
বিধানসভায় জাতের নামে বজ্জাতি, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের রাজনীতি শুরু হয়েছে। বিরোধী দলনেতা বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী ১১ মার্চ বিধানসভার বাইরে সাংবাদিকদের বলেন, ২০২৬-এ বিজেপি ক্ষমতায় এলে তৃণমূলের বিজয়ী মুসলিম বিধায়কদের চ্যাংদোলা করে বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হবে।
তাঁর এই বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই প্রবল ভাবে নিন্দিত হয়েছে। ভোটে নির্বাচিত একজন বিধায়কের উদ্দেশ্যে এই ধরনের মন্তব্য সংসদীয় ভাবে শুধু নয়, সামাজিকভাবেও চূড়ান্ত অশোভন, ভদ্রতা-সভ্যতা-শিষ্টাচার বিরোধী। আর ধর্মের উল্লেখ করে এমন মন্তব্য তো বেআইনিও বটে। এই ধরনের বক্তব্য সেই বিধানসভা ক্ষেত্রের ভোটারদের প্রতিও চরম অসম্মান। এর তীব্র প্রতিবাদ হওয়া দরকার। স্কুল-কলেজের শিক্ষা থেকে, সামাজিক পরিবেশ থেকে যাদের এই বোধ গড়ে ওঠেনি, বা গড়ে উঠলেও সংস্কৃতি বিবর্জিত রাজনৈতিক ধারা চর্চার ফলে অবলুপ্তির পথে, তাদের সভ্যতার সহজপাঠ শেখাতে প্রতিবাদই একমাত্র রাস্তা। কিন্তু সেই প্রতিবাদ কি একই দোষে দুষ্ট হবে? প্রতিবাদের কি কোনও রুচি-সংস্কৃতির বাঁধন থাকবে না? তৃণমূলের কয়েকজন নেতা-মন্ত্রীর আচরণে সেই সংস্কৃতি বোধের ভীষণ অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী এবং বিধায়ক হুমায়ুন কবীর যে ভাষায় এর উত্তর দিয়েছেন তাও অত্যন্ত আপত্তিকর।
প্রশ্ন জাগে, ভোটাররা কি এই সব হীন কাজের জন্য বিধায়কদের নির্বাচিত করেছেন? এই নোংরা তরজার জন্যই কি জনগণের পয়সায় মোটা বেতন ভোগ করছেন বিধায়করা? বিরোধী দলনেতা তথা নন্দীগ্রাম থেকে নির্বাচিত বিধায়ক শুভেন্দুবাবু যে আন্দোলনের শহিদ বেদিতে প্রতি বছর ঘটা করে মালা দেন– ওই বেদিতে খোদিত আছে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বীর শহিদদের রক্ত। আজ এই ধরনের সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক কথা বলার পর তাঁর কী কোনও অধিকার থাকে শহিদ বেদিতে মালা দেওয়ার?
বিজেপি বিধায়কদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বিধানসভায় বলেছেন, আপনারা ধর্মীয় কার্ড খেলছেন। ধর্মের নামে জালিয়াতি করবেন না। আমি একজন হিন্দু। কালী পুজো করি। দুর্গাপুজো করি। তার সার্টিফিকেট কি আপনাদের কাছ থেকে নিতে হবে?
