(কাঠুয়া ও উন্নাওয়ের ধর্ষণকান্ড এবং সে বিষয়ে শাসক দল ও সরকারি প্রশাসনের জঘন্য ভূমিকার নিন্দা করে ৫০ জন অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখেন যেটি ১৬ এপ্রিল দি হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ চিঠিটির অনুবাদ প্রকাশ করা হল)৷
আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং উদারনৈতিক মূল্যবোধের যে কথাগুলো বলা রয়েছে তার অবনমন প্রসঙ্গে গত বছর আমরা কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম৷ সরকারি প্রতিষ্ঠানের মদতে পরিকল্পিত ভাবে যে বিদ্বেষ, আতঙ্ক এবং অসহিষ্ণুতার ভয়ঙ্কর প্রবণতা উসকে দেওয়া হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিবাদে সামিল হতে চেয়েছিলাম আমরা৷ যাঁরা কোনও রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত নন, এমনকী সাংবিধানিক মূল্যবোধ ছাড়া কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শেরও অনুগত নন, তেমন নাগরিক হিসাবে তখন আমরা যেমন বলেছিলাম, এখনও তেমন বলছি ৷
আমাদের আশা ছিল যে, সংবিধানকে মর্যাদার সাথে রক্ষা করার শপথ নেওয়া আপনি, আপনার সরকার এবং আপনার দল এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সজাগ হবেন, বর্বরতাকে দমন করতে এগিয়ে আসবেন এবং পুনরায় আশ্বস্ত করবেন প্রত্যেককে, বিশেষত সংখ্যালঘু এবং সমাজের অরক্ষিত অংশকে, এই বলে যে, জীবন–জীবিকা নিয়ে তাঁদের ভয়ের কোনও কারণ নেই৷ কিন্তু সে আশা ভেঙে তছনছ হয়ে গেল৷ কাঠুয়া এবং উন্নাও–এর পৈশাচিক ঘটনা দেখিয়ে দিল, জনগণের দেওয়া ন্যূনতম দায়িত্বভার পালনেও সরকার ব্যর্থ৷ যার ফলে, যে জাতি নৈতিকতা, অধ্যাত্মিকতা এবং সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করত, যে সমাজ সমৃদ্ধ ছিল সহনশীল, সহমর্মী এবং সহযোগী ভাবনায়, তা নস্যাৎ হয়ে গেল৷ হিন্দুদের নাম করে একজন মানুষের বিরুদ্ধে আরেকজন মানুষের বর্বরতাকে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা মানব জাতি হিসাবে ব্যর্থ হলাম৷
আট বছরের এক শিশুকে প্রথমে ধর্ষণ এবং তারপর খুন– এই পাশবিকতা ও বর্বরতা দেখাল দুষ্কর্মের কোন গভীরে আমরা ডুবে আছি৷ স্বাধীনতা–উত্তর ভারতে এ হল সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়৷ এর দায় আমাদের সরকারের, আমাদের অযোগ্য এবং হীনবল রাজনৈতিক নেতাদের৷ এই পরিস্থিতিতে, সুড়ঙ্গের শেষে আমরা কোনও আলো দেখছি না, লজ্জায় মাথা নত করে আছি৷ আমাদের লজ্জাবোধটা আরও তীব্র কারণ আমাদের তরুণ সহকর্মীরা যাঁরা এখনও চাকরিতে রয়েছেন বিশেষত যাঁরা জেলাস্তরে আইনত দুর্বল ও অরক্ষিতদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কর্মরত, মনে হয় তাঁরাও তাঁদের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে৷
প্রধানমন্ত্রী মহোদয়, এই চিঠি কেবলমাত্র আমাদের সম্মিলিত লজ্জা, বিষাদ বা যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ নয়৷ মানবসভ্যতার মূল্যবোধের অবনমনে নিছক শোকপ্রকাশও নয়– বরং এ হল আমাদের ক্ষোভের প্রকাশ৷ ক্ষোভের কারণ, আপনার দল এবং তার অসংখ্য শাখা ভারতের রাজনীতির মূলে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, এমনকী দৈনন্দিন জীবনযাপনেও পরিকল্পনা করে ঘৃণা এবং বিভাজন ছড়াচ্ছে৷ এই কারণেই কাঠুয়া এবং উন্নাও–এর মতো ঘটনা ঘটছে৷
