশনস) ও জাতীয় রাষ্ট্রগুলির (ন্যাশনাল স্টেটস) সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয় জাতীয়তার উন্মেষ ও বিকাশও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। আজ যাকে আমরা দেশাত্মবোধ বলছি, এরূপ দেশাত্মবোধের সৃষ্টি বেশি দিনের কথা নয়। অতীতের ভারতবর্ষে এরূপ দেশাত্মবোধ ছিল না। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তা সম্ভবও নয়। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে জাতীয় পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ না হলে এরূপ দেশাত্মবোধের সৃষ্টি হতে পারে না। ভারতবর্ষ সমস্ত উপজাতিগুলিকে (ন্যাশনালিটিস) মিলিয়ে একটা আধুনিক জাতি (নেশন) হিসাবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ঢুকেছে সারা দেশ জুড়ে একটি কেন্দ্রীয় ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পরে। এ সময় থেকেই একটি আধুনিক কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা পরিচালনার প্রয়োজনে সারা দেশ জুড়ে রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার বিস্তৃতি ঘটতে থাকে এবং তারই ফলে ধীরে ধীরে স্থানীয় গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন শুরু হয় এবং বিভিন্ন উপজাতীয় অর্থনীতিগুলিকে মিলিয়ে সারা দেশ জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাঠামো (ট্রেড অ্যান্ড কমার্স সিস্টেম) গড়ে উঠতে থাকে। এই পথেই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে একটি জাতীয় বাজারের সৃষ্টি হতে থাকে এবং জাতীয় পুঁজি জন্ম নেয়। আধুনিক যানবাহন ব্যবস্থার বিস্তৃতি লাভ, বিভিন্ন উপজাতীয় অর্থনীতির মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিনিময়, একটি জাতীয় বাজারের সৃষ্টি ও পুঁজিবাদের বিকাশ ভারতবর্ষে সমস্ত উপজাতিগুলির মধ্যে একটি সমস্বার্থবোধ এনে দেয়। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক এই সমস্বার্থবোধই গোটা ভারতবর্ষে একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে সমস্ত উপজাতিগুলিকে (ন্যাশনালিটিস) একসূত্রে বেঁধে ফেলল (ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও আমাদের কর্তব্য, রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৭-২৮৮)।
জাতীয় স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী এত বড় একটা জাতীয় ভাবাবেগ তৈরি হলেও কেন ভারতের জনগণ ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না, কেন স্বাধীন ভারতে এই সব বিভেদমূলক প্রবণতা রয়ে গেল, কেন আজও দলিত নিগ্রহ ঘটছে, তা গভীর বেদনার সাথে উপলব্ধি করেছেন শিবদাস ঘোষ। এর মূল কারণ যে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীজির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেসের হিন্দু ধর্মভিত্তিক আন্দোলন, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের প্রভাবাধীনে আন্দোলন, তা তিনি অনুভব করেছিলেন। তিনি বলেছেন, … ‘‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতের সমস্ত উপজাতিগুলি মিলে একটি আধুনিক জাতি গড়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া শুরু হল, গোড়া থেকেই তার মধ্যে কতগুলো দুর্বলতা থেকে গেল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে সামাজিক বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মসূচিকে মেলাতে সক্ষম না হওয়ার ফলে গোটা জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে কতগুলি দুর্বলতা থেকে গেল। জাতীয় আন্দোলনকে আমরা ধর্মীয় ভাবনাধারণা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করতে সমর্থ হইনি। তাই স্বাধীনতা লাভের পর রাজনীতিগত ভাবে আমরা একটি আধুনিক জাতি হিসাবে গড়ে উঠলেও ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও আচারকে ভিত্তি করে আমাদের দেশের জনসাধারণ বিচ্ছিন্ন ও আলাদা আলাদা সম্প্রদায় হিসেবেই থেকে গেল” (ওই, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৮)। তিনি আরও বলেছেন, ‘‘সামন্ততন্তে্রর সঙ্গে আপস করার ফলে ভারতীয় বুর্জোয়াদের দ্বারা সমাজের গণতন্ত্রীকরণের পক্ষে অবশ্যপ্রয়োজনীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কাজগুলি সম্পূর্ণ করা এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী উপজাতি এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের একীকরণের কাজ সম্পূর্ণ করা সম্ভব ছিল না এবং হয়ওনি। