জনস্বার্থ নয়, জাতপাতেই অঙ্ক মেলাতে চাইছে ভোটসর্বস্ব দলগুলি

১০ মে কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচন। জনগণের মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে ৪০ পারসেন্ট কমিশনের সরকার– অথচ বিজেপি-কংগ্রেস কারও প্রচারে এ কথা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। এই রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারে দু-দলেরই কথায় আসছে এবার সুশাসন, দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান কিংবা কৃষকদের ফসলের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার মতো ইস্যুগুলি নিয়ে মন ভোলানো প্রতিশ্রুতি বা জুমলা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। দু’দলেরই কথায় আসছে সাম্প্রদায়িক বিভাজন, জাতপাত ও সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে রেষারেষি, টিপু সুলতানকে হিন্দু বিরোধী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া, অনগ্রসর মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ বাতিলের উস্কানিমূলক পদক্ষেপ ইত্যাদি ঘিরে চর্চা ও উত্তপ্ত প্রচার। নির্বাচনী ফলাফল কী হবে তা ফলাফল ঘোষণা হলেই বোঝা যাবে। কিন্তু এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়, ইতিপূর্বে হিজাব বিতর্ক কিংবা ইদগা সংলগ্ন মাঠের দখলকে ঘিরে উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়াস পরিকল্পিত ছিল। অপেক্ষাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া মুক্ত দক্ষিণের এই রাজ্যের মাটিতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভাজনের শিকড় চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল আরও গভীরে এবং ব্যাপকভাবে ।

এবারে যে ভাবে বিজেপি টিপু সুলতানকে নিয়ে পড়েছে, তাতে কেউ ভাবতে পারেন এবারে ভোটে তাদের প্রতিপক্ষ বোধ হয় তিনিই। অথচ ইতিহাসের প্রামাণ্য নথিপত্র অনুযায়ী টিপু সুলতান তাঁর রাজত্বকালে ধর্মকে কেন্দ্র করে কোনও বিরোধ বা অসহিষ্ণুতাকে প্রশ্রয় দিতেন না। মারাঠা আক্রমণে শংকরাচার্যের মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর টিপু সুলতান মন্দির নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন। মরণপণ লড়াই করে দাক্ষিণাত্যে ব্রিটিশদের আধিপত্য বিস্তারের প্রয়াসকে তিনি ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন। বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় ব্রিটিশরা টিপু সুলতানকে হত্যা করেছিল। এটাই ইতিহাস। হঠাৎ সব কিছু তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে এসব নাকি সত্য নয়। টিপু সুলতান নাকি ভয়ঙ্কর হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন। তিনি নাকি তিন হাজার ব্রাহ্মণকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছিলেন, মন্দির ভেঙেছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের দুই বীর নায়ক উরি গৌড়া আর নজনে গৌড়া নাকি হিন্দুবিদ্বেষের বদলা নিতে টিপু সুলতানকে যুদ্ধে পরাজিত করে হত্যা করেন। কিন্তু এর সাথে বিধানসভা নির্বাচনের কী সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা ভোটের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা ছাড়া আর কি?

ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, তার সাথে সরকারের চরম দুর্নীতি আর অপদার্থতার কারণে শাসক দল বিজেপির প্রতি সারা রাজ্যের মানুষ ক্ষিপ্ত। তার ওপর গতবার ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় সহায় লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের বিরাট অংশ বিজেপির প্রতি বিরক্তি ও হতাশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই তারা দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রভাবশালী ভোটব্যাঙ্ক ভোক্কালিগা সম্প্রদায়কে বিরোধীদের থেকে নিজেদের দিকে টেনে নেওয়া আর সাম্প্রদায়িক বিভেদের চূড়ান্ত মেরুকরণের তাস খেলার চেষ্টা করছে।

একেই পাখির চোখ করে নির্বাচন ঘোষণার ঠিক আগে আগেই অনগ্রসর মুসলিমদের সংরক্ষণ বাতিল করে ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের জন্য ২ শতাংশ সংরক্ষণ বৃদ্ধির ঘোষণা। তার জন্যই টিপুকে হিন্দুবিদ্বেষী হিসেবে আর টিপুর তথাকথিত হিন্দু বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের দুই কাল্পনিক চরিত্রকে হিন্দু বীর হিসেবে তুলে ধরা। ভোক্কালিগা সম্প্রদায়কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা। নিহিতার্থ– হিন্দুবিদ্বেষী টিপুকে যেমন বীর ভোক্কালিগারা হত্যা করেছিল, ঠিক তেমনি করে হিন্দুত্বের স্বার্থে আজকের ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের ভোটারদের কর্তব্য বিজেপি বিরোধীদের শেষ করে দেওয়া, বীরত্বের সঙ্গে অন্যদের ধরাশায়ী করে বিজেপিকে জয়ী করা। এই হল দক্ষিণ কর্ণাটকের বিস্তীর্ণ ভোক্কালিগা অধ্যুষিত এলাকার মানুষের কাছে গেরুয়া শিবিরের বার্তা।

