কান পাতলে শোনা যায়, ইন্ডিয়া ‘ডিজিটাল’ হচ্ছে। অর্থাৎ দেশ প্রযুক্তিতে দারুণ উন্নতি করছে। কৃষি, শিল্প সব ক্ষেত্রেই উন্নত প্রযুক্তি আসছে, ফসল উৎপাদনের নিত্য নতুন পদ্ধতিও আবিষ্কার হচ্ছে। পরিশ্রম আর সময় বাঁচানোর অর্থাৎ কম সময়ে বেশি উৎপাদন করারও নানা উপায় এসেছে। অথচ দারিদ্র-অপুষ্টি-অনাহার বাড়ছে ক্রমশ, ক্ষুধাতালিকায় নিচের দিকে নামছে দেশ। এমনকী শিশুরাও প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবারটুকু পাচ্ছে না। বাড়ছে শিশুমৃত্যুর হার, শিশু অপুষ্টি। এসব কেন ঘটছে, প্রশ্ন তুললেই এক দল ধুরন্ধর বলেন, আরে মশাই ওসব বলে লাভ নেই। পপুলেশন না কমলে কিচ্ছু করা যাবে না। এত মানুষ যাবে কোথায়, এতজনের খাবার, চাকরি জোগাবে কে? তাঁদের মতে, জনসংখ্যাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। সমাজের যাবতীয় সংকট, বেকারি, অপুষ্টি ইত্যাদির জন্য দায়ী নাকি ওই ‘পপুলেশন’। তাদের মতে, জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলেই সবার খাদ্য মিলছে না, সবার কাজ জুটছে না।
গভীরে ভাবলে বোঝা যায়, এই প্রচার কতখানি ফাঁপা। সত্যিই কি সবার জন্য খাদ্য নেই? বাজারে, শপিং মলে গেলে থরে থরে সাজানো খাদ্যপণ্য। বাজারে খাবারের অভাব কি আদৌ দেখা যায়? এ ছাড়া অপুষ্টিতে ভুগছে কারা? কখনও শোনা গেছে, আম্বানি-আদানির মতো শিল্পপতি বা তাদের পরিবারের কারও খাবার বা কাজ বা অন্য কোনও কিছুর অভাব হয়েছে? এ সমাজে একটা ছোট শিশুও জানে, যত অনাহার যত বেকারি যত অভাব-অনটন সব শুধু নিচের তলার খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। শুধু তাই নয়, সাধারণ মানুষের দুর্দশা যতই বাড়ছে, মুষ্টিমেয় এক শ্রেণির সম্পদও ততই ফুলেফেঁপে উঠছে।
বিগত দু’ বছরের করোনা অতিমারির কথাই যদি ধরি, আমাদের দেশে হঠাৎ ঘোষিত লকডাউনে যখন গোটা দেশের পরিবহন অবরুদ্ধ, পরিযায়ী শ্রমিকরা মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরছেন, পথশ্রমে অনাহারে অসুস্থতায় মারা যাচ্ছেন, লক্ষ মানুষের কাজ চলে যাচ্ছে, হাসপাতালের বেডে অি’জেনের অভাবে মানুষ ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছে, সেই সময়ই কিন্তু আম্বানি আদানি সহ দেশের বড় বড় শিল্পপতিরা একশো গুণ দুশো গুণ মুনাফা বাড়িয়েছেন। বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায় ভারতের অনেক পুঁজিমালিক নতুন করে স্থান পেয়েছে। গোটা দেশের টালমাটাল অর্থনীতির আঁচটুকুও তাদের গায়ে লাগেনি। সুতরাং, দেশে সম্পদ নেই, খাদ্য নেই এমন নয়। টন টন খাবার গুদামে পচে নষ্ট হচ্ছে, দাম না পেয়ে অসহায় চাষিরা নিজের শ্রম নিংড়ে ফলানো ফসল জ্বালিয়ে দিচ্ছে বা ফেলে দিচ্ছে এ তো আমরা হামেশাই দেখি। তা সত্তে্বও দারিদ্র-অভাব এর কথা উঠলেই জনসংখ্যা কমানোর প্রশ্ন তোলা হয় কেন?
