‘‘এই যে জনসাধারণ বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির প্রভাবে টুকরো টুকরো হয়ে রয়েছে এবং বিশেষত যারা বিপ্লবী ছদ্মবেশ ধরে আছে, যাদের বেস পলিটিক্যাল লাইন বিপ্লবী নয়, দলের রাজনৈতিক চরিত্র বিপ্লবী নয়; যে বিশ্লেষণে আপনারা বুঝেছেন যে আলটিমেটলি তারা পিপলকে বিপ্লবে নিয়ে যেতে চায় না; পিপলের মধ্যে যে আউটবার্স্টটা আসে, লড়াইয়ের ফারভারটা আসে সেটাকে তারা ডাইভার্ট করে ইলেকশনে ফায়দা তুলতে চায়। প্রথম দিকে এইরকম ফোর্সগুলোর প্রভাব থাকে পিপলের কনসাসনেস না থাকার জন্য। সেইজন্য স্ট্যালিনের একটা বিখ্যাত উক্তি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। তিনি বলছেন– টু পুট অ্যান এন্ড টু ক্যাপিটালিজম, ইট ইজ নেসেসারি টু পুট অ্যান এন্ড টু সোস্যাল ডেমোক্রেটিজম। এ কথা কেন বলছেন? সোসাল ডেমোক্রেটিজমের কথা বলছেন কেন? ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেতনাটা মাসের মধ্যে যখন আসতে থাকে, যারা প্রো-ক্যাপিটালিস্ট পার্টি তাদের সম্পর্কে জনসাধারণের মোহ কাটাতে বেশি সময় লাগে না। বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেও সেটা কাটাতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু সবচেয়ে বিপদ হচ্ছে যারা অ্যান্টি ক্যাপিটালিস্ট বলে পোজ করে, লাল ঝান্ডা ওড়ায়, সোসাল ডেমোক্রেসির কথা বলে, কমিউনিজমের কথা বলে, ক্লাস স্ট্রাগলের কথা বলে, মজুরের কথা বলে, মালিকের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়; যেগুলো ফোর্স অফ কমপ্রোমাইজ, সুডো রেভলিউশনারি সোসাল ডেমোক্রেটিক ফোর্স, তাদের ডিফিট করতে না পারলে বিপ্লবী আন্দোলন এগিয়ে যেতে পারবে না। এই ফোর্সদের সম্পর্কে মোহমুক্তি না ঘটলে, এদের নেতৃত্বের প্রভাবের বাইরে মাসকে না নিয়ে আসতে পারলে, শ্রমিক-মজুরের রিয়েল পলিটিক্যাল পাওয়ার এবং কারেক্ট রেভলিউশনারি পার্টি গড়তে না পারলে যে বিপ্লব হবে না– এই কথাটা বোঝাতে না পারলে রেভলিউশন হয় না। সেইজন্য বলছে যতক্ষণ পর্যন্ত ইউ ক্যানট গিভ ডিফিট টু অল শেডস অফ সোস্যাল ডেমোক্রেটিজম, মিনিং সুডো রেভলিউশনিজম, ততক্ষণ পর্যন্ত বিপ্লবকে ফাইনালি জয়যুক্ত করা, কারেক্ট পলিটিক্যাল পার্টির লিডারশিপ এসট্যাবলিশ করা ইজ আনসায়েন্টিফিক ওয়ে অফ থিংকিং। আপনি কাজ করলেই হয় না। আপনার কাজের মধ্যে টার্ন অ্যান্ড টুইস্ট থাকে, সাকসেস এবং ফেলিওর থাকে। সংগ্রাম করা মানে তো আমরা সবসময় মাসের প্রবলেম সলভ করে দিতে পারি না। লড়াইগুলোতে কি আমরা সবসময় জিতি? না, বরং উল্টো হয়। বিপ্লবী দলের ওপর আক্রমণ মারাত্মক হয়। সেই আক্রমণের মুখে প্রথম প্রথম তাদের ফেলিওর হয়, কিন্তু বিপ্লবী দলের কর্মীরা এই ফেলিওরের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে, মাস ডিফারেনসিয়েট করে আন্দোলনের মধ্যে কে কীভাবে লড়ছে, কার স্লোগান কী রকম, কোন দলের কর্মীদের হালচাল কী রকম, এর প্রভাব পড়ে। তাৎক্ষণিক এর ফল না পেলেও, মনে রাখবেন এর মধ্য দিয়ে আপনার শক্তি বাড়ে, ক্ষমতা বাড়ে।
আপনাদের আর একটা কথা এখন বলতে চাই। আমাদের দলটা শুরু থেকে একটা বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে আসছে, সেটা হচ্ছে, বিল্ডিং আপ অফ রেভলিউশনারি ক্যারেক্টার। কমিউনিস্টদের কাছে সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান কর্তব্য হল বিপ্লবী চরিত্র বিল্ড আপ করা। কারণ আমাদের দল গঠনের যা ভিত্তি, যে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই নতুন দলটির অভ্যুত্থান; বিশেষ করে এ দেশে এই দলটা গড়তে গিয়ে আমরা কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। তখন যে মানুষ অনেস্টি ও ফাইট করার আকাঙ্খা নিয়ে, যাকে সাধারণ মানুষের অর্থে বা বুর্জোয়া অর্থেও ত্যাগ স্বীকার বলি, অর্থাৎ বিপ্লবের জন্য, আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা, সেইরকম প্রথম অবস্থায় ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ার পিছনে বা সিপিআই দল গড়ার পিছনে বহু কর্মীর বহু অবদান ছিল। