পাশ করলেই ভর্তি হওয়া যাবে না৷ বেশি নম্বর পেলেও নয়৷ তোলাবাজদের খুশি করার মতো টাকা থাকা চাই৷ তার পরিমাণটা ৩০ হাজার, ৪০ হাজার, ৫০ হাজার– কোথাও কোথাও ৮০ হাজার বা তারও বেশি৷ এটা দিতে হবে ইউনিয়নের দাদাদের৷ এমন অলিখিত ফরমান রাজ্যের কলেজগুলিতে বহু স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হতে আসা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে৷ এ কেমন ছাত্র ইউনিয়ন, যা ছাত্র স্বার্থরক্ষার দায়বদ্ধতা, নীতি–আদর্শ বিসর্জন দিয়ে নির্লজ্জ তোলাবাজির সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে!
পরাধীন ভারতে ছাত্র স্বার্থরক্ষার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন তথা ছাত্র রাজনীতির শুরু৷ সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু৷ বিদেশি পণ্য বর্জন, মাদক বিরোধী আন্দোলন, এমনকী বিপ্লবী আন্দোলনেও ছাত্রদের অংশগ্রহণ সেদিন ছিল উল্লেখযোগ্য৷ মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া বিপ্লবীদের অনেকেই ছিলেন ছাত্র৷ সুভাষচন্দ্র নিজে স্কুলে পড়াকালীনই বিপ্লবী ক্ষুদিরামের শহিদ দিবস পালন করেছিলেন৷ রাইটার্স অভিযানে অংশ নিয়ে ফাঁসিতে প্রাণ দেওয়া বিপ্লবী বিনয় বোস ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র৷ এমন আরও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে৷
ক্ষমতা হস্তান্তরের পর যখন কংগ্রেস এ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে শাসন ক্ষমতায় বসল তখন থেকেই তাদের অনুগামী ছাত্র সংগঠনও ছাত্র স্বার্থরক্ষার পরিবর্তে সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতির পক্ষে গিয়ে দাঁড়াল৷ তখন থেকেই ছাত্র রাজনীতির মূল ধারাটির অধঃপতন শুরু৷ ষাটের দশকের গোড়াতে শাসক কংগ্রেস আসন সংকোচন নীতি ঘোষণা করে৷ সরকার অনুগামী সংগঠন ছাত্র পরিষদ তা নিয়ে টুঁ শব্দ করেনি৷ ষাটের দশকের শেষ লগ্নে এ রাজ্যে গণটোকাটুকির কথা নিশ্চয়ই প্রবীণদের মনে আছে৷ ছাত্রদের মধ্যে সস্তায় প্রিয় হওয়ার প্রতিযোগিতায় বামপন্থার নাম নেওয়া ছাত্র ফেডারেশন এবং ছাত্রপরিষদ গণটোকাটুকিতে সংগঠনগত ভাবে মদত দেয়৷ যে ’৭২–এর সন্ত্রাসের কথা, কংগ্রেসি জমানার আধাফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের কথা ইতিহাস হয়ে রয়েছে, সেই সন্ত্রাসী বাহিনীর অন্যতম ছিল ছাত্রপরিষদ কর্মীরা৷ ’৭৭–এর নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের পর বামফ্রন্ট জমানায় ছাত্র ইউনিয়নগুলি রাতারাতি চলে যায় সিপিএম অনুগামী এসএফআইয়ের দখলে৷ এসএফআই–ও ছাত্রদের মধ্যে যুক্তি–বুদ্ধির চর্চার পরিবর্তে ছাত্রপরিষদের মতো যে কোনও ভাবে হোক ছাত্রসংসদ দখলের পথ নেয়৷ বামফ্রন্টকে ‘চোখের মণির মতো রক্ষা’ করার নামে সরকারের ছাত্র স্বার্থবিরোধী, জনবিরোধী শিক্ষানীতির হয়ে ওকালতি করাই হয়ে দাঁড়ায় তাদের একমাত্র কাজ৷ সিপিএম সরকারের শিক্ষানীতি, বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি তুলে দেওয়া, পাশফেল তুলে দেওয়া, স্কুল কলেজে লাগাতার ফি বাড়ানো, শিক্ষার বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ প্রভৃতি ছাত্রস্বার্থবিরোধী নীতিগুলি নিয়ে এস এফ আই পরিচালিত ইউনিয়নগুলি কোনও বিতর্কই কোনও দিন তোলেনি৷ এই অন্ধ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কলেজে কলেজে তারা ছাত্রস্বার্থ বিরোধী শক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে৷
সিপিএমের বিরুদ্ধে রাজ্যের জনগণের প্রবল ক্ষোভকে পুঁজি করে ২০১১ সালে ক্ষমতায় এল তৃণমূল কংগ্রেস৷ কলেজে কলেজে ছাত্র রাজনীতির দখল নিল তারা৷ এই সংগঠনেরও একমাত্র লক্ষ্য হয়ে গেল ছাত্র ইউনিয়নের মধুভাণ্ডের দখলদারি চালানো এবং ছাত্রদের উপর দাদাগিরি ফলানো৷ এখন কলেজে কলেজে তোলাবাজ হিসাবে তাদের কথাই প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে৷