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনাকালে বিভিন্ন ভাষাভাষী এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ভারতীয় জনসাধারণ রাজনৈতিকভাবে একটি জাতিতে পরিণত হল বটে, কিন্তু জাতীয় বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে সামন্ততন্ত্র, সামন্ততান্ত্রিক অনৈক্য এবং ধর্মীয়বন্ধনের বিরুদ্ধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পূর্ণ করে সমাজের গণতন্ত্রীকরণের কাজ সম্পূর্ণভাবে অবহেলা করার দরুন ভারতীয় জনসাধারণ ধর্ম-বর্ণ-ভাষাগত কারণে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক সম্প্রদায় হিসেবেই টিকে রইল” (সাম্প্রদায়িক সমস্যা প্রসঙ্গে, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭৮)।
স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কুফল
‘‘এরূপ ঘটার প্রধান কারণ, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল ভারতবর্ষের জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি। ভারতবর্ষের পুঁজিবাদের বিকাশ ও জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সৃষ্টি এমন একটা সময়ে এল যখন বিশ্ব পুঁজিবাদ তার সমস্ত প্রগতিশীল চরিত্র হারিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদে পর্যবসিত হয়েছে। ভারতীয় জাতীয় পুঁজিবাদ তখন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হলেও ওই ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থারই অংশ বিশেষ। তাই পুঁজিবাদী বিপ্লবের যুগে পুঁজিবাদের যে বিপ্লবী চরিত্র ছিল, ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যুগে ভারতীয় পুঁজিবাদের সেই বিপ্লবী চরিত্র আর ছিল না। তাই ভারতের জাতীয় বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিলেও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শ্রেণির অংশ হিসাবে তাদের বিপ্লবী চরিত্র ছিল না, তারা মূলত হয়ে পড়েছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংস্কারপন্থী বিরুদ্ধবাদী (রিফরমিস্ট অপজিশন্যাল)। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে আমরা বুর্জোয়া মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী দু’টি ধারা দেখতে পাই। একটি সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের সাথে আপসমুখী এবং গোটা আন্দোলনে এইটিই মুখ্য ধারা ছিল। অপরটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের ধারা” (ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও আমাদের কর্তব্য, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৮-২৮৯)। আপসমুখী ধারার নেতৃত্বে ছিলেন গান্ধীজি। আপসহীন ধারার নেতৃত্বে ছিলেন নেতাজি। এর মধ্যে গান্ধীজির আপসমুখী ধারাটিই ছিল প্রবল।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামের কর্মসূচির মধ্যে কেন সামাজিক বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মসূচিকে মেলানো গেল না, তার আরেকটি কারণ, স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসের প্রাধান্য। আর তা কাটিয়ে ওঠা গেল না তথাকথিত কমিউনিস্ট দলটির ভ্রান্ত ভূমিকার জন্যই। শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন– ‘‘গোটা স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে জরাগ্রস্ত আপসমুখী মানবতাবাদী ভাবধারার প্রাধান্যের জন্যই রাজনৈতিক বিপ্লবের কর্মসূচির মধ্যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিপ্লবের কর্মসূচিকে আমরা যুক্ত করতে পারিনি। এটাই ছিল গোটা আন্দোলনের দুর্বলতার প্রধান দিক। রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে কার্যকরীভাবে এর বিশেষ বিরোধিতা করা সম্ভব না হলেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্র ও নজরুল, অবহেলায় পরিত্যক্ত ও ভূলুণ্ঠিত সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিপ্লবের ঝান্ডাটিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। নেতৃত্ব জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে (অর্থাৎ জাতীয় কংগ্রেসের হাতে) থাকার ফলে এ প্রচেষ্টা শেষপর্যন্ত পুরোপুরি সফল না হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের