অতিক্রান্ত হল ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের ৬ মাস। গণআন্দোলনের ইতিহাসে তৈরি হল এক অনন্য নজির। খোলা আকাশের নিচে ভয়ঙ্কর শীত, প্রবল গ্রীষ্ম এবং ভয়ঙ্কর অতিমারির মধ্যে দাবি আদায়ের লক্ষে্য অটুট থাকা সহজ বিষয় নয়। ইতিমধ্যে কয়েক শত সহযোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন। আরও কত জনকে প্রাণ দিতে হবে কারও জানা নেই। এই আন্দোলন একই সাথে বিজেপি সরকারের চরম অগণতান্ত্রিক চরিত্রটাকেও নগ্ন করে দিয়েছে। কৃষি আইনের পিছনে কৃষক-কল্যাণের প্রচারটি কত বড় মিথ্যা, আন্দোলনরত কৃষকদের প্রতি সরকারের মনোভাবেই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে।
অসম সাহসী এই আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে ২৬ মে ছয় মাস পূর্তির দিনটিতে সংযুক্ত কিসান মোর্চার ডাকে দেশ জুড়ে পালিত হল কালা দিবস। কৃষক সংগঠন এআইকেকেএমএস সহ নানা সংগঠনের উদ্যোগে দেশের সর্বত্র দিনটি পালিত হয় বিজেপি সরকারের কৃষক স্বার্থবিরোধী কালা আইন চালুর চেষ্টাকে ধিক্কার জানিয়ে। ওই দিন সারা দেশে কালো পতাকা তুলে মানুষ ধিক্কার জানিয়েছে বিজেপি সরকারের নীতিকে। এস ইউ সি আই (সি) দিনটিকে সর্বাত্মক সফল করার জন্য মানুষের কাছে আহ্বান জানিয়েছিল। লকডাউনের মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ সহ নেতা-কর্মীরা অনলাইনে কালা দিবসের দাবিগুলি তুলে ধরেন।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার অতিমারি করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের সুযোগ নিয়ে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে পার্লামেন্টে কোনও আলোচনা ছাড়াই চূড়ান্ত কৃষক স্বার্থবিরোধী তিনটি কৃষি আইন পাশ করিয়ে নেয়। এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে কৃষকরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। সরকার এই প্রতিবাদে কর্ণপাত না করায় দেশের কৃষকরা সূচনা করলেন এক নজিরবিহীন আন্দোলনের। কৃষক এবং দেশের মেহনতি জনতার স্বার্থ-বিরোধী কালা কৃষি আইনের প্রতিরোধে ২৬ নভেম্বর দিল্লি অভিযানের ডাক দেয় দেশের কৃষক সংগঠনগুলির সংযুক্ত মোর্চা। আহ্বানে সাড়া দিয়ে নারী, পুরুষ, শিশু থেকে বৃদ্ধ অগণিত মানুষ রাজধানীর উপকণ্ঠে পৌঁছন। ওই দিনই কৃষক সংগঠনগুলির ডাকে সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়। শত অত্যাচার করেও সরকার প্রতিবাদী কৃষকদের প্রতিবাদকে ভাঙতে পারেনি। দিল্লিতে ঢোকার রাস্তা সরকার ব্যারিকেড করে বন্ধ করায় দিল্লি সীমান্ত ঘিরেই শুরু হয় ঐতিহাসিক ধরনা। তা ৬ মাস পার করেও অব্যাহত রয়েছে। যত দিন যাচ্ছে কৃষকদের মনোবল ততই মজবুত হচ্ছে।
মোদি সরকার দেখানোর চেষ্টা করছে এই আইন তাঁরা কৃষকদের কল্যাণের জন্যই নিয়ে এসেছে। কেমন কল্যাণ? এই আইনের বলে চুক্তি চাষের ভিত্তিতে ব্রিটিশ আমলের নীলকর শাসনের পুনঃপ্রবর্তন ঘটাবে দেশি-বিদেশি কর্পোরেটরা। কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পাবে না। কর্পোরেটদের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে কোনও আদালতে আবেদন করা যাবে না, যেতে হবে আমলাদের কাছে। ঋণের ফাঁদে পড়ে কৃষকের মৃত্যু ও আত্মহত্যার মিছিল শুরু হবে। এই ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এই আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা আরও স্পষ্ট হল যখন এই আইন চালু হওয়ার কিছুদিন আগেই দেখা গেল, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে কৃষিপণ্য মজুত করা ও তা নিয়ে খাদ্য ও ভোগ্যদ্রব্য উৎপাদন এবং বাণিজ্য করার জন্য বৃহদাকার ভাণ্ডার ও তৎসংলগ্ন কারখানা তৈরি করেছে আম্বানি ও আদানির মতো ধনকুবের কর্পোরেট মালিকরা। অর্থাৎ সরকারের সাথে আম্বানি-আদানিদের আগাম বোঝাপড়া হয়েই ছিল। তার ভিত্তিতেই এই কৃষি আইনগুলি আনা হয়েছে। ফলে কৃষক