প্রশ্ন উঠতে পারে, শাসক দলগুলি এসবে প্রশ্রয় দেয় কেন? দেয়, তার কারণ নীতি–আদর্শহীন রাজনীতির কারবারি এইসব দলের নেতাদের কাছে এই নগদ ‘তোলার’ বখরা যায়৷ তা ছাড়া এভাবে ছাত্র ইউনিয়নগুলিকে দখলে রাখতে পারলে ভোটরাজনীতিতেও সুবিধা মেলে৷ এই অধঃপতিত রাজনীতি আজ ছাত্রদের সামনে মারাত্মক বিপদ হিসাবে দেখা দিয়েছে৷ যে ছাত্র রাজনীতি একদিন দেশের ছাত্রদের চরিত্র দিয়েছে, মনুষ্যত্ব দিয়েছে, তা আজ শাসক দলগুলির নীতিহীন রাজনীতির হাতে পড়ে এসবের চিহ্ণমাত্র রাখছে না৷
ছাত্র রাজনীতির এই অধঃপতিত রূপটিকে দেখে কিছু অভিভাবক ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কেই বিরূপ হয়ে উঠেছেন৷ তাঁরা চান না তাঁদের সন্তানরা ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হোক৷ আবার এক শ্রেণির ধুরন্ধর রাজনীতিক এটিকে দেখিয়ে ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্র ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করার দাবি করেছেন৷ অথচ ছাত্ররাজনীতির এই নষ্ট ধারাটিই সব নয়৷ আশার কথা, সংবাদমাধ্যমের প্রচারের আড়ালে থেকেও এর বিপরীত ধারার একটি শক্তিশালী ছাত্র রাজনীতিও রয়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ও ছাত্রস্বার্থে নিরলসভাবে আপসহীন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে৷ সে লড়াই হল, এ যুগের শ্রেষ্ঠ মাকর্সবাদী দার্শনিক ও চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শে অনুপ্রাণিত এ আই ডি এস ও–র (অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন) লাগাতার আন্দোলন৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ বলতেন, রাজনীতিতে চরিত্র চাই৷ বলতেন, রাজনীতি একটা উচ্চ হৃদয়বৃত্তি৷ বিপ্লবী রাজনীতি উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি৷ এআইডিএসও সূচনাকাল থেকেই কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় নীতি এবং আদর্শকে ভিত্তি করে সরকারের একের পর এক ছাত্রস্বার্থ বিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে৷
ছয়ের দশকের শুরুতে কংগ্রেস সরকারের আসন সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে একমাত্র এআইডিএসও–ই আন্দোলন গড়ে তুলেছিল৷ গণটোকাটুকির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল এই সংগঠনটিই৷ এ রাজ্যে সিপিএম সরকার ক্ষমতায় বসে প্রথমেই প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি ও পাশফেল তুলে দেয়৷ প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে ডিএসও৷ টানা উনিশ বছর আন্দোলনের পরিণতিতে ইংরেজি ফেরাতে যে বাধ্য হয়েছে সিপিএম সরকার তাতে ডিএসও–র ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ পাশ–ফেলের দাবিতে আন্দোলন আজও চলছে৷ ফি বাড়ানো, ডোনেশন, বেসরকারিকরণ প্রভৃতি আক্রমণের বিরুদ্ধেও ডিএসও নিরলস আন্দোলন গড়ে তুলেছে৷ বহু ক্ষেত্রে দাবি আদায় করতে সমর্থও হয়েছে৷ পাশাপাশি ছাত্রদের চরিত্র গড়ে তুলতে নবজাগরণ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের মনীষী ও বিপ্লবীদের জীবন ও সংগ্রামকে ভিত্তি করে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে৷ উন্নত রুচি ও সংস্কৃতির আধারে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে ছাত্ররা আকৃষ্ট হচ্ছে৷ অন্ধকারের পাশাপাশি আশার এই উজ্জ্বল আলোটি ক্রমাগত শক্তি অর্জন করছে৷
(৭০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা ২০ জুলাই, ২০১৮)