জনজীবনের জ্বলন্ত দাবিগুলি নিয়ে জনমত সংগঠিত করতে নামছে এস ইউ সি আই (সি)
সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে৷ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন দলগুলি হাজারও প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছুটিয়েছিল এ দেশের কোটি কোটি শ্রমিক–কৃষক–নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের সামনে৷ কিন্তু ভোট কাটতে না কাটতেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পেট্রল–ডিজেল–রান্নার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে৷ তারা জনস্বার্থবিরোধী জাতীয় শিক্ষানীতিকে সামনে এনে, শিল্পমালিকদের দাবি মেনে শ্রমিকদের সুবিধাগুলি কেড়ে নিতে শ্রম আইন সংস্কার করতে চেয়ে, লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলে সম্পূর্ণ উল্টো আচরণ করতে শুরু করেছে৷ এ রাজ্যে তাদের আশাতীত সাফল্যে রাজ্যের মসনদে বসার স্বপ্নে তারা বিভোর হয়ে আছে৷ এর ফলে জেলায় জেলায় রাজ্যের শাসকদলের সাথে তাদের চলছে হানাহানি, খুনোখুনি৷ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন৷ ভোটের সময়কার রঙিন প্রতিশ্রুতিময় দিনগুলি আর নেই৷
এস ইউ সি আই (সি) নির্বাচন চলাকালীনই সাধারণ মানুষকে বলেছিল ভোটের সাথে তাদের জীবনের সমস্যাগুলির সুরাহার কোনও সম্পর্ক নেই৷ মানুষকে তার জীবনের গণতান্ত্রিক দাবিগুলি নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই গড়ে তুলতে হবে৷ এস ইউ সি আই (সি) থাকবে সেই লড়াইয়ের সামনে সারিতে৷ তাই ভোটের ফল ঘোষণার পর পরই দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ রাজ্যে রাজ্যে জনজীবনের দাবিগুলি পূরণের জন্য লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন৷
স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানের ১০ দফা দাবি |
১) অবিলম্বে প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালু, ২) সমস্ত বেকারের কাজ, ৩) মদ ও মাদক দ্রব্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা, ৪) সার–বীজ–তেলের দাম কমানো ও কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, ৫) নারী নির্যাতন–ধর্ষণ ও নারী–শিশু পাচার বন্ধ, নারী নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, ৬) বন্ধ কলকারখানা ও চা–বাগানগুলি খোলা, শ্রমিকদের নূ্যনতম মজুরি, আশা–আইসিডিএস সহ সমস্ত স্কিম ওয়ার্কারদের স্থায়ীকরণ, ৭) পেট্রল–ডিজেল–রান্ন গ্যাসের দাম ও বিদ্যুৎ মাশুল কমানো, ৮) চিকিৎসা ক্ষেত্রের বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ, ৯) চিটফান্ড প্রতারিতদের টাকা সুদ সহ ফেরত ও দোষীদের শাস্তি, ১০) ধর্মীয় বিভাজন, মানবাধিকার লঙঘন বন্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশি হস্তক্ষেপ বন্ধ করবে হবে৷ |
এ রাজ্যে নির্বাচনের বহু আগে থেকেই এস ইউ সি আই (সি) জনজীবনের নির্দিষ্ট দাবিগুলি নিয়ে আন্দোলনের মধ্যেই ছিল৷ নির্বাচন শেষ হতেই মানুষকে দেওয়া আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা আবার আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছে৷ বিজেপি এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে চাইছে, অথচ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যাগুলি নিয়ে লড়াইয়ে তারা মানুষের পাশে নেই৷ কারণ মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, নারী নির্যাতন, শিক্ষা–স্বাস্থ্য সহ জনজীবনের সমস্যাগুলি কেন্দ্রে তাদের সরকারি নীতির ফলেই ঘটছে৷ সিপিএম বহু আগে থেকেই আন্দোলনের রাস্তা থেকে সরে গিয়ে কংগ্রেসের হাত ধরে একটি–দু’টি আসন জিতে কোনওরকমে মান রক্ষায় ব্যস্ত৷ এই অবস্থায় এস ইউ সি আই (সি) এ রাজ্যে অবিলম্বে প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালু, সমস্ত বেকারের কাজ, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, মদ নিষিদ্ধ করা, নারী নির্যাতন ও শিশুপাচার বন্ধ, বন্ধ কলকারখানাগুলি খোলা, বিদ্যুৎ মাশুল কমানো, চিকিৎসা ক্ষেত্রের বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করা সহ দশ দফা দাবিতে রাজ্যব্যাপী স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানের ডাক দিয়েছে৷
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার স্কুল স্তরে পাশ–ফেল চালু করার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন টালবাহানা করে অবশেষে ‘শিক্ষা অধিকার আইন–২০০৯’ সংশোধন করে ‘নো ডিটেনশন পলিসি’ বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল৷ কিন্তু তারা প্রস্তাব করল শুধুমাত্র পঞ্চম শ্রেণি ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল রাখা হবে৷ সেখানেও যারা ফেল করবে তাদের ‘রিমেডিয়াল ক্লাসের’ ব্যবস্থা করে দু–মাস পরে আরেকবার পরীক্ষায় বসার সুযোগ দিতে হবে৷ যারা এক বছর পড়ে পাশ করতে পারবে না, তারা কেমন করে দু–মাসের মধ্যে পাশ করে যাবে?
আসলে পাশ করিয়ে দেওয়ার ছুতোয় তাদের উদ্দেশ্য শিক্ষার মানকে টেনে নামানো, যাতে অভিভাবকরা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাধ্য হয়ে তাদের বেসরকারি সুক্লে ভর্তি করে৷ এ ভাবেই শিক্ষার বেসরকারিকরণ নীতিকে সরকার কার্যকর করতে চাইছে৷ রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল এবং বিজেপি ভোটের লড়াইয়ে পরস্পর রণং দেহি মনোভাব দেখালেও শিক্ষার এই প্রশ্নে একই কুযুক্তি এবং টালবাহানা করে যাচ্ছে৷ সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, সরকারি স্কুলে ছাত্রসংখ্যা দ্রুত হারে কমছে, বাড়ছে শিক্ষা নিয়ে বেসরকারি ব্যবসা৷ একই ভাবে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বেসরকারিকরণ বাড়ছে৷ ধুঁকছে সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো৷ প্রতিদিন চিকিৎসা করাতে আসা হাজার হাজার গরিব রোগীদের তুলনায় ডাক্তার, নার্সদের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়৷ ফলে প্রায়শই তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে৷ সরকারি হাসপাতালের চরম অব্যবস্থায় গরিব মানুষকে ছুটতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালের দরজায়৷
এস ইউ সি আই (সি) বিহার, মিজোরামের মতো এ রাজ্যেও মদ নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়েছে৷ মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনা, গার্হস্থ্য হিংসা, ইভটিজিং, এলাকায় দাদাগিরি এখন স্বাভাবিক ঘটনা৷ প্রতিদিন মিডিয়াতে এবং সংবাদপত্রের পাতায় নানা নৃশংস ঘটনার আমরা সাক্ষী হচ্ছি৷ এগুলি যেন কিছুটা গা–সওয়া হয়ে যাচ্ছে৷ সামাজিক নৃশংসতা যেন ক্রমশই নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুষ্কৃতীরা মদ্যপ হয়ে এই কাজ করছে৷ অথচ মদের প্রসারে উৎসাহ জোগানো হচ্ছে৷ এ রাজ্যে বছরে মদ থেকে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ১০,০০০ কোটি টাকা৷ আরও বারোশো মদের দোকান সরকার মফঃস্বল শহরগুলিতে খুলতে চাইছে, যা নির্বাচনের আগে আন্দোলনের চাপে সরকার স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছিল৷ গোটা দেশে রাজ্য সরকারগুলির মদ বাবদ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ নব্বই হাজার কোটি টাকা৷ এর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ভ্যাট বাবদ মোটা টাকা আদায় করে৷
গোটা দেশেই নারী নির্যাতনের ঘটনা দ্রুত হারে বাড়ছে৷ এ রাজ্যের অবস্থানও উপরের দিকে৷ নারী ও শিশুপাচারে এই রাজ্য শীর্ষস্থানে৷ শাসকদল ও প্রভাবশালীদের মদতে, প্রশাসনের অসহযোগিতায় এবং সামাজিক প্রতিরোধ না থাকায় বেশিরভাগ ঘটনাই আড়ালে থেকে যায়৷ যেগুলি প্রকাশ্যে আসে, সেগুলিও বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় মাঝপথে অদৃশ্য হয়ে যায়৷
পুঁজিবাদী অর্থনীতির শোষণের ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশই কমছে, তার ফলে গড়ে উঠছে না কোনও নতুন শিল্প৷ উল্টে চালু শিল্পগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে৷ বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারি সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে৷ প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও চাকরি দিতে না পারায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যুবকদের ‘চপ ও পকোড়া ভাজার’ পরামর্শ দিচ্ছেন৷ কৃষকেরা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না৷ অথচ চাষের খরচ, সার–বীজ–কীটনাশকে দাম বাড়ছে৷ ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচের খরচ বাড়ছে৷ তার উপর আছে অনাবৃষ্টি–অতিবৃষ্টিজনিত ফসলের ক্ষতি৷ সরকারের ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’তে ফড়েরাজ, কালোবাজারি, মজুতদারি চলছে অবাধে৷ ঋণগ্রস্ত কৃষক আত্মহত্যা করছে কিংবা বহুজাতিক পুঁজির খপ্পরে গিয়ে পড়ছে৷
বন্ধ কারখানা খোলার আশায় অসহায় শ্রমিক দিন কাটাচ্ছে৷ শ্রমিকদের ৯৫ শতাংশই অসংগঠিত৷ যাদের নেই কোনও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, জুটছে না ন্যূনতম ১৮ হাজার টাকা মাসিক বেতন৷ বর্তমান শ্রম আইনে যতুটুক সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে, আগামী বাজেট অধিবেশনে তাও থাকবে না বলে বিপুল গরিষ্ঠতায় জিতে আসা দ্বিতীয় মোদি সরকার শিল্পপতিদের আশ্বস্ত করেছেন৷
জনজীবনের এই চরম সংকটে এস ইউ সি আই (সি)–র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি আহ্বান করেছে আন্দোলনে নামার৷ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদ্দেশে দাবিপত্রে স্বাক্ষর সংগ্রহের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের পক্ষে জনমতকে সংহত করা হবে৷ জনগণকে ভাবতে হবে ভোটাধিকার প্রয়োগই জনগণের একমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকার নয়, সামাজিক সমস্যাগুলির সমাধানে সোচ্চার হওয়া, সংগঠিত হওয়া, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা একটি নাগরিকের যথার্থ গণতান্ত্রিক চেতনার পরিচয়৷ পুঁজিপতিদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার মদতে ক্ষমতায় বসা শাসকদলগুলি তাদের স্বার্থকেই পূরণের চেষ্টা করবে৷ জনস্বার্থকে রক্ষা করতে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে৷ একক শক্তিতে নয়, সংগঠিত আন্দোলনের শক্তিতে ছিনিয়ে নিতে হবে তার অধিকার, তার দাবি৷