আসলে এ কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের অনেকেরই এটা নিজস্ব মত নয়। বাজারচলতি মিডিয়া, ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের মতো মাধ্যম মূলত এমনটাই প্রচার করে থাকে। এমনকি স্কুল-কলেজের বইতেও দারিদ্রের কারণ হিসাবে ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধি’কেই একটা প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে দেখানো হয়। এর তীব্রতা বোঝাতে কেতাবি নাম দেওয়া হয় ‘জনবিস্ফোরণ’। প্রচার এমনভাবে চলে যে, বেশিরভাগ মানুষেরই তলিয়ে ভাবা বা তথ্য-পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখার কথা মনে থাকে না। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা, বেশিরভাগ দেশের সরকার-প্রশাসন এবং তাদের টাকায় চলা নানা প্রতিষ্ঠান এই প্রচারে একেবারে সামনের সারিতে থাকে। আমাদের দেশেও যে সরকারই ক্ষমতায় থাক, তারা মাঝে মাঝেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে ভয়ানক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসা সরকারগুলোর মানুষের প্রতি দায়িত্ব, নাগরিকের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান এর অধিকার সব পিছনে চলে যায়, সামনে আসে শুধু ওই জনসংখ্যা। ভাবখানা এমন, যেন মানুষ হয়ে পৃথিবীতে এসেই এই সাধারণ মানুষগুলো মহা অপরাধ করে ফেলেছে, প্রবল সদিচ্ছা সত্তে্বও এতগুলো মুখে অন্ন তুলে দিতে অপারগ হচ্ছেন ক্ষমতায় থাকা কেষ্টবিষ্টুরা। পৃথিবীর সমস্ত দেশেই এই ‘ক্ষতিকর জনসংখ্যা বৃদ্ধি’-র প্রচার চলে। আমাদের দেশের বর্তমান সরকারের মতো কেউ কেউ এর সাথে ধর্মপরিচয়কে যুক্ত করে নোংরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিও টেনে আনে। অথচ, বাস্তবে অবস্থাটা আসলে কী? অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্যসংকট সব দেশেই কমবেশি বাড়ছে কেন? সত্যিই কি উৎপাদিত খাদ্যের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি বলেই অভুক্ত থাকতে হচ্ছে মানুষকে? লন্ডনের একটি সংস্থা ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা কিন্তু একেবারে দুয়ে দুয়ে চার এর মতো মিথ্যে প্রমাণ করেছে ‘জনসংখ্যার জন্যই খাদ্যাভাব’– এই মনগড়া ধারণাকে।
সমীক্ষার ফল বলছে, গোটা বিশ্বে প্রতিদিন মাথাপিছু যে পরিমাণ খাদ্য উৎপন্ন হয়, তা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক চাহিদার ২.৬ গুণ। অর্থাৎ, বিশ্বের সমস্ত মানুষের প্রতিদিনের পেটভরা খাবার জুগিয়েও বাড়তি হওয়ার কথা আড়াইগুণ খাদ্যসম্পদ। অথচ, পৃথিবীর ২.৩ বিলিয়ন মানুষ (এক বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি) প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য পান না। খাদ্য উৎপাদনও তো এক জায়গায় থেমে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০২০ এই পনেরো বছরে পৃথিবী জুড়ে উৎপাদন অনেক বেড়েছে। চাল, গম, ভুট্টা, আখ এবং নানা ধরনের ফল এর উৎপাদন বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি, সমস্ত ধরনের সবজির উৎপাদন বেড়েছে ৬৫ শতাংশ, দুধ এবং মাংসের জোগান বেড়েছে ৫৩ এবং ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ একই সাথে প্রতি বছর বেড়েছে অপুষ্ট, অভুক্ত মানুষের সংখ্যা। এই রিপোর্টেই বলা হয়েছে, পৃথিবীর প্রতি সাত জন মানুষের একজন পেটে খিদে নিয়ে শুতে যাচ্ছেন রোজ। তা হলে বাড়তি খাদ্য গেল কোথায়? এই অদ্ভুত গরমিল এর কারণ কী? কারণ হিসেবে ওই সমীক্ষাই তথ্য দিয়ে দেখিয়েছে, বীজ-চাষের উপকরণ-সার থেকে শুরু করে খাদ্যের পরিবহন, বণ্টন সহ সম্পূর্ণ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা রয়েছে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতির নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং, সাধারণ বাজারে কোন খাদ্য কোন দামে কতটা আসবে, চাষি কত দামে বীজ পাবেন, আদৌ চাষের জন্য দরকারি সার ইত্যাদি কিনতে পারবেন কি না, সব নিয়ন্ত্রণ করছে একচেটিয়া পুঁজি। এই নিয়ন্ত্রণ, এই কেন্দ্রীভবন যত তীব্র হচ্ছে, তত বাড়ছে অপুষ্টি, অনাহার। সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে, গোটা বিশ্বের খাদ্যবীজের বাজারের ৫৮ শতাংশ এবং কৃষি-রাসায়নিকের বাজারের ৭৭.৬ শতাংশ দখল করে রেখেছে মাত্র ছ’টি কর্পোরেট সংস্থা। বিশ্বের ২.৫ বিলিয়ন মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবন-জীবিকার জন্য যে জমির ওপর নির্ভরশীল, তাও চলে যাচ্ছে একচেটিয়া পুঁজির দখলে। দেশে দেশে চাষযোগ্য কৃষিজমি দখল করে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর মুনাফা লোটার খবর তো আজ কারও অজানা নয়। পরিণামে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ যে কৃষিজমির ওপর নির্ভরশীল, তা এসে ঠেকেছে মোট চাষযোগ্য জমির ৩০ শতাংশে।
