১০ মার্চ সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায় রচনা করল বাংলার ছাত্রসমাজ। যে সংগ্রামে তাদের সঙ্গে সামিল ছিল রাজ্যের অভিভাবক এবং শিক্ষক সমাজও। বহু কষ্টে অর্জিত শিক্ষার অধিকার রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয়ে সেদিন বাংলার শিক্ষাঙ্গনে পালিত হল ধর্মঘট। রাজপথ উত্তাল হল প্রতিবাদের জোয়ারে। ঠিক সিপিএমের কায়দায় টিএমসিপি প্রশাসনের সহায়তায় শান্তিপূর্ণভাবে পিকেটিংরত ডিএসও ছাত্রছাত্রীদের উপর বর্বর হামলা চালায়।
সম্প্রতি রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক কমিটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী রাজ্যের ৮২০৭টি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংখ্যা ৩০ জনেরও কম। ছাত্র কম, অতএব স্কুল রাখার প্রয়োজন নেই– এই অজুহাতে স্কুলগুলি তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে সরকার। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধেই ১০ মার্চ রাজ্য জুড়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল এআইডিএসও। দাবি জানিয়েছিল দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ নিয়োগ ও ছাত্রস্বার্থবিরোধী জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিলের।
৮২০৭টি সরকারি স্কুলে ছাত্রসংখ্যা কম বলে সেগুলি তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছেন সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা, অথচ এ প্রশ্নটির উত্তর তাঁরা দিচ্ছেন না যে, কেন এতগুলি স্কুলের ছাত্র সংখ্যা কমে গেল? এমন তো নয় যে, এলাকার সব ছাত্রই স্কুলশিক্ষার আওতায় এসে গিয়েছে। বরং বাস্তবটা ঠিক তার উল্টো। বিরাট সংখ্যক শিশু-কিশোর যেমন স্কুলশিক্ষার আওতাতেই আসেনি, তেমনই প্রতিটি ক্লাস থেকে প্রতি বছর বিরাট সংখ্যক ছাত্র ড্রপআউট হয়ে যাচ্ছে। এই ড্রপআউটের কারণ যে প্রথমে সিপিএম সরকার, তারপরে তৃণমূল সরকারের শিক্ষানীতি তা কি সরকারি নেতা-মন্ত্রীরা অস্বীকার করতে পারবেন? সিপিএম সরকারের আমলে ইংরেজি ও পাশফেল তুলে দেওয়ার পর বেসরকারি স্কুলের জোয়ার শুরু। এরপর তৃণমূল সরকারের আমলে কেন্দ্রের কংগ্রেস ও বিজেপি সরকারের শিক্ষানীতি মেনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশফেল তুলে দেওয়া, একই সাথে শিক্ষার পরিকাঠামোকে ক্রমাগত দুর্বল করে দেওয়ার কারণে বিরাট সংখ্যায় মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবার তাঁদের সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে নিয়ে গেছে। এ সবই সরকারি স্কুলে ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
কিন্তু খোদ সরকারই শিক্ষা ব্যবস্থাকে এ ভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কেন? বাস্তবে অন্যান্য সমস্ত সরকারের মতোই রাজ্যের তৃণমূল সরকারেরও উদ্দেশ্য শিক্ষার সামগ্রিক বেসরকারিকরণ। দেশের পুঁজিমালিকদের হাতে শিক্ষা-ব্যবসার সুযোগটি তুলে দেওয়া। তাদের ব্যবসার প্রয়োজনেই ৮২০৭টি সরকারি স্কুল তুলে দেওয়ার এই ষড়যন্ত্র। আশঙ্কা অচিরেই স্কুলগুলিকে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মধ্য দিয়ে পুঁজিমালিকদের হাতে তুলে দেবে সরকার। সাধারণ মানুষের করের টাকায় গড়ে ওঠা স্কুলগুলি নিয়ে এবার ব্যবসা করবে পুঁজিমালিকরা।
এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সরকারি শিক্ষা বাঁচানোর দাবিতেই ছিল ১০ মার্চের ধর্মঘট। ধর্মঘটে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দিয়েছেন সাধারণ ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষক সকলে। ফলে ছাত্র ধর্মঘট এক সর্বাত্মক গণ ছাত্র আন্দোলনের চরিত্র পেয়েছে। সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ, পাহাড় থেকে সমতল সর্বত্র ছাত্র ধর্মঘটের দাবি ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্র ধর্মঘটের বিপুল সাড়া শাসক শ্রেণিকে আতঙ্কিত করেছে। ধর্মঘট ভাঙতে সরকার পথে নামিয়েছে পুলিশ-প্রশাসনকে। তাদের সাথে তৃণমূলের গুণ্ডা বাহিনীও ধর্মঘট ভাঙতে পথে নেমেছে। তাদের বাইক বাহিনী দাপিয়ে বেড়িয়েছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। হুমকি দিয়ে ছাত্র-অভিভাবকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জোর করে ঢোকাতে দেখা গেছে পুলিশকে। আন্দোলনের সাথী শিক্ষকদের জোর করে বাধ্য করা হয়েছে স্কুল খুলে রাখতে। আন্দোলনকারীদের উপর চালানো হয়েছে ব্যাপক আক্রমণ। কোচবিহার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগণা সর্বত্রই আক্রমণ হয়েছে। সারা রাজ্যে আহত হয়েছেন এআইডিএসও-র শতাধিক আন্দোলনকারী। গুরুতর আহত হয়ে চিকিসাধীন ১২ জন। গ্রেপ্তার হয়েছেন ৯ জন। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও ধর্মঘট সর্বাত্মক সফল করেছেন ছাত্রছাত্রী শিক্ষক অভিভাবকরা।
১০ মার্চের সফল ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল, এই আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে না। ধর্মঘটে রাজ্য জুড়ে সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব সমর্থন ইতিমধ্যেই যে সম্ভাবনা তৈরি করেছে তা আন্দোলনের এক বিরাট সম্পদ। ফলে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। জনশিক্ষা প্রসারে নবজাগরণের মহান মনীষী ও বিপ্লবীদের স্বপ্নকে প্রতিদিন হত্যা করে চলেছে স্বাধীন দেশের সরকারগুলো। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষে্য, ধর্মনিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক, গণতান্ত্রিক সার্বজনীন শিক্ষার দাবিতে আন্দোলন