জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল, দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি এবং দ্রুত শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে
ছাত্র মিছিলে ভাসল রাজপথ
১৪ সেপ্টেম্বর, দুপুর একটা। কলকাতার রাজপথ জুড়ে যতদূর চোখ যায় শত শত লাল পতাকা, ফুটে আছে যেন বসন্তের রক্তপলাশের মতো। আর শক্ত হাতে সেই পতাকা ধরে আছেন সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের কর্মী-সংগঠক-স্বেচ্ছাসেবকরা। মাথার ওপর ক্রমশ চড়া হচ্ছে ভাদ্রের প্রখর রোদ, কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি প্রখর তাঁদের আদর্শের জোর, প্রত্যয়ের দৃঢ়তা। কেউ বেরিয়েছে ভোরে, কেউ বা আগের দিন। প্রবল বৃষ্টি, রাস্তার জলকাদা, সারা রাত ট্রেনের ধকল পেরিয়ে আন্দোলনের ময়দানে একজোট হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রসমাজ। সুদূর কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, মেদিনীপুর থেকে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া থেকে পুরুলিয়া এমনকী উত্তরের প্রত্যন্ত চা বাগান অঞ্চল থেকেও ছাত্রছাত্রীরা এসেছে মিছিলে যোগ দিতে। হাতে ধরা পোস্টার, ব্যানার, সমাবেশ থেকে উঠে আসা দৃপ্ত স্লোগান তুলে ধরছিল ওদের দাবিগুলো– অনলাইন নয়, ক্লাসরুম ফিরিয়ে দাও, এসএসসি দুর্নীতির বিচার চাই, অবিলম্বে শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-মন্ত্রীদের শাস্তি চাই, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বাতিল করতে হবে, পিপিপি মডেল প্রত্যাহার করতে হবে।
বিগত দু’বছরে করোনা অতিমারির সুযোগে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর মারাত্মক আক্রমণ হেনেছে কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকার। স্কুল-কলেজ ধারাবাহিকভাবে বন্ধ রেখে অনলাইন শিক্ষাকে বাধ্যতায় পরিণত করা, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এবং ক্লাসরুমের পরিবেশকে গুরুত্বহীন করে মূলত তথ্যনির্ভর অ্যাপনির্ভর পড়াশুনাকে প্রাধান্য দেওয়া, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো উন্নত করার বদলে একের পর এক সরকারি স্কুল তুলে দিয়ে, সরকারি স্কুল কলেজে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করে স্কুল কমপ্লেক্সের নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশফেল তুলে দিয়ে কয়েকটি প্রজন্মের বুনিয়াদি শিক্ষার যে সর্বনাশ ইতিমধ্যেই সূচিত হয়েছে, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাকেও তুলে দিয়ে বা ঐচ্ছিক করে তাকে আরও পাকাপোক্ত করা, গবেষণা সহ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রগুলোতে গবেষক-অধ্যাপক-শিক্ষাবিদদের স্বাধীনতা হরণ, ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের নামে যাবতীয় অবিজ্ঞান অপবিজ্ঞান বিকৃত ইতিহাসকে প্রশ্রয় দেওয়া– সমস্ত পদক্ষেপই নেওয়া হচ্ছে দেশ জুড়ে শিক্ষার সার্বিক বেসরকারিকরণ গৈরিকীকরণের লক্ষ্যে।
অন্য দিকে এ রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে ভুরি ভুরি দুর্নীতির নগ্ন রূপ দেখে মানুষ যখন শিউরে উঠছেন, তখনও রাজ্যের শাসক দল উপযুক্ত তৎপরতায় অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়া, অন্যায় ভাবে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের দ্রুত নিয়োগ করার বদলে ক্লাবগুলোর পুজোয় কোটি কোটি টাকা অনুদান দিতে, ইউনেস্কোর ধন্যবাদ মিছিলে লোক জড়ো করতে ব্যস্ত। ছাত্রসমাজের, সাধারণ মানুষের এই চূড়ান্ত বিপন্নতার দিনে একটি দায়িত্বশীল ছাত্র সংগঠন হিসাবে এআইডিএসও প্রথম থেকেই প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। স্কুল কলেজ খোলার দাবিতে আন্দোলন করে ২০২১-এ বাঁকুড়ায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এগারো জন ডিএসও কর্মী, মিথ্যে মামলায় জেল হেফাজতে আটকে রাখা হয়েছিল তাঁদের। খুব সম্প্রতি কোচবিহারে ফি বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের ওপর তৃণমূল-পুলিশের বর্বর আক্রমণে একাধিক ছাত্রকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন, তেরো জন প্রতিবাদী ছাত্রকে মিথ্যে অভিযোগে জেলে আটকে রাখা হয়েছে দিনের পর দিন। এসব কোনও কিছুই যে সংগঠনের মনোবলকে এতটুকু দমাতে পারেনি, তা আবারও বুঝিয়ে দিল ১৪ তারিখের বিশাল সমাবেশ। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-গবেষণাক্ষেত্র-মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং সহ শিক্ষার সমস্ত ক্ষেত্র থেকে আসা হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর দৃপ্ত মিছিল সোচ্চারে প্রমাণ করল, সঠিক আদর্শে পরিচালিত আন্দোলনের শক্তি শাসকের চোখরাঙানির চেয়ে অনেক বেশি।
সমাবেশের মঞ্চ থেকে রাজ্য সম্পাদক কমরেড মনিশঙ্কর পট্টনায়ক বলেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতি এ রাজ্যে তাকে ঘুরপথে প্রয়োগের পরিকল্পনা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন। গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন ছাড়া এই আক্রমণ রুখে দেওয়া সম্ভব নয়। কেবল সরকারি ক্ষমতার অদল-বদল করে এই সঙ্কটের সমাধান সম্ভব নয়, চাই সংগ্রামী বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন। এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড সমর মাহাতো, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি কমরেড সামসুল আলম। জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ডিএসও-র যে স্বাক্ষর সংগ্রহ চলছে, ২৮ সেপ্টেম্বর তার সমাপ্তি সমাবেশকে সার্বিক ভাবে সফল করে তোলার আহ্বান রাখেন সংগঠনের নেতৃত্ব।
কলেজ স্কোয়ার থেকে স্লোগান মুখরিত সুশৃঙ্খল ছাত্র মিছিল এগোয় রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের দিকে, রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা শহর কলকাতার পথচলতি মানুষ সেদিন প্রবল আগ্রহ উৎসাহ নিয়ে দেখেছেন এই বিশাল মিছিল, আকাশের দিকে উদ্যত মুষ্টিবদ্ধ হাতের সারি আর উড্ডীন রক্তপতাকা। দু-হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন শিক্ষার অধিকার রক্ষায় পথে নামা এই ছাত্রদের, কোথাও ভেসে এসেছে তাঁদের ভরসার স্বর– ‘পারবে, এরাই পারবে।’
শাসক শ্রেণির বশংবদ মিডিয়ায় স্বভাবতই সেদিনের মিছিল জায়গা পায়নি, কিন্তু কলকাতার রাজপথে অগণিত সংগ্রামী ছাত্রের এই সম্মিলিত প্রতিবাদ নতুন করে আশা-ভরসা জাগিয়ে গেছে মুক্তিকামী মানুষের মনে।