একই সাথে চলছে গরিব দেশগুলোর ওপর প্রথম বিশ্বের তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর শোষণ। যেমন, বিশ্ব ব্যাঙ্কের ২০১৮-র একটি রিপোর্ট বলছে, সোমালিয়া জুড়ে বিপুল পরিমাণ চাষযোগ্য জমি রয়েছে, রয়েছে আরও কৃষি সম্প্রসারণের, মাছ চাষের এবং পশুখাদ্য বাণিজ্যের বিপুল সুযোগ। অথচ সোমালিয়ায় কী মারাত্মক দুর্ভিক্ষ-খাদ্যাভাব! সুতরাং, এই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করে কারা ফুলেফেঁপে উঠছে এবং তার মূল্য সোমালিয়ার হাজার হাজার অভুক্ত সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রাণ দিয়ে কী ভাবে চোকাচ্ছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মায়ানমার এর মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রেও কমবেশি একই কথা প্রযোজ্য। গোটা বিশ্বের প্রায় ৮৬ শতাংশ খাদ্যশস্যের জোগান দেওয়া এইসব দেশে অপুষ্ট মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমশ। এতকিছুর পরেও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি যে খাদ্য উৎপন্ন হচ্ছে, সেগুলো যাচ্ছে কোথায়? এক তৃতীয়াংশ খাদ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাজারে মানুষের কাছে পৌঁছানোর আগেই। কোথাও গুদামঘরে দিনের পর দিন জমছে সেসব, জমে জমে নষ্টও হচ্ছে প্রচুর। কারণ, সেগুলোর ‘লাভজনক বিক্রি’ নেই। অর্থাৎ, যে দামে বাজারে ছাড়লে পুঁজিমালিকদের মুনাফার খিদে মেটে, সে দামে কেনার ক্ষমতা নেই বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের। নেই কেন? কারণ আবারও সেই পুঁজির শোষণ। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদন করে সমাজের সমস্ত শ্রমজীবী মানুষ মিলে, অর্থাৎ উৎপাদনের চরিত্র সামাজিক। কিন্তু উৎপাদনের যন্ত্র কুক্ষিগত করে রেখেছে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি মালিক। উৎপাদন হচ্ছে দেশের মানুষের প্রয়োজন মেটাতে নয়, পুঁজিমালিকদের সর্বোচ্চ মুনাফার উদ্দেশ্যে এবং সেটা সম্ভব হচ্ছে ওই ব্যক্তিমালিকানার কারণেই। সুতরাং, মুনাফা এতটুকু কম হলে মালিক বা মালিকশ্রেণি পণ্য বাজারে ছাড়ে না। খাবার গুদামে পচুক, রাস্তায় পড়ে নষ্ট হোক, মানুষ না খেয়ে মরুক, তাতে এই পুঁজিপতি বা তাদের অনুগ্রহে ক্ষমতায় বসা সরকারগুলোর কিছু এসে যায় না। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হলে মুনাফা চাই, বিভিন্ন স্তরের পুঁজির তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে পুঁজির ক্রমশ কেন্দ্রীভবন এবং তার পরিণতিতে মানুষের ওপর আরও তীব্র শোষণ চলছে।
মানুষের শ্রমই সভ্যতা গডে, ফসল ফলায়, যাবতীয় পণ্য তৈরি করে। সুস্থ সমাজে মানুষ কখনও বাড়তি বোঝা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না। বরং জনসংখ্যা বাড়লে সেই মানুষের শ্রম দেশের উন্নতিতে লাগার কথা। পুঁজিবাদ তা হতে দিতে পারে না বলেই সে উৎপাদিত দ্রব্যের অধিকার থেকে মানুষকে তো বঞ্চিত করেই, অতিরিক্ত উৎপাদন আটকাতে এমনকী বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অবাধ বিকাশের পথেও বাধা সৃষ্টি করে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই চরিত্র বিশ্লেষণ করে ১৮৬৫ সালের একটি চিঠিতে কার্ল মার্ক্স এর সুযোগ্য সহযোদ্ধা এঙ্গেলস দেখিয়েছিলেন, ‘উৎপাদনের সীমা এখানে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় পকেটভর্তি টাকা আছে এমন ক্রেতার সংখ্যা দিয়ে। বুর্জোয়া সমাজ আর উৎপাদন হতে দিতে চায় না, চাইতে পারেও না। যে নির্দোষ মানুষগুলো, ক্ষুধার্ত পেটগুলো তার মুনাফার জোগান দিতে পারে না, পণ্য কিনতে পারে না, তাদের জন্য মৃত্যুই এখানে একমাত্র ভবিতব্য।’ আসলে খাদ্যসংকট তৈরি হয় এই শোষণ, এই মুনাফাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার জন্য, আর এই সত্যকে চাপা দিতে দুনিয়া জুড়ে পুঁজিপতিদের এবং তাদের সেবাদাস দলগুলোকে জনবিস্ফোরণের ঢাক পেটাতে হয়। যাতে শোষিত, বঞ্চিত মানুষকে বোঝানো যায়, তাদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী তারাই, পুঁজিবাদ নয়।