হাজার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতার মধ্যে মানবতাবাদী ভাবাদর্শের এইটিই ছিল বলিষ্ঠতার দিক। এই দুর্বলতা ও বলিষ্ঠতা– এই দু’টি দিক নিয়েই এ দেশের মানবতাবাদী ভাবাদর্শ ও মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে যে নতুন নৈতিকতার মান গড়ে উঠেছিল, সেটাই সেদিন সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সর্বপ্রকার গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কারণ বুর্জোয়া মানবতাবাদ সেদিন ছিল দেশের স্বাধীনতা ও সমাজপ্রগতির পরিপূরক। জাতীয় স্বাধীনতা লাভের পর বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম ও পুঁজিবাদ সংহত হওয়ার সাথে সাথে সেদিনকার প্রগতিশীল বুর্জোয়া মানবতাবাদী ভাবাদর্শ ও মূল্যবোধগুলি আজ শাসক শ্রেণির হাতে প্রিভিলেজে বা সুবিধায় পর্যবসিত হয়েছে। অর্থাৎ বুর্জোয়া মানবতাবাদী ভাবাদর্শ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ধারণা তার প্রগতির চরিত্র হারিয়ে আজ শ্রমিক ও শোষিত জনসাধারণের আন্দোলনকে দমন করা ও শোষিত শ্রেণির চেতনাকে বিপথগামী করার কাজে শোষক শ্রেণির হাতে মতাদর্শগত হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে” (ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও আমাদের কর্তব্য, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩০৮)। এই কারণেই জাতীয়তাবাদী আদর্শ আর সমাজের কল্যাণ করতে পারে না। এটা শোষক শ্রেণির আদর্শ। মানুষকে ঠকানোর আদর্শ। এর বিরুদ্ধেই যুবসমাজকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে তদানীন্তন কমিউনিস্ট পার্টির হঠকারী ভূমিকা
স্বাধীনতা আন্দোলনের এই দুর্বলতার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি আরও বললেন, ‘‘যদি আমাদের দেশের এই জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির বদলে শ্রমিক শ্রেণির হাতে থাকত তা হলে শুধু যে সাম্রাজ্যবাদীদের সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করা সম্ভবপর হত তাই নয়, উপরন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশকে অ-ধনতান্ত্রিক বিকাশের পথে নিয়ে যাওয়া এবং জাতিগত সাম্প্রদায়িক এবং বর্ণগত সমস্যারও চিরতরে সমাধান সম্ভব হত … কিন্তু ভারতবর্ষের বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতা ও কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী রাজনৈতিক দলটির সুবিধাবাদী রাজনীতি ও কখনও কখনও এমনকী মুক্তি আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার দরুনই এ দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব জাতীয় বুর্জোয়াদের হাতেই থেকে গেল” (সাম্প্রদায়িক সমস্যা প্রসঙ্গে, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭৭)।
বিষয়টিকে আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, ‘‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের যে সময়ে এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী এই পার্টিটির জন্ম হয়, সেই সময়ে কংগ্রেস আজকের মতো সরাসরি এবং পুরোপুরি বুর্জোয়া শ্রেণির পার্টিতে রূপান্তরিত হয়নি। কমিনটার্নের দলিলেও এ কথার স্বীকৃতি আছে। ভারতবর্ষের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিই তখন কংগ্রেসের মধ্যে ছিল। অর্থাৎ স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই সময়ে কংগ্রেসের চরিত্র ছিল অনেকটা প্ল্যাটফর্মের মতো। জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই সময়ে কংগ্রেসের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বকে বিচ্ছিন্ন করে তার ওপর় শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বারা কংগ্রেসকে একটি খাঁটি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণফ্রন্ট (অ্যান্টি ইম্পিরিয়ালিস্ট পিপলস ফ্রন্ট) হিসাবে রূপ দেওয়ার সম্ভাবনা তখন পুরোমাত্রায় বর্তমান ছিল এবং একটি বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণির দলের পক্ষে সে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ছিল অবশ্যকরণীয় কাজ। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী এই পার্টিটি (সিপিআই, যার মধ্যে সিপিআই (এম), সিপিআই (এম এল)-এর গ্রুপগুলি ছিল) তথাকথিত বি টি রণদিভে গ্রুপের নেতৃত্বে ১৯৩০ সালে চূড়ান্ত সংকীর্ণতাবাদী নীতি অনুসরণ করে কংগ্রেসের নেতৃত্বে গোটা স্বাধীনতা আন্দোলনটাকেই প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াদের আন্দোলন বলে আখ্যা দিলেন এবং তার থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখলেন। … এই ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি, যারা কংগ্রেসের মধ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের নেতৃত্বকে পাকাপোক্ত করতে সাহায্য করলেন” (কেন ভারতবর্ষের মাটিতে এসইউসিআই একমাত্র সাম্যবাদী দল, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২০)।
