জনগণের বিকল্প শিক্ষানীতির খসড়া প্রকাশ অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটির

দিল্লির প্রেস ক্লাবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা জনগণের শিক্ষানীতির খসড়া প্রকাশ করছেন। ২২ মে

কেন্দ্রীয় সরকারের আনা জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সারা ভারত জুড়েই শিক্ষাবিদ-শিক্ষানুরাগী মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তাঁদের সকলের প্রতিবাদকে ভাষা দিয়ে ২২ মে ‘জনগণের শিক্ষানীতি’-র খসড়া প্রকাশ করল অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি। দিনটি ছিল ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ রামমোহন রায়ের ২৫৪তম জন্মদিন। ওই দিন দেশের ১৮টি শহরে একযোগে এই খসড়া জনগণের শিক্ষানীতি প্রকাশ করল কমিটি। কলকাতা ছাড়াও নয়াদিল্লি, আহমেদাবাদ, ভোপাল, ভুবনেশ্বর, পাটনা, দ্বারভাঙা, মজফফরপুর, ডালহৌসি (হিমাচল প্রদেশ), গৌহাটি, আগরতলা, শিলং, চেন্নাই, কোচি, বাঙ্গালোর, অনন্তপুর, হায়দ্রাবাদ, প্রতাপগড় (উত্তরপ্রদেশ) থেকে একযোগে প্রকাশিত হয় এই খসড়া।

কলকাতা প্রেস ক্লাবে জনগণের বিকল্প শিক্ষানীতির খসড়া প্রকাশ করছেন বিশিষ্টজনেরা। ২২ মে

কলকাতা প্রেস ক্লাবে এই সংক্রান্ত সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন– জহর সরকার (প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষাসচিব ও প্রসার ভারতীর অধিকর্তা), মীরাতুন নাহার, অলক ব্যানার্জী (প্রাক্তন উপাচার্য), চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী (প্রাক্তন উপাচার্য), অধ্যাপক ধ্রুজ্যোতি মুখার্জী, অধ্যাপক প্রভাত দত্ত, অধ্যাপক শান্তনু রায়, অধ্যাপক তরুণ কান্তি নস্কর (সাধারণ সম্পাদক অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি), বিশ্বজিৎ মিত্র (সম্পাদক, সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটি)।

উল্লেখ্য যে, বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় ২০২০-র জুলাইতে করোনা অতিমারির কারণে চলা লকডাউনের মধ্যে সংসদকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে কেবলমাত্র মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষা যুগ্ম তালিকার আওতায় থাকলেও নীতি প্রণয়নের সময় রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে আলোচনাটুকুও তারা করেনি। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনসাধারণের মতামত চাইবার কথা সরকার দায়সারাভাবে বললেও একমাত্র বিজেপি সংঘ পরিবার ঘনিষ্ঠ মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া বাকি সকলের মত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছিল।

দেশের প্রথম সারির বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষাপ্রেমী মানুষের কথায় কোনও রকম কর্ণপাত না করেই কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির উপর জোর করে এই নীতি চাপিয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও বলেছে, কোনও রাজ্য না চাইলে সেখানে জোর করে কেন্দ্রীয় সরকার এই নীতি চাপিয়ে দিতে পারবে না। শিক্ষাবিদ, শিক্ষানুরাগী মানুষ, ছাত্র সমাজের অংশগ্রহণে অসংখ্য শিক্ষা সম্মেলন থেকে বারবার উঠে এসেছে যে, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ প্রয়োগ করে কেন্দ্রীয় সরকার আসলে ভারতের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্রমশ ব্যবসায়ীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওই সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের শিক্ষানীতি চাপিয়ে দিয়েছে জোর করে। কিন্তু সেভ এডুকেশন কমিটি এই ‘খসড়া জনগণের শিক্ষানীতি ২০২৫’ সম্পর্কে ৬ মাস ধরে দেশব্যাপী সমস্ত শিক্ষাপ্রেমী মানুষের কাছে আলোচনার জন্য নিয়ে যাবে। জনগণের বিভিন্ন অংশের কাছ থেকে আসা সংশোধনী, মতামত, পরামর্শ গ্রহণ করবে। কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি (ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি বা নেপ) নিয়ে সংসদে আলোচনা করেনি। সেভ এডুকেশন কমিটি চায় সকলের সাথে আলোচনা করে ২০২৬-এর জানুয়ারিতে বাঙ্গালোরে এই উদ্দেশ্যে ডাকা জাতীয় গণ সংসদের (ন্যাশনাল পিপলস পার্লামেন্ট) সামনে এটি পেশ করে তার চূড়ান্ত রূপ দিতে। এর মাধ্যমেই তৈরি হবে বিকল্প জনগণের শিক্ষানীতি পিপলস এডুকেশন পলিসি (পেপ)– এর পরে যা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির কাছে জমা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কার্যকরী করার দাবি জানানো হবে।

