মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্য সম্পাদকের চিঠি
জনগণের করের টাকা খরচ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিধান পরিষদ গঠনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক বলে মনে করে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)। সরকারকে এই বিধান পরিষদ গঠন করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ৫ জুলাই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি চিঠি পাঠান। নিচে সেটি প্রকাশ করা হল।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার নতুন করে বিধান পরিষদ গঠন করতে চলেছে। এই পরিষদ গঠন করার জন্য দশ বছর আগে গত ২৮ জুন ২০১১ তৃণমূলের নেতৃত্বে গঠিত প্রথম সরকার বিধানসভায় আইন প্রণয়ন করে। এর তীব্র প্রতিবাদ করে এসইউসিআই(সি)-র তরফ থেকে তখনই আপনাকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। বিধানসভার অন্দরেও আমাদের প্রতিনিধি এই বিলের বিরোধিতা করেছিলেন। জনমতও এই পরিষদ গঠনের বিরুদ্ধে ছিল। সেকথা বিবেচনা করে আইন পাশ হলেও রাজ্য সরকার তখন ঐ পরিষদ গঠন করা থেকে বিরত হয়েছিল। কিন্তু, কী কারণে আবার আপনার সরকার বিধান পরিষদ গঠন করতে চলেছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
এদেশে বা আমাদের রাজ্যে বিধান পরিষদ গঠনের প্রশ্নটি নতুন নয়। ১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুকরণ করে এদেশে লোকসভার উপরে রাজ্যসভা চাপিয়েদেওয়া হয়েছিল। ইংল্যান্ডে যেমন সাধারণ মানুষের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত ‘হাউস অফ কমন্স’-এর উপর অভিজাত ও সমাজের বিশিষ্ট মানুষদের মধ্য থেকে মনোনীত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত ‘হাউস অফ লর্ডস’ চাপানো আছে। ইতিহাস বলছে, রেনেসাঁ আন্দোলন ও শিল্প বিপ্লবের পর সাধারণ মানুষের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা ‘হাউস অফ কমন্স’ গঠিত হওয়ার ব্যবস্থা হলে তা অভিজাতদের স্বার্থে ও সম্মানে লাগে। তাই তাদের খুশি করার জন্য ব্রিটিশ আইনে ‘হাউস অফ লর্ডসের’ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিল অপ্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত কোনও আইনসভাকে সমর্থন করতেন না।
লোকসভায় গৃহীত কোনও বিলকে আইনে পরিণত করতে গেলে যেমন রাজ্যসভার অনুমোদন লাগে, বিধানসভায় গৃহীত বিলকে তেমনই বিধান পরিষদে পাশ করাতে হয় এবং তাতে অনাবশ্যক বিলম্ব হয়। স্বাধীনতার পর বহু রাজ্যে বিধান পরিষদ গঠন করা হলেও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অসুবিধার জন্য তা অবলুপ্ত করা হয় এবং মাত্র ২-৩টি রাজ্যে এখন তার অস্তিত্ব আছে। কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন বিজেপি এই রাজ্যগুলির কয়েকটি জায়গায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। বিধান পরিষদ বাতিলের দাবি গণআন্দোলনের মধ্য দিয়েই উঠেছিল এবং ১৯৬৯ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার বিধানসভা এবং তৎকালীন বিধান পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদন নিয়ে বিধান পরিষদ অবলুপ্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। ফলে, আবার বিধান পরিষদ গঠনের কোনও যুক্তিসংগত কারণ আছে বলে আমরা মনে করি না।
আপনি জানেন, রাজ্যের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে এই অতিমারির কারণে ও আম্ফান-ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আর্থিক দিক থেকে অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। লক্ষ লক্ষ বেকার, কর্মচ্যুত শ্রমিক, দিনমজুর, পরিচারিকা, হকার, ফিরে আসা কর্মহীন পরিযায়ী শ্রমিকের রুজি-রোজগারের কোনও সুযোগ নেই। গ্রামে কৃষকদের করুণ অবস্থার কথা আপনার অজানা নয়। অসংখ্য মানুষ স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। পেট্রল-ডিজেল-কেরোসিন-রান্নার গ্যাসের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস মানুষের নাগালের বাইরে। করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক হাসপাতালের বেড ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করার টাকাও সরকার জোগাড় করতে পারছে না। এই অবস্থায় বিধান পরিষদ গঠন, তার সদস্যদের বেতন ও ভাতা বাবদ বছরে যে কয়েক কোটি টাকা খরচ হবে, তা কেন রাজ্য সরকার বহন করবে? সেই টাকা তো গরিব করদাতাদের পকেট থেকেই যাবে!
এর জন্য শুধু বিপুল আর্থিক দায় রাজ্য সরকারের ঘাড়ে চাপবে তাই নয়, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও জটিলতা বাড়বে। দেশের বেশিরভাগ রাজ্য ইতিমধ্যে বিধান পরিষদ তুলে দিয়েছে। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যদি এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে, তাহলে তার একটিই অর্থ দাঁড়াবে– শাসক দলের যে নেতাদের বিধানসভা অথবা লোকসভায় জায়গা করে দেওয়া যায়নি, জনগণের পকেট কেটে বিধান পরিষদে তাদের জায়গা করে দিয়ে সস্তুষ্ট করা।
আমাদের প্রত্যাশা আপনি সব দিক বিবেচনা করে বিধান পরিষদ গঠনের কাজ থেকে বিরত হবেন।