সব কিছু প্রথমটায় ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু জল ঢেলে দিয়েছেন এই নয়া ন্যারেটিভ গড়ে তোলার উদ্যোগে। লিঙ্গায়েত কিংবা ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসেবেই বিবেচনা করেন। তাঁদের সম্প্রদায়কে হিন্দু বীর হিসেবে দেখানোর ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের এই ষড়যন্ত্রকে তাঁরা মোটেও ভালচোখে দেখেননি। তাই বলেছেন এই গল্পটা কাল্পনিক। গল্পের বীর চরিত্র দুটিও অল্প কিছুদিন আগে লিখিত নাটকের কাল্পনিক চরিত্র, যার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। ফলে ভোক্কালিগা সম্প্রদায়কে মুসলিমবিদ্বেষী করে তোলার উদ্যোগে বেশ একটা বড় রকম ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি।

এদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ বাতিল করে অন্য দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তা বণ্টন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টও স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এতে বিজেপির আশু ভোটের অঙ্ক হয়ত কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতেও পারে। কিন্তু বিজেপি কিংবা তার জায়গায় কংগ্রেস বা জেডিইউ অন্য কোনও বুর্জোয়া দল যারাই ক্ষমতায় আসুক জাতপাত, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের যে খেলা শুরু হয়েছে তা তারা অব্যাহত রাখবে। তার বিষাক্ত প্রভাবও চলতেই থাকবে। ইতিমধ্যেই এসসি বা এসটি সংরক্ষণের অভ্যন্তরেও আলাদা আলাদা অসংখ্য জাতের মধ্যে থেকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংরক্ষণের দাবিকে তাঁরা উসকে তুলছেন। শুধু কর্ণাটক নয়, সারা দেশেই তারা এ কাজ করছে। দেশের মানুষের ঐক্যকে ধ্বংস করার কাজে তাকে ব্যবহার করায় কংগ্রেস বা বিজেপি– কেউই কম যায় না। কারণ নির্বাচনী প্রতিপক্ষ হলেও এরাও একই খেলার খেলোয়াড়। এ কথা বোঝা যায় যখন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মুসলিমদের সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখলেও কংগ্রেস কিন্তু ভোক্কালিগা কিংবা লিঙ্গায়েত অধ্যুষিত এলাকায় এ ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করে না। আসলে জাতপাতের অঙ্কের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি। পুঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষা করতে দায়বদ্ধ এই দলগুলির জনজীবনের মূল সমস্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোনও ক্ষমতাই নেই।

 অথচ কর্ণাটকের সাধারণ মানুষের জীবন অন্য আর পাঁচটা রাজ্যের মতোই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধিতে বিপর্যস্ত। বেকারি ক্রমবর্ধমান, সীমাহীন দুর্নীতি ভ্রষ্টাচারের ফলে জনজীবনের দুর্দশা চরমে। পেট্রল ডিজেল রান্নার গ্যাস ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিতে সারা দেশের মতো কর্ণাটকের মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির নাভিশ্বাস ওঠার মতো পরিস্থিতি। সরকার পরিচালিত শিক্ষা, চিকিৎসা, গণবণ্টন ব্যবস্থা কার্যত উঠে যেতে বসেছে। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র লাগাম ছাড়া ফি বৃদ্ধি ঘটেই চলেছে, অথচ নিয়মিত ক্লাস নেই। পঠন-পাঠনের মান ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে। রাজ্যে ২ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষক পদ শূন্য। অসংখ্য উচ্চশিক্ষিত বেকার। অথচ নিয়োগের ব্যাপারে সরকার সম্পূর্ণ নীরব। উল্টে অত যে সাধের আইটি সেক্টরের ভারতজোড়া গৌরব এত দিন প্রচারে উঠে আসত, সেই আইটি সেক্টর সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক ছাঁটাই হচ্ছে। চাকরির চরম সংকটের বাজারে যোগ্য এবং উচ্চশিক্ষিত বেকারদের উপর অতি সামান্য বেতনের বিনিময়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে দ্বিগুণ পরিশ্রমের বোঝা। স্থায়ী চাকরি, ন্যায্য বেতন, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক অধিকার– সবকিছুই যেন বাতিল ধারণায় পর্যবসিত হয়েছে।

