সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে তৈরি ন্যাশনাল হেলথ প্রোফাইলের প্রকাশিত একটি রিপোর্ট দেখে দেশবাসীর ভিরমি খাওয়ার উপক্রম৷গত ১৯ জুন বিজেপির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জে পি নাড্ডা রিপোর্ট পেশ করতে গিয়ে বলেছেন, ১৩০ কোটি ভারতবাসীর জন্য রয়েছেন ১০ লক্ষ অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক, অর্থাৎ প্রতি ১১,০৮২ জন রোগীর জন্য এক জন চিকিৎসক৷ দাঁতের চিকিৎসার চিত্রটা আরও ভয়াবহ৷ ১,৭৬,০০৪ জনের জন্য একজন দন্ত চিকিৎসক৷ ৫৫, ৫৯১ জন ভারতীয়ের জন্য বরাদ্দ একটি সরকারি হাসপাতাল, ১, ৮৪৪ জন পিছু বরাদ্দ সরকারি হাসপাতালের একটি মাত্র বেড (এই সময়, ২৪.০৬.’১৮)৷
ভারতে এক–তৃতীয়াংশ শিশু জন্মগ্রহণ করে কম ওজন নিয়ে৷ ফিরে আসছে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া কালাজ্বরের মতো মারাত্মক রোগ৷‘অজানা জ্বর’, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, নিপা ভাইরাস যখন তখন কেড়ে নিচ্ছে বহু তাজা প্রাণ৷ বিজ্ঞান ও সভ্যতার এত অগ্রগতি সত্ত্বেও জটিল অসুখ তো অনেক দূরের কথা, জ্বরের কারণও বহু ক্ষেত্রে নির্ণয় করা যাচ্ছে না৷ লোকসংখ্যা বাড়লেও আনুপাতিক হারে বেড না বাড়ার ফলে দিনের পর দিন নানা হাসপাতালে ঘুরে ‘বেড নেই’ শুনতে শুনতে বিষণ্ণ মুখে বাড়ি ফেরাই এখন সরকারি চিকিৎসার মডেল৷ আর যাঁদের কপালে কোনও ক্রমে শিকে ছেঁড়ে তাঁদের একাধিক রোগীকে একটা বেডে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে হয়, কিংবা রোগীকে হাসপাতালের মেঝেতে রাখা হয়৷ এ ছাড়াও ফ্রি–বেড কমেছে, ওষুধ ও পথ্য রোগীর জন্য যতটুকু বরাদ্দ ছিল তাও বন্ধ হওয়ার মুখে৷
সরকারি হাসপাতালে পরিকাঠামোর অভাবে মানুষের হয়রানির অন্ত নেই৷ আউটডোরে টিকিটের লম্বা লাইন, কোনও পরীক্ষার ডেট পেতে কখনও ২–৩ মাসেরও বেশি সময় লাগে৷ ততদিনে রোগী হয় মারা গেছেন, নয়তো ঘটি–বাটি বিক্রি করে নার্সিংহোমের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছেন৷ ছোট–বড় সমস্ত সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মুমূর্ষু রোগীর জন্য বেড নেই, রক্ত নেই, এক্স–রে প্লেট নেই, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার সরঞ্জাম নেই, কাজ করার লোক নেই, ডাক্তার নেই, ডাক্তার থাকলে নার্স নেই, নার্স থাকলে অন্য স্বাস্থ্যকর্মী নেই– জনগণ যেন এক নেই রাজ্যের বাসিন্দা৷ তবে ওয়ার্ডে কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর এমনকী বিষধর সাপের অভাব নেই৷ তার উপর হাসপাতাল জুড়ে ক্ষমতাসীন শাসক দলের মদতে চলে দালাল রাজ৷ সেখানে অবশ্য চুরি, দুর্নীতি, অপচয় এবং স্বজন–পোষণের অভাব নেই৷ হাসপাতাল চত্বরে মদ, গাঁজা, সাট্টা, চরস, জুয়ার অবাধ কারবার চলে৷
জনসাধারণের স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করার বহু বিষয়ের মধ্যে সর্বপ্রথম আসে রাষ্ট্রের তরফে আর্থিক অনুদানের প্রশ্ণ৷ দেশে স্বাধীনতার পরেই গঠিত মুদালিয়র কমিশন কেন্দ্রীয় বাজেটের ১০ শতাংশ স্বাস্থ্য পরিষেবায় ব্যয় করার সুপারিশ করেছিল৷ কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিতে ক্ষমতাসীন সরকারগুলি ‘গরিব দেশ’ এবং ‘টাকার অভাব’ এই চিরাচারিত বুলি আওড়ে স্বাস্থ্যখাতে ক্রমাগত ব্যয়–বরাদ্দ কমিয়েছে৷ কেন্দ্রের বর্তমান বিজেপি সরকার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে জিডিপি–র মাত্র ১.০২ শতাংশ৷ বিজেপি–র কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জে পি নাড্ডা ১৯ জুন এক রিপোর্ট পেশ করতে গিয়ে স্বীকার করেছেন, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ভারতের ব্যয় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম৷ বিশ্বের নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত শ্রীলঙ্কা ব্যয় করে ভারতের তুলনায় মাথা পিছু চারগুণ বেশি, সেখানে ভারত প্রতি বছর মাথাপিছু ব্যয় করে ১,১১২ টাকা৷ অর্থাৎ প্রতিদিন ৩ টাকা, কী বিচিত্র এই দেশ৷ এক কাপ চায়ের দামও এর থেকে বেশি৷ ইন্দোনেশিয়া ব্যয় করে ভারতের দ্বিগুণ৷ স্বাস্থ্যখাতে মালদ্বীপ জিডিপি–র ৯.৪ শতাংশ, ভূটান ২.৫ শতাংশ এবং থাইল্যান্ড ২.৯ শতাংশ ব্যয় করে৷