এবং সাধারণ মানুষ নিশ্চিত হয়ে যান এই আইনের বলে সরকার কৃষি ব্যবস্থাটাকেই একচেটিয়া কর্পোরেট মালিকদের হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর। এই আইনে একদিকে কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধির ঢালাও ছাড়পত্র তারা কর্পোরেটদের দিয়েছে, অন্য দিকে চাষিদের কাছ থেকে সস্তা দরে সমস্ত ফসল কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এ ষড়যন্ত্র আরও পরিষ্কার হল যখন, সরকার প্রায় কাছাকাছি সময় ‘বিদ্যুৎ আইন সংশোধনী-২০২০’ নিয়ে এল। কৃষি উৎপাদনের জন্য দীর্ঘকাল বিভিন্ন রাজ্যে সস্তায় বা বিনামূল্যে বিদ্যুতের যে সরবরাহ চলে আসছিল, তা বন্ধ করে দিয়ে সরকার কর্পোরেটদের হাতেই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা তুলে দিয়ে তাদের বিপুল মুনাফা করার সুযোগ করে দিল। এ যেন অক্টোপাসের মতো চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে কৃষক ও সাধারণ মানুষের উপর পরিকল্পিত আক্রমণ। তা রোখবার জন্যই কৃষকরা দিল্লি অভিযানের ডাক দেন।
লাগাতার লড়াইয়ের নানা অভিজ্ঞতা, কৃষক সংগঠনগুলির সদস্যদের মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন আজ উন্নত চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে। আন্দোলনের বর্শামুখ সেই কারণে কেবল সরকারের দিকে নয়, তা কর্পোরেট দুনিয়ার নির্মম শোষণের বিরুদ্ধেও। এই আন্দোলনের একটা বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে, তাঁরা মূল শত্রুকে চেনবার চেষ্টা করছেন। তারা ধরতে পারছেন, সরকারের পিছনে রয়েছে একচেটিয়া পুঁজির মালিকেরা, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শাসন মানে আসলে জনগণকে শোষণ। পুঁজিপতিদের সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থেই যে বুর্জোয়া রাষ্ট্র, সরকার এবং তার আইন-আদালত-প্রশাসন চলে এ সত্য অনেকটা তাঁরা ধরতে পারছেন।
কিসান মোর্চা ঘোষণা করেছে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন জারি থাকবে। চলছে বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের বয়কট, আম্বানি-আদানিদের পেCল-ডিজেল পাম্প বয়কটও চলছে। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আহ্বান নিয়ে সভা, সমিতি, মহাপঞ্চায়েত করেছেন। প্রচুর অর্থ ও প্রচার করেও বিজেপি জনরোষে বিভিন্ন জায়গায় গো-হারা হেরেছে। হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েত নির্বাচনে, পাঞ্জাবে পৌরসভা নির্বাচনে এবং পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়েছে বিজেপি। তবুও তারা মরিয়া। কারণ আম্বানি-আদানিদের কাছে তারা চুক্তিবদ্ধ।
আজ আবারও করোনা পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে বিজেপি সরকার ওত পেতে রয়েছে– কোনওভাবে যদি চলমান কৃষক আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায়। বিজেপি নেতাদের পক্ষ থেকে ছদ্ম উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে যে, এই অতিমারির সময়ে তাঁরা যেন আন্দোলন তুলে নেন। অতিমারি শেষ হলে আবার তাঁরা এসে ধরনায় বসবেন। বাস্তবে করোনাকে অজুহাত করে সরকার আন্দোলনকে ভাঙতে চায়। কৃষকরা জানিয়েছেন, তাঁর সব রকমের সাবধানতা নিয়েই আন্দোলন চালাচ্ছেন, তাঁদের জন্য উদ্বিগ্ন না হয়ে সরকার যেন দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, ওষুধ, অক্সিজেন এবং ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করে। আর সরকার যদি সত্যিই উদ্বিগ্ন হয় তবে অবিলম্বে কালা কৃষি আইন তুলে নিয়ে কৃষকদের সাথে আলোচনায় বসুক। কৃষকরা আন্দোলনকে আরও জোরদার করার সব রকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ঐতিহাসিক এই আন্দোলনকে সাফল্যের দরজায় পৌছে দিতে আজ প্রত্যেক দেশবাসীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সজাগ ভূমিকা প্রয়োজন।