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর আরসিপিআই গড়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁর পিছনেও অনেক ভাল ছেলের, ভাল ভাল লোকের ঐ অর্থে যাকে আত্মত্যাগ এবং অবদান বলি সে সব যথেষ্ট ছিল। এমএন রায়ের মতো মানুষ, জ্ঞানে ও বিদ্যাবুদ্ধিতে সেই যুগে ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর সমকক্ষ আমি কাউকে দেখতে পাইনি। বাকি সব তো পিগমি। যারা এখন রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা কংগ্রেসই হোন বা বামপন্থীই হোন, অন্য যেকোনও দলেরই হোক সকলেই সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত(!)। লোক ক্ষেপানো আর চালাকির কথা বলা ছাড়া আর তারা কী করছে? হ্যাঁ, করছে কী ভাবে কায়দা করে, ডিপ্লোমেসি, চালাকি আর চটুলতা করে চলা যায়। যেগুলোকে আমরা দুষ্ট রাজনীতি বলি। তাদের জ্ঞান, বিদ্যা-বুদ্ধি, উইসডম বা কোনও শাস্ত্র সম্বন্ধে ধারণা তথৈবচ, একদম নেই বললেই চলে। কিন্তু পুরনো দিনে অন্যান্য অনেক নেতাই ছিল, যাদের আজকের নেতাদের মত শুধু চালাকির দ্বারা রাজনীতি করাটা ছিল না। মানুষ হিসাবেও তাদের চরিত্রের একটা ভিত ছিল। বুর্জোয়া রাজনীতিই হোক বা বিরোধী রাজনীতিই হোক, তাদের শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধি একটা বেশ উচু স্তরে ছিল। আপসমুখী কংগ্রেসী রাজনীতি বা বিরুদ্ধ পক্ষ আপসহীন বুর্জোয়া রাজনীতিতেও বড় বড় মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। আর এম এন রায় ওয়াজ অ্যান এক্সসেপশন, তিনি সত্যিই পণ্ডিত লোক ছিলেন। তিনি জ্ঞানবিজ্ঞানের সমস্ত শাখায় প্রবেশ করেছেন, গভীর পাণ্ডিত্য তাঁর ছিল। আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের অনেক অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। এই রকম একজন মানুষ পার্টি গঠন করার চেষ্টা করেছেন।
ভারতবর্ষের ইন্টেলেকচুয়ালরা, এক সময় জহরলালের মতো ইন্টেলেকচুয়াল তাঁর দিকে প্রবলভাবে অ্যাট্রাকটেড হয়েছিলেন। এ সব অতীত দিনের কথা, অনেকেই এ সব খবর রাখেন না। তিনিও এ দেশে কোনও দল খাড়া করতে পারলেন না। যে দল খাড়া করলেন সেটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। শুধু তাই নয়, সেই দলের বেশিরভাগ লোকগুলো হয় সিআইএ’র এজেন্ট, নাহয় কেরিয়ার সিকার, না হয় এখানে ওখানে চাকরি করছে, এরা সব শুডো ইন্টেলেকচুয়াল হয়ে গেল। তারা কেউই রেভলিউশনারি হয়নি। অথচ তিনি অতবড় একজন ইন্টেলেকচুয়াল ছিলেন এবং তাঁর লাইফ একটা সময়ে রেভলিউশনারির মতই ছিল। ভারতবর্ষ থেকে পালিয়ে যাওয়া ফাঁসির আসামী এবং তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একটা ইমপর্ট্যান্ট পজিশনে ছিলেন। কিন্তু তাঁর হাত দিয়ে একজনও বড় মাপের রেভলিউশনারি তো দূরের কথা একজন সাধারণ রেভলিউশনারিও তৈরি হয়নি। অন্তত আমি তা দেখতে পাইনি। বরং দেখেছি ইগো সেন্ট্রিক, ফুল অফ ভ্যানিটিওয়ালা লোক তৈরি হয়েছে। আর কিছু পড়ুয়া পণ্ডিত এবং ব্যক্তিবাদের ঝোঁক সম্পন্ন সেলফিস টাইপের কতগুলো মানুষ তৈরি হয়েছে। এটা আমাকে অদ্ভূতভাবে ভাবিয়েছে যে–কমিউনিস্ট পার্টিটাকে গঠন করার জন্য কত ছেলেমেয়ে বাড়িঘর সর্বস্ব ত্যাগ করে, বাপ-মাকে কাঁদিয়ে এসে সবকিছু করার জন্য লাইফ দিয়ে পার্টিটাকে গড়বার চেষ্টা করল। অথচ আমরা দেখতে পেলাম পরবর্তী সময়ে সেই লোকগুলোই চরম সুবিধাবাদী হয়ে গেল, যাদের লাইফে কোনও প্রিন্সিপল নেই, ডিক্টাম নেই, ডেকোরাম নেই, নির্ধারিত নীতি নেই। এইগুলো আমাদের খুব ভাবিয়েছে এবং একটা জিনিস শুরু থেকেই আমাদের