জহর সরকার বিকল্প শিক্ষানীতির খসড়াটি প্রকাশ করে বলেন, শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার অস্বীকার করছে। এখনও পর্যন্ত কোনও সরকার জিডিপি-র ৬ শতাংশ শিক্ষার জন্য ব্যয়ের ব্যবস্থা করেনি। তিনি আরও বলেন, তিন ভাষা নীতির মাধ্যমে হিন্দি চাপানোর চেষ্টা চলছে। তিনি সাংবাদিক সহ সকলের কাছে এই খসড়া শিক্ষানীতি ভাল করে পড়ে মতামত দেওয়ার আহ্বান জানান।

অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় বলেন, কেন্দ্রীয় জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষাকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কুক্ষিগত করার একটি দলিল। অধ্যাপক চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী এই বিকল্প শিক্ষানীতির প্রস্তুতিতে দীর্ঘ সময় ধরে বহু শিক্ষাবিদের সার্বিক প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন।

নেপ এবং পেপ কোথায় আলাদা

কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি ও বিকল্প জনগণের শিক্ষানীতির পার্থক্য তুলে ধরে শিক্ষাবিদরা সাংবাদিক সম্মেলনে দেখান—

১) নেপ সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক, বিজ্ঞানবিরোধী, বেসরকারিকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণ ভিত্তিক শিক্ষার সুপারিশ করেছে। বিপরীতে পেপ ধর্মনিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক, গণতান্ত্রিক এবং সর্বজনীন শিক্ষার প্রস্তাব করছে।

২) নেপ প্রবর্তনের পর কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট বরাদ্দ হ্রাস পেয়ে সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। অন্যদিকে পেপ কেন্দ্রীয় বাজেটের কমপক্ষে ১০ শতাংশ এবং রাজ্য বাজেটের ২০-২৫ শতাংশ শিক্ষার জন্য বরাদ্দের পক্ষে। শিক্ষার সম্পূর্ণ আর্থিক দায়িত্ব সরকারের নেওয়া উচিত বলে পেপ মনে করে।

৩) পেপ মনে করে ভারতের মতো একটি বহু ধরনের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণের বৈচিত্র্য সংবলিত দেশে এক ছাঁচে ঢালা শিক্ষাব্যবস্থা কোনও মতেই উপযুক্ত নয়। তাই এই বিকল্প নীতিতে শিক্ষাকে সংবিধানের যুগ্ম তালিকা থেকে সরিয়ে আবার রাজ্য তালিকাভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। সেই অনুযায়ী ভারতীয় সংবিধান পুনরায় সংশোধন করার দাবি করা হয়েছে। এ বিষয়ে নেপ নীরব শুধু নয়, কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত বৈচিত্র্য মুছে দিয়ে শিক্ষাকে কুক্ষিগত করতেই আগ্রহী।

৪) পেপ সরকারের কাছে দাবি করেছে পাহাড়ি অঞ্চল, বনাঞ্চল, মরুভূমি, সীমান্ত এলাকার মতো দূরবর্তী এবং দুর্গম অঞ্চলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে।

৫) পেপ দাবি করেছে ২০০৯-এর শিক্ষার অধিকার আইনের পরিবর্তে এমন আইন আনতে হবে যাতে ৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী সকলের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়।