কৃষকদের জীবন-জীবিকা প্রায় ধ্বংসের মুখে। গত পাঁচ বছরে এ রাজ্যে ৪২৫৭ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। জীবিকার সন্ধানে এনরেগা প্রকল্পে মজুরির কাজ পাওয়ার জন্য এমনকি শিক্ষিত বেকাররাও হাপিত্যেশ করছেন।

যে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্য রাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে এত সোচ্চার, কর্ণাটকে তারাই আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। পুলিশ বিভাগের নিয়োগ, সহকারি প্রফেসরদের নিয়োগ, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ– সর্বত্র চূড়ান্ত দুর্নীতি আর স্বজনপোষণ। শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা যুক্ত। সম্প্রতি এক এমএলএ এবং তার পুত্র ঘুষ নিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই বিএস ইয়েদুরাপ্পা এবং বাঙ্গালোর ডেভেলপমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যান সোমশেখরের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। দুর্নীতির অভিযোগের সারবত্তা বিচার করে সিটি সিভিল অ্যান্ড সেশান জজকোর্ট দু-জনের বিরুদ্ধে এফআইআর করার নির্দেশ দেয়। শেষ পর্যন্ত বিজেপি তড়িঘড়ি ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে সরাতে বাধ্য হয়। যদিও এ সব শাসক বিজেপির কাছে নতুন কিছু নয়। গোটা দেশের যেখানেই বিজেপি ক্ষমতায় সেখানেই যে কোনও শাসক দলের মতো আপাদমস্তক দুর্নীতিতে তারাও নিমজ্জিত। পার্থক্য হল, অন্যদের সাধ থাকলেও সাধ্যের সীমা আছে। বিজেপি তার রাজনৈতিক শত্রুদের ক্ষেত্রে সিবিআই বা ইডিকে তদন্তে লেলিয়ে দেয়। আর বিজেপির বেলায় ইডি সিবিআই চোখ বুজে থাকে। শাসকদলগুলির মধ্যে দুর্নীতির কারবারে বিজেপি তাই একচেটিয়া হওয়ার দৌড়ে অন্য সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে অনায়াসে ছাড়িয়ে গেছে। ইয়েদুরাপ্পার দুর্নীতি সফল ভাবেই ধামাচাপা দিয়ে বোম্মাইকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার বছর দুয়েকের রাজত্বে লাগামছাড়া দুর্নীতিতে তিনি তাঁর পূর্বসূরিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন।

মানুষকে বোকা বানিয়ে ভোট আদায় করে নিতে পারার এই যে রাজনীতি, এতে শাসকরা সন্তুষ্ট থাকলেও সাধারণ মানুষের অসন্তোষ তাতে কমছে না, বরং বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। বুর্জোয়া দলগুলির নানা চক্রান্তে হাজার বিভ্রান্তিতে ফেঁসে গিয়েও দিনের শেষে প্রচলিত এই রাজনীতির প্রতি ক্ষোভ বিতৃষ্ণাও অত্যন্ত বাস্তব। বাঁচার তাগিদেই এই দুঃসহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাইছেন কর্ণাটকের মানুষ।

সিপিএমের মতো বামপন্থী দল গণআন্দোলন গড়ে তোলা দূরে থাক, কংগ্রেসের পিছন পিছন চলছে কর্ণাটকে। অন্যদিকে রাজ্যের সাধারণ মানুষের নানা দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করে, জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেওয়ার যথার্থ বামপন্থী রাজনীতির চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে এস ইউ সি আই (সি)। গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কর্ণাটকের বৃহত্তম বামপন্থী দল হিসাবে উঠে এসেছে এসইউসিআই(সি)। রাজনীতি সচেতন মানুষ, বেকার যুবক, পরিযায়ী শ্রমিক, স্কিম ওয়ার্কার্স, ছাত্র, শিক্ষক, অধ্যাপক, সরকারি কর্মচারী, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া কৃষকরা গণআন্দোলনের বিশ্বস্ত হাতিয়ার হিসেবে এই দলটির দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি চাইছেন।