মাথায় ধাক্কা দিয়েছে, যদি সত্যি সত্যিই একটা বড় আদর্শ গ্রহণ করা হয়, তার ডেলিভারির ভেহিকেলটা কী হবে। যদি সত্যিই খুব বড় একটা আদর্শ হয়, কিন্তু সেটার ভেহিকেলটা যদি সঠিক না হয়, তাকে কংক্রিট সিচুয়েশনে ট্রান্সলেট করা, বাস্তবে রূপ দেওয়া এবং কার্যকরী করার জন্য ঠিক উপযুক্ত চরিত্র সম্পন্ন মানুষগুলো তৈরি না হয়; সেই বিপ্লবের উপযোগী চরিত্র, ক্যারেক্টার, ডিটারমিনেশনের দিক থেকে এবং আউটলুক ও কনসেপশনের দিক থেকে যদি সেইরকম ভাবে মানুষগুলো গড়ে না ওঠে, সকল কর্মী না হলেও অন্তত নেতৃত্বদানকারী কর্মীরা, নেতৃত্বের মধ্যে সকল নেতা না হোক অন্তত ন্যূনতম মেজরিটি–যদি তেমন ধরনের চরিত্রের আধার, কমিউনিস্ট চরিত্রের আধার নিয়ে এবং জীবনে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রয়োগ করে কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জন না করে, তা হলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ আলটিমেটলি এই চরিত্র গড়ে না তুলতে পারলে, বিপ্লবের উপযোগী করে চরিত্রটা গড়ে তুলতে না পারলে, যে মহৎ আদর্শটা যুক্তি দিয়ে গ্রহণ করেছিলাম, তা রক্ত-মাংস ও রসের সাথে ভিতরে গিয়ে ঢোকে না। সেটা ওপরে বলার জন্য ওপর ওপর থেকে যায়। সেটা বড় বিপ্লবী আদর্শের যেটা প্রাণসত্তা বা মর্মবস্তু, তাকে ধ্বংস করে দেয়। এই কথাটা আমাদের খুব ভাবিয়েছিল।
তাই আমরা এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে বুঝেছিলাম, একটা বড় বিপ্লবী দল গড়ার জন্য শুধু একটা আদর্শ, রাস্তা, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ঠিক হলেও চলবে না। সেই রাস্তায় পদক্ষেপের জন্য একটা সর্বাত্মক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এথিক্যাল, মরাল সমস্ত দিক থেকে মুভমেন্ট শুরু করা দরকার। শুধু রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বক্তব্যটা শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী হবে, আর শিক্ষা সম্বন্ধে যখন বলতে যাব তখন শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি নেই বা ভালবাসা সম্বন্ধে যখন বলতে যাব তখন শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি থাকবে না, পারিবারিক সম্পর্ক, স্নেহ, মমতা, ভালবাসা সম্বন্ধে যখন বলতে যাব, যৌনতা সম্বন্ধে যখন কোনও প্রবলেম সামনে আসবে তখন তা শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করছি না, নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধ, বন্ধুত্ব, কোনও ইমোশনলান ফ্যাক্টর, এগুলোর সামনে যখন পড়ছি তখন তাকে বিচার করার সময় শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি আমার কাজ করে না, তা হলে আর যাই হোক বিপ্লবী দল গড়ে ওঠে না। এগুলো সবই তো শ্রেণি সংগ্রামের ইমপ্যাক্ট। অর্থাৎ শ্রেণিভাবধারার দ্বারা যে এগুলো প্রভাবিত, শ্রেণিসম্পর্কের দ্বারা যে এগুলো প্রভাবিত, তা এসব বিষয়ে কাজ করে না কি? এরকম যদি হয় মার্কসবাদটা যদি শুধু বত্তৃতায় এবং আন্দোলন বা লোক ক্ষেপাবার জন্য আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমি রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে বা বার্নার্ড শ’র ফলোয়ার হতে পারি–তা হলেও তাদের দিয়ে বিপ্লব হয় না। বিপ্লবী আন্দোলন মাঝপথে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। আমি বুঝেছি পরিষ্কার ভাষায় না বললেও রেভলিউশনারি থিওরি বলতে লেনিন কখনও পলিটিক্যাল, ইকনমিক থিওরি আর স্টেজ অফ রেভলিউশনটা ঠিক করা বোঝাননি। ফলে সোসালিস্ট মুভমেন্টটা কভারিং অল অ্যাসপেক্টস অফ লাইফ রিলিজ করতে হবে। আমরা সেইজন্যই মরালিটি, এথিক্স এবং ক্যারেক্টার বিল্ডিং-এর দিকে এত জোর দিয়েছি।” (‘বিপ্লবী জীবনই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাময়’ বই থেকে)