কেন সিপিআই স্বাধীনতা আন্দোলনে এরূপ হঠকারি লাইন নিল সে সম্পর্কে গভীর বিশ্লেষণ করে শিবদাস ঘোষ বলেছেন, এই ভুলের কারণ তারা কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করতে পারেনি। এই কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করার জন্য জীবনের সর্বদিক ব্যাপ্ত করে জাতীয়তাবাদী এবং সামন্তী ভাবনা-চিন্তা-সংস্কৃতির অবশেষের মূলোচ্ছেদ ঘটিয়ে কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করার জরুরি কঠিন কঠোর সংগ্রামটি তারা এড়িয়ে গেছেন। দ্বিতীয়ত, কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যা লেনিনীয় পদ্ধতি তাকে অনুসরণ করেননি। এ বিষয়ে শিবদাস ঘোষ বলেছেন, ‘‘এ দেশের কমিউস্টি পার্টি নামধারী দলটি গঠনের পিছনে এ দলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অনেকের এবং অনেক নেতা ও অসংখ্য কর্মীর গভীর নিষ্ঠা, সততা ও আত্মত্যাগের কথা আমি জানি এবং আমি তাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখেই দেখি। কিন্তু তাঁদের এত আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠা সত্ত্বেও গোড়া থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ না করার জন্য তাঁরা যে এ দলটিকে একটি মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী দল হিসাবে গড়েই তুলতে পারেননি, এ সত্যেকেও আমি কোনও মতেই অস্বীকার করতে পারি না” (ওই, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯১)।
তাহলে সিপিআই-সিপিএম কী ধরনের পার্টি? শিবদাস ঘোষের বিশ্লেষণ, ‘‘আমাদের বিচারে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি একটি সঠিক সাম্যবাদী দল নয়। এটি একটি ‘কমিউনিস্ট নামধারী পেটিবুর্জোয়া বামপন্থী সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি” (সময়ের আহ্বান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮২)। ভারতের কমিউনিস্ট নামধারী এই পার্টিটি হঠকারি লাইন নিয়ে যদি স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের নেতৃত্বকে পাকাপোক্ত করতে সাহায্য না করত, যদি তাদের নেতৃত্ব থেকে উৎখাত করে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে মার্ক্সবাদসম্মত ভূমিকা পালন করত, তবে চিনের মতো ভারতেও স্বাধীনতা আন্দোলনে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসানের পাশাপাশি দেশীয় পুঁজিপতিদের শোষণেরও অবসান ঘটত। কিন্তু তা ঘটল না আলোচিত ঘটনাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে। এই অবস্থায় শোষিত মানুষের করণীয় কী? শিবদাস ঘোষ ডাক দিলেন মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে হাতিয়ার করে পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের।
পুঁজিবাদ কী ভাবে আজ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে, নানা দিক থেকে দেখিয়ে পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনের আদর্শগত হাতিয়ার মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ভাণ্ডারকে তিনি আরও সমৃদ্ধ করেছেন। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের নানা রকম ত্রুটি চিহ্নিত করে সেগুলি কাটানোর মার্ক্সবাদী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দেখিয়েছেন। শুধু ভারতের শ্রমিকশ্রেণির কাছেই নয়, এই পথেই তিনি বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আন্দোলনের আদর্শগত নেতায় উন্নিত হয়েছেন। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে সংগ্রাম করতে গিয়ে এই আদর্শগত ভাণ্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে কোথায় তিনি অনন্য, জন্মশতবর্ষে চলছে তা উপলব্ধির নিবিড় সংগ্রাম।