সংঘ পরিবার, যারা উন্মত্ত ধর্মান্ধতাকে উসকাচ্ছে নিজেদের হীন কার্যকলাপ চরিতার্থ করার জন্য, জম্মুর কাঠুয়ায় তারা সংখ্যাগুরুর পক্ষ থেকে একটা যুদ্ধ এবং মারমুখী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে৷ তারা জানে তাদের কার্যকলাপে শাসক দল এবং হিন্দু–মুসলিম বিভাজনের রাজনীতি ভাঙিয়ে আখের গোছায় এমন সকলেই মদত দেবে৷ উত্তরপ্রদেশের উন্নাও–এ গদি দখলের জন্য মাফিয়া ডন–নির্ভর আধিপত্যকামী রাজনীতি এমন লোককে তৈরি করেছে যারা নিজেদের ক্ষমতা জাহিরের জন্য ইচ্ছামতো তোলাবাজি–খুন–ধর্ষণ করে বেড়ায়৷ কিন্তু ক্ষমতার এই ঘৃণ্য প্রয়োগের চেয়েও নিন্দনীয় হল, রাজ্য সরকার দোষীর পরিবর্তে ধর্ষিতা এবং তার পরিবারকে হয়রান করছে৷ এটা প্রমাণ করে, কী দুঃশাসন জন্ম নিয়েছে৷ উত্তরপ্রদেশ হাইকোর্ট নির্দেশ দেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত সরকার যে বাধ্য হল কিছু করতে, এটাও সরকারের চরম উদাসীনতা এবং নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দেয়৷
প্রধানমন্ত্রী মহোদয়, দুটি ক্ষেত্রেই আপনার দল ক্ষমতায়৷ দলের মধ্যে আপনার আধিপত্য এবং দলের ওপর আপনার ও সভাপতি মহোদয়ের যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ, তাতে সাম্প্রতিক এই ভয়াবহ ঘটনাসমূহের জন্য আপনাকেই দায় স্বীকার করতে হবে৷ তা না করে, কোনও ক্ষতিপূরণ না করে আপনি গতকাল অবধি নীরব থাকলেন৷ যখন দেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ল একমাত্র তখনই আর এড়াতে না পেরে আপনি মুখ খুলতে বাধ্য হলেন৷
এমনকী তারপরও, যখন আপনি উক্ত ঘটনার জন্য নিন্দা এবং লজ্জা প্রকাশ করলেন তখন কিন্তু এর পিছনের সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের নিন্দা করলেন না৷ যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ইন্ধন পাচ্ছে, তার সমাধান নিয়েও কিছু বললেন না৷ একদিকে এই বিলম্বিত দুঃখপ্রকাশ বা ন্যায় প্রদানের প্রতিশ্রুতি আমরা বার বার শুনছি, আর অন্যদিকে সংঘ পরিবারের মদতে নানা শক্তি লাগাতার সাম্প্রদায়িক আগুন জ্বালিয়ে রাখছে৷
প্রধানমন্ত্রী মহোদয়, উল্লিখিত দুটি ঘটনা কোনও সাধারণ অপরাধ নয় যা কিছুদিন পর আমরা ভুলে যাব বা যাকে আমাদের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং নৈতিক কাঠামো দ্রুত স্বাভাবিক করে দেবে৷ এটা একটা অস্তিত্ব সংকটের কাল, একটা সন্ধিক্ষণের মুহূর্ত– এ সময়ে সরকার যেমন আচরণ করবে তা দিয়েই নির্ধারিত হবে জাতি হিসাবে প্রজাতন্ত্র হিসাবে সাংবিধানিক মূল্যবোধের অবনমন ঠেকাবার এবং প্রশাসনের নৈতিক আধার অটুট রাখার যোগ্যতা আমাদের আছে কি না৷
সেই কারণেই, পরিশেষে আপনার প্রতি আবেদন, নিম্নলিখিত কর্তব্য পালন করুন :
(১) কাঠুয়ার ও উন্নাও–এ আক্রান্ত পরিবারগুলির কাছে যান এবং তাঁদের কাছে আমাদের সকলের পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন৷ (২) কাঠুয়ার অপরাধীদের বিচার দ্রুত করুন এবং উন্নাও–এর ক্ষেত্রে বিশেষ তদন্তকারী দলের আবেদন করুন৷ (৩) উগ্র বিদ্বেষে নিহত শিশু এবং অন্য সকলের স্মরণে পুনরায় শপথ নিয়ে মুসলিম, দলিত–সহ সব ধরনের সংখ্যালঘু মানুষের, শিশু ও মহিলার নিরাপত্তা দিন যাতে তারা স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনে ভয় না পায়৷ এতে কোনও গাফিলতি হলে রাষ্ট্রবলে তা নির্মূল করুন৷ (৪) বক্তৃতায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে বা সংখ্যালঘু–নির্যাতনে জড়িতদের সরকার থেকে বহিষ্কারে পদক্ষেপ করুন৷ (৫) সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দিক থেকে কীভাবে সংখ্যালঘু–নির্যাতন সামলানো যায় সে বিষয়ে সমস্ত দলের মিটিং আহ্বান করুন৷ হতে পারে, এত সব করেও খুব সামান্যই ফল পাওয়া গেল, কিন্তু অন্তত কিছুটা শুভবোধ এবং আশা জন্মাবে, কোনও নৈরাজ্য বরদাস্ত করা হবে না৷ আমরা তো আশাতেই বাঁচি৷
স্বাক্ষর : হর্ষ মান্দার, চন্দ্রশেখর বালাকৃষ্ণ, মীনা গুপ্তা, সাজ্জাদ হাসান, অরুণা রায় সহ ৫০ জন৷
(৭১ বর্ষ ৭ সংখ্যা ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)