অর্থনীতির গভীর মন্দা ও করোনা অতিমারির কোপে চূড়ান্ত জর্জরিত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কেমন ‘দরদ’, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট। এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক জনসাধারণের জন্য কী কী উপহার নিয়ে এল এই বাজেট।
একশো দিনের কাজে বরাদ্দ কমল
অতিমারির ধাক্কায় বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতিদিন দারিদ্রের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেন। বেকারি, ছাঁটাইয়ে জেরবার জনজীবন। এই অবস্থায় এবারের বাজেটে বিজেপির অর্থমন্ত্রী মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প তথা একশো দিনের কাজ প্রকল্পের ব্যয়বরাদ্দ প্রভূত পরিমাণে ছেঁটে দিয়েছেন। ২০২০-২১ সালে অতিমারির পরিবেশে এই প্রকল্পের ব্যয়বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১ লক্ষ ১১ হাজার কোটি টাকায়। পরের বাজেটে সেই বরাদ্দ ছাঁটাই হয়ে দাঁড়ায় ৭২ হাজার ৩৪ কোটি টাকায়, যদিও পরে ডিসেম্বর মাসে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো হয়েছিল। এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী এই প্রকল্পে আবার বরাদ্দ করেছেন ৭২ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। সাধারণ মানুষ তো বটেই, শিল্পপতিরা পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীকে বলেছেন, এর ফলে গ্রামে কেনাকাটার লোকই পাওয়া যাবে না। তবু সরকার নীরব!
বরাদ্দ ছাঁটাই রেশনে
গণবন্টন ব্যবস্থা তথা রেশনে ২০২১-‘২২-এর বাজেট বরাদ্দ হয়েছিল ২ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি টাকা। অতিমারির প্রভাবে চরম দারিদ্রের কোপে পড়ে অসংখ্য মানুষের যখন দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতে প্রাণান্ত হচ্ছে, মূল্যবৃদ্ধির চাপে মানুষ যখন নাজেহাল, সেই অবস্থায় এবারের বাজেটে গণবন্টন ব্যবস্থায় ব্যাপক ছাঁটাই করে বরাদ্দ করা হয়েছে ২ লক্ষ ৬ হাজার কোটি টাকা। মোদি সরকারের এই নির্মম সিদ্ধান্তে দেশের বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের জীবনযন্ত্রণা তীব্রতর হবে।
অতিক্ষুদ্র শিল্প সেই তিমিরেই
এদেশে খেটে-খাওয়া মানুষের বিরাট একটা অংশ অতিক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। বাজারের অভাব, লকডাউনজনিত বিধিনিষেধের কারণে অর্থনীতির এই ক্ষেত্রটি ধুঁকছে। কাজ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। এই অবস্থায় দরকার ছিল অতিক্ষুদ্র শিল্প ক্ষেত্রটির দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া। অথচ এই বাজেটে আগের মতোই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গেই অতিক্ষুদ্র শিল্পকে যুক্ত রাখা হল এমএসএমই ক্ষেত্র হিসাবে। আগের বছরই ১০০ কোটি টাকা পুঁজির বড় শিল্পকে এমএসএমই গোত্রে ঢুকিয়ে দিয়েছে সরকার। ফলে এবারেও অতিক্ষুদ্র শিল্প ব্যাঙ্কঋণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল।
কৃষি সংক্রান্ত ক্ষেত্র অবহেলিত
মাছ চাষ ও পশু পালনের মতো কৃষি সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে দুই শতাংশেরও কম। মূল্যবৃদ্ধি ধরলে আসলে তা কমেছে। শুধু তাই নয়, গত বাজেটে এই ক্ষেত্রের জন্য যা বরাদ্দ হয়েছিল, প্রকৃত খরচ ততটুকুও হয়নি।
মিড ডে মিলে বরাদ্দ কমল
দেশের বিপুল সংখ্যক শিশু যখন অপুষ্টিতে ভুগছে, তখন মিড ডে মিল খাতে এবারের বাজেটে বরাদ্দ করা হল ১০ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের বরাদ্দের চেয়ে ১ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা কম।
শস্য সংগ্রহ, সরকারি গুদামের বরাদ্দ কমল, ছাঁটাই হল সারের ভর্তুকি
চাষিদের কাছ থেকে ধান-গমের মতো খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য বাজেট বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এই খাতে আগের বছরের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে ১১ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি ফুড কর্পোরেশনের মতো সরকারি সংস্থার মাধ্যমে শস্য সংগ্রহ ও সেগুলি সংরক্ষণের জন্য সরকারি গুদামের বরাদ্দও এবারের বাজেটে ২৮ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। চড়া দামে সার কিনতে গিয়ে কৃষকদের যখন নাভিশ্বাস উঠছে, তখন বাড়ানোর বদলে সারে ভর্তুকি ২৫ শতাংশ ছাঁটাই করেছে মোদি সরকার।
গ্যাসে ভর্তুকি প্রায় শূন্য
এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে রান্নার গ্যাস, কেরোসিন সহ বিভিন্ন জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছে মোদি সরকার। ২০২০-২১ অর্থ বছরে পেট্রোপণ্যে ভর্তুকি বরাদ্দ হয়েছিল ১৪ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে তা কমিয়ে আনা হয়েছিল ৬ হাজার ৫১৭ কোটি টাকায়। এবারের বাজেটে তা আরও কমিয়ে করা হয়েছে ৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। ফলে গ্যাসে সিলিন্ডার পিছু ভর্তুকি এখনকার ১৯ টাকার থেকেও কমবে।
(সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়, টাইমস অফ ইন্ডিয়া–২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)