ডিউটি চলাকালীন আর জি কর হাসপাতালের পিজিটি চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ ও খুন এবং পুলিশ-প্রশাসনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া ও প্রমাণ লোপাটের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে গোটা রাজ্য উত্তাল। ৯ আগস্ট ঘটনা সামনে আসার পর থেকে প্রতিদিন রাজ্যের সর্বত্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন সর্বস্তরের মানুষ। সর্বত্র ন্যায়বিচারের দাবিতে আওয়াজ উঠছে– ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। সেই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশ জুড়ে, দেশের বাইরেও। এই অবস্থায় ১৪ আগস্ট রাতে রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মহিলা যখন নানা জায়গায় ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ কর্মসূচি পালন করছেন, সেই সময়ে একদল দুষ্কৃতী আর জি কর হাসপাতালে আন্দোলনরত ডাক্তার-নার্সদের উপর হামলা চালায়, বিক্ষোভস্থলের মঞ্চ এমনকি এমার্জেন্সি সহ হাসপাতালের অন্য বিভাগেও ভাঙচুর চালায়। পুলিশ ছিল নীরব দর্শক।এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির প্রতিবাদে ১৫ আগস্ট এস ইউ সি আই (সি)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে পরদিন ১৬ আগস্ট ১২ ঘন্টার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। রাজ্য জুড়ে জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই ধর্মঘটে সামিল হন। ওই দিন দুপুরে দলের কেন্দ্রীয় দফতরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ধর্মঘটে সামিল হওয়ার জন্য রাজ্যের জনসাধারণকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, মাত্র একদিনের প্রচার ও প্রস্তুতিতে এমন সফল সাধারণ ধর্মঘট, এই আন্দোলনের প্রতি মানুষের সমর্থনের গভীরতাকেই স্পষ্ট করে।
এ দিন উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের সর্বত্র সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ধর্মঘটে সামিল হয়েছেন। বহু জায়গাতেই বাজার, দোকানপাট বন্ধ ছিল। যেখানে সেগুলি সামান্য যা খোলাও ছিল, ক্রেতাদের ভিড় ছিল না। অধিকাংশ স্কুল-কলেজই বন্ধ ছিল। বহু জেলায় বেসরকারি বাস চলেনি। সরকারি বাস ও ট্রেন চললেও তাতে যাত্রীসংখ্যা ছিল খুবই কম। স্বেচ্ছায় অফিস, কাজের জায়গায় যাওয়া বন্ধ করেছেন মানুষ। বহু জায়গায় এলাকার মানুষ এগিয়ে এসে অটোরিক্সা, টোটোচালকদের অনুরোধ করেছেন গাড়ি না চালাতে। দলের পিকেটিংরত কর্মীদের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন জলের বোতল, খাবার। অধিকাংশ অভিভাবকই সন্তানদের এ দিন স্কুলে পাঠাননি। কোথাও কোথাও প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকরা সিদ্ধান্ত নিয়ে স্কুল বন্ধ করে দিয়েছেন, এমনকি পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। সর্বত্রই মানুষ এই নৃশংস ঘটনা ও পুলিশ-প্রশাসনের জঘন্য আচরণের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, রাজ্যে নারী-নিরাপত্তার এই বেহাল দশা মেনে নেওয়া যায় না। আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যান।