দেশের এই করুণ স্বাস্থ্যচিত্রের কারণ কি সত্যই টাকার অভাব? দেশে সত্যিই টাকার অভাব হলে অস্ত্রের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতবর্ষ সবচেয়ে বড় ক্রেতা হয় কী করে? কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরের নানা আর্থিক দুর্নীতিতে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে৷ নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিজয় মাল্য সহ দেশের বড় বড় শিল্পপতিদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব এবং কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে, এমএলএ–এমপি–দের বেতন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে৷ এসব কি দেশে টাকার অভাবের লক্ষণ!
জনসাধারণের স্বাস্থ্যের মান যাই হোক না কেন নেতা–মন্ত্রী–আমলাদের আরাম–আয়েশ, বিলাস–ব্যসন, চার্টার্ড বিমানে ঘোরাফেরা, বিদেশ ভ্রমণ, প্রধানমন্ত্রীর দামি পোশাক ইত্যাদি কিন্তু অটুট থাকে৷ তাই অভাব অর্থের নয়, অভাব জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গির৷ ১৯৯৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে বলা হয়েছিল সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিকের বিনা পয়সায় চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে৷ সে বিষয়ে সরকারগুলি সম্পূর্ণ উদাসীন এবং কৌশলে মেডিকেল কলেজ থেকে শুরু করে জেলা হাসপাতালগুলিতে এমআরআই, সিটি স্ক্যান, ইউএসজি, ইসিজি, প্যাথোলজি ইত্যাদি পরিষেবাগুলি বিভিন্ন ব্যবসায়ীগোষ্ঠীকে দিয়ে দিয়েছে৷ স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা করে অবাধ মুনাফা লুটতে সারা দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে বেসরকারি বিলাসবহুল ব্যয়সাপেক্ষ নার্সিংহোম৷ পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের ম্যানেজার এই সরকারগুলি এখানেই থেমে থাকেনি৷ বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যপরিষেবাকে বিমা নির্ভর করতে চাইছে৷ নার্সিংহোমগুলির অমানবিক আচরণ সকলেরই অত্যন্ত পরিচিত৷ রোগীদের বেশি দিন রেখে দেওয়া, প্রয়োজনাতিরিক্ত পরীক্ষা–নিরীক্ষা করানো এবং সবশেষে রোগীর পরিবারের ঘাড়ে মাত্রাতিরিক্ত বিল চাপানো সহ এই বিলের টাকা বিমা কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়ার জন্য রোগীর পরিজনের মারাত্মক হয়রানির অভিজ্ঞতা আছে৷ ফলে চিকিৎসা হয়ে উঠছে বিমা নির্ভর৷ পকেট ভরছে ইনসিওরেন্স কোম্পানি ও নার্সিং হোম মালিকদের৷
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে৷ গবেষণার ফলে অনেক অসুখ সূচনাতেই ধরে ফেলা ও তার নিরাময় সম্ভব৷ কিন্তু বাদ সাধছে বাজার অর্থনীতি৷ গবেষণা থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি, ওষুধ বিক্রি, আমদানি–রপ্তানি সবই বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি নিয়ন্ত্রণ করছে শুধু তাদের মুনাফার স্বার্থে৷
অবহেলায় মরছে একটা ভারতবর্ষ, জীবন যন্ত্রণায় ধুঁকছে, বিনা চিকিৎসায় মরছে– আর একটা ভারতবর্ষ উঠে যাচ্ছে বিশ্বের ধনীদের প্রথম সারিতে৷ এই কি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের ভবিতব্য?
(৭০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা ২০ জুলাই, ২০১৮)