মমতা ব্যানার্জী যে হিন্দু তা ফলাও করে প্রচারের হেতু কী? তিনি কী কী পুজো করেন বিধানসভায় তা বলারই বা কী প্রয়োজন ছিল? তিনি প্রচার না করলেও রাজ্যের মানুষ তাঁর ধর্ম পরিচয় জানেন। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর হিন্দু পরিচিতি ঢাক পিটিয়ে প্রচার করছেন একেবারে ভোট রাজনীতির হিসাব কষেই। সেটা হল বিজেপিকে টেক্কা দেওয়া যে, তুমি একা হিন্দু নও। এই চাপান উতোর থেকে স্পষ্ট, উভয়পক্ষই চাইছে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন, যা তাদের হিসাবে ভোট রাজনীতিতে ভাল ফল দেবে।
উভয় দলের এই সাদৃশ্যের কারণ হল শ্রেণি সাদৃশ্য, পুঁজিপতি শ্রেণির দল হওয়ার কারণে আচরণগত সাদৃশ্য। আবার তাদের মধ্যে যতটুকু পার্থক্য তার মূলে রয়েছে একজন সর্বভারতীয় বৃহৎ পুঁজির সেবক, অপরজন আঞ্চলিক পুঁজির আশীর্বাদধন্য। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের পেছনে কাজ করে বুর্জোয়া শ্রেণি স্বার্থ। তাই দুটি দলের কারওরই জনস্বার্থ রক্ষায় কোনও ভূমিকা নেই। তাই এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি, একের পর এক জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিজেপির কোনও প্রতিবাদ-আন্দোলন নেই। তেমনই কেন্দ্রের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী ভূমিকার বিরুদ্ধে তৃণমূলেরও কোনও প্রতিবাদ-আন্দোলন নেই। তা হলে জনগণ তাদের সমর্থন করবে কীসের ভিত্তিতে? সেই জন্যই মানুষের ধর্মীয় আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া, ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিভাজনের রাজনীতি করা। ধর্ম তুলে এই ধরনের হুমকির পেছনে বিজেপির লক্ষ্য মুসলিম বিরোধিতার হাওয়া তুলে হিন্দু ভোট এককাট্টা করা। অন্য দিকে তৃণমূলের লক্ষ্য মুসলিমদের ত্রাতা সেজে মুসলিম ভোট অটুট রাখার পাশাপাশি নরম হিন্দুত্বের অস্ত্রে হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কে বিজেপির থাবা রুখে দেওয়া। রাজ্যে এখন এই দুষ্ট খেলাই চলছে রাজনীতির নামে। মনে রাখা দরকার, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির মতো শক্তির মাথা তোলার পিছনে বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিএমের অ-বাম রাজনীতির পথে সরকার চালানোর ভূমিকা কম নয়। ক্ষমতা হারানোর পরও তাদের ‘আগে রাম পরে বাম’ স্লোগানে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই জমি পেয়েছে।
ভাল করে খুঁটিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কোনও সরকারি দলই বাস্তবে কোনও ধর্ম বর্ণের মানুষেরই ত্রাতা নয়। পুঁজিবাদী সরকার হল, পুঁজিপতি শ্রেণির সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিপতিদের মুনাফা লোটার পাহারাদার, তাদের সেবাদাস। বিজেপি সর্বদা অন্য দলগুলিকে মুসলিম তোষণকারী বলে। বাস্তবে মুসলিমদের স্বার্থ কোনও সরকারই রক্ষা করেনি। সাচার কমিটির রিপোর্ট সেটাই দেখিয়ে গেছে। মুসলিম স্বার্থের কথা বলে তারা তাদের ভোট নিয়েছে। আর এই রাজ্য সরকারগুলি ভোটব্যাঙ্ক তৈরির স্বার্থে যত মুসলিম প্রীতি দেখায়, তত বিজেপির পক্ষে সুবিধা হয় মুসলিম বিরোধিতার আবহ তৈরি করে হিন্দু সেন্টিমেন্ট খুঁচিয়ে তোলা। তার ফলে যে বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি হয় তার সবচেয়ে বেশি কুফল বর্তায় সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের উপরেই।
২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন। তাতে লাভের শতাংশ হিসাব কষেই এই খেলায় নেমেছে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল। এতে কার লাভ, কার ক্ষতি? লাভ শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির, তারা নিশ্চিন্তে জনগণের উপর তাদের শোষণের স্টিম রোলার চালিয়ে যায়। আর লাভ শাসক দলগুলির। তারা নিশ্চিন্তে জনবিরোধী কাজগুলি চালিয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি শোষিত সাধারণ মানুষের। সাধারণ মানুষ যে হাজারটা সমস্যায় জর্জরিত সেগুলোর সমাধানের দাবিতে লড়াই পিছনে চলে যায় সাম্প্রদায়িক তরজায়। ধর্মীয় বিভেদ উস্কে দিয়ে জীবনের সব সমস্যা ভোলানো হয়। ধর্মীয় বিভেদ জনগণের জীবন ও জীবিকা রক্ষার আন্দোলনকে দুর্বল করে। অথচ পুঁজিবাদী শোষণ জাত-ধর্ম মানে না। কোনও হিন্দু মালিক যেমন তার হিন্দু শ্রমিকদের বাড়তি সুবিধা দেয় না, তেমনই মুসলিম মালিকও মুসলিম শ্রমিককে বাড়তি সুবিধা দেয় না। পুঁজিবাদী এই শোষণ থেকে মুক্তির রাস্তা পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস কোনও সরকার করে দেবে না।
এর থেকে মুক্তির রাস্তা গড়ে তুলতে হবে ধর্ম বর্ণ জাত নির্বিশেষে সমস্ত শোষিত মানুষকে যুক্ত করে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে। গণআন্দোলনের সুদৃঢ় ঐক্যই এই ধরনের সাম্প্রদায়িক উস্কানির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে পারে। এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) সেই গণআন্দোলনের রাস্তায় চলতে বদ্ধপরিকর।