এ সত্ত্বেও ধর্মঘটের দিন আন্দোলনকারীদের প্রতি পুলিশের আচরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল নির্মম। কলকাতার হাজরা মোড়, বেহালা সহ কোচবিহার, মাথাভাঙা, পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, জলপাইগুড়ি সহ বেশ কয়েকটি জেলায় ধর্মঘটের সমর্থনে শান্তিপূর্ণ মিছিলে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালায় পুলিশ। বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে। পুরুষ পুলিশ মহিলা আন্দোলনকারীদের চুল ধরে টেনে-হিঁচড়ে বীভৎস ভাবে গ্রেফতার করে, অশালীন আচরণ করে। শুধু তাই নয়, বহু জায়গায় পুলিশের সাথে মিলে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের দুষ্কৃতীরাও আক্রমণ চালায়। কোচবিহারের মাথাভাঙায় ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিল বের হলে তৃণমূলের বাহিনী পুলিশের উপস্থিতিতেই মিছিলের পিছনে ধাওয়া করে।
তুফানগঞ্জে এস ইউ সি আই (সি) কর্মীদের উপর তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা হামলা করে। সাতমাইলে তৃণমূল অঞ্চল সভাপতি ধর্মঘটের প্রচাররত কর্মীদের খুনের হুমকি পর্যন্ত দেন। মেদিনীপুর শহরে সাদা পোশাকের এক পুলিশ অফিসার এক ছাত্রকর্মীর গলা হাত দিয়ে এমনভাবে চেপে ধরে যে তার শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। রাস্তায় ফেলে মারা, চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। মেদিনীপুরে এক ছাত্রকর্মী অজ্ঞান হয়ে পড়া সত্ত্বেও তাকে শূন্যে তুলে পুলিশ গাড়িতে ছুঁড়ে দেয়। কলকাতায় হাজরা মোড়ে বয়সে প্রবীণ আন্দোলনকারীরাও পুলিশের হামলা থেকে রেহাই পাননি। বহু জায়গাতেই আইনের তোয়াক্কা না করে পুরুষ পুলিশ নির্লজ্জের মতো মহিলা-কর্মীদের উপর চড়াও হয়েছে। চলেছে ঢালাও গ্রেফতারি। জলপাইগুড়ি ও মেদিনীপুরে গ্রেফতার হওয়া কর্মীদের জামিন দিতে অস্বীকার করে পুলিশ। এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্য সম্পাদক জানান, ধর্মঘটে ৭০ জন মহিলা সহ দলের ২৬৬ জন কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। আহত ৩৩ জন, গুরুতর আহত ৯ জন। পুলিশ নিজেই কলকাতা মেডিকেল কলেজে দু’জনকে ভর্তি করেছে। আহতদের মধ্যে রয়েছেন দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নভেন্দু পাল এবং এআইডিএসও-র পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি সিদ্ধার্থ ঘাঁটা, রাজ্য কমিটির সদস্য সুজিত জানা প্রমুখ। যে পুলিশ-প্রশাসন এই নৃশংস কাণ্ডের প্রমাণ লোপাটের সঙ্গে যুক্ত, যে পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর শাসক দলের গুণ্ডাদের আক্রমণের সময় নিষ্ক্রিয় থাকে, তারাই যে ভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচার আক্রমণ চালিয়েছে, তার তীব্র নিন্দা করেন তিনি। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ধর্মঘট করতে দেবেন না বলে মুখ্যমন্ত্রী যে বক্তব্য রেখেছেন, তা গণতন্ত্রবিরোধী। সর্বস্তরে এর প্রতিবাদ প্রয়োজন। ধর্মঘটে সরকারি কর্মীরা অংশগ্রহণ করলে বেতন কাটা যাবে– এ ঘোষণাও চূড়ান্ত গণতন্ত্রবিরোধী। পরদিন রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালনের ডাক দেন তিনি। এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে এলাকায় এলাকায় সর্বস্তরের মহিলা সহ নাগরিকদের সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে নারী-সুরক্ষার দাবিতে আন্দোলন তীব্রতর করার ডাক দেন তিনি। জানান, যতদিন না সমস্ত অপরাধীর শাস্তি হয়, যত দিন না চিকিৎসক, ছাত্র-চিকিৎসক, নার্সদের দাবি অর্জিত হয়, তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয় এই আন্দোলন চলবে এবং ৩ সেপ্টেম্বর সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতি ও এ রাজ্যে তা কার্যকর করার বিরুদ্ধে ছাত্র-মিছিলে নারী-সুরক্ষার দাবিটিও ধ্বনিত হবে। ১৭ আগস্ট রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। সর্বত্র সভা, বিক্ষোভ মিছিল, পোস্টার লিখে দলের বক্তব্য প্রচারের কর্মসূচি পালন করেন কর্মী-সমর্থকরা।