৬) এই বিকল্প শিক্ষানীতি ১০+২ স্তরের স্কুল শিক্ষা এবং ঐচ্ছিক হিসাবে দুই বছরের প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির প্রস্তাবিত ৫+৩+৩+৪ প্যাটার্নের বিরোধিতা করেছে বিকল্প শিক্ষানীতি। কারণ এতে এ দেশের অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের সন্তানের পক্ষে উচ্চশিক্ষায় যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এই বিকল্প শিক্ষানীতির যে ১৮ দফা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে তাতে আরও বলা হয়েছে, ৪ বছরের বদলে ৩ বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু রাখা, মাল্টিপল এন্ট্রি-একজিট ব্যবস্থা বন্ধ করা, অবৈজ্ঞানিক মাল্টি ডিসিপ্লিনারি পদ্ধতি বা তথাকথিত কাফেটারিয়া পদ্ধতিতে ইচ্ছামতো যখন তখন যে কোনও বিষয় নির্বাচনের অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি রাখা চলবে না। স্নাতকোত্তর কোর্স দুই বছরেই রাখা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেমিস্টারের বদলে বার্ষিক পরীক্ষা, মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং এমফিল ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।

এই বিকল্প শিক্ষানীতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রেডেড অটোনমির মতো ফাঁকা কথার বিপরীতে সম্পূর্ণ স্বাধিকারের কথা বলেছে। রাজনৈতিক ও সরকারি হস্তক্ষেপের বদলে শিক্ষাবিদদের মাধ্যমেই শিক্ষা পরিচালনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। শিক্ষকদের ফেসিলিটেটর বা নিছক তত্ত্বাবধায়কে পর্যবসিত করার বদলে অভিভাবক, পথপ্রদর্শক, পরামর্শদাতা হিসাবে তুলে ধরার কথা বলেছে বিকল্প শিক্ষানীতি। অনলাইন বা হাইব্রিড শিক্ষা পদ্ধতিকেই প্রধান করার বদলে মূলত শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ওপর জোর দিতে বলেছে জনগণের শিক্ষানীতি। সিইউইটি, নিট ইত্যাদি কেন্দ্রীয় পরীক্ষার বদলে বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক ভর্তির ব্যবস্থার দাবি করেছেন শিক্ষাবিদরা। কেন্দ্রীয় সরকারের ত্রিভাষা নীতির বিরোধিতা করে বলা হয়েছে মাতৃভাষা ও ইংরেজির ওপর যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাষানীতি চালু করতে সচেষ্ট হবে এই বিকল্প শিক্ষানীতি। এ ছাড়াও ভারতীয় জ্ঞান প্রণালী বা ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের নামে বিকৃত ইতিহাস ও ছদ্ম বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে কুসংস্কার কূপমণ্ডুকতা প্রসারের বিরোধিতা করে বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস ও বিজ্ঞানের সঠিক সিলেবাসের খসড়া এতে তুলে ধরা হয়েছে। এই জনগণের শিক্ষানীতি সামনে এনে উপস্থিত শিক্ষাবিদরা মনে করিয়ে দেন, এর জন্য যথাযথভাবে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ জরুরি। কেননা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, তাদের আদানপ্রদান, মানবিক স্পর্শ শিক্ষা ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি বিষয়।

দিল্লিতে এই বিকল্প শিক্ষানীতি প্রকাশের অনুষ্ঠান হয় প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ায়। উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ সিনহা, অধ্যাপক অরুণ কুমার, অধ্যাপক নন্দিতা নারাইন, অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতি প্রমুখ। ভুবনেশ্বরে ছিলেন অধ্যাপক বীরেন্দ্র নায়েক, সুভাষ নায়েক, রমেশ নায়েক প্রমুখ। কেরালার কোচিতে ছিলেন অধ্যাপক এম কে শানু, অধ্যাপক অরবিন্দাক্ষণ, অধ্যাপক জর্জ যোসেফ, শান্তি রাজ।

বাঙ্গালোরে ছিলেন আলামপ্রভু বেত্রাদুরু, ভি এন রাজাশেখর, আসামে ছিলেন অধ্যাপক ত্রিদিব গগৈ, অধ্যাপক প্রদীপ মহাপাত্র। শিলংয়ে ছিলেন অধ্যাপক এইচ শ্রীকান্ত, আগরতলায় ছিলেন হরকিশোর ভৌমিক, আহমেদাবাদে ছিলেন কমিটির সর্বভারতীয় সভাপতি প্রকাশ এন শাহ, ভাবিক রাজা। চেন্নাইয়ে ছিলেন অধ্যাপক কে যোগরাজন, ডালহৌসিতে ছিলেন জগজিৎ সিং আজাদ, ঋতু কৌশিক প্রমুখ।

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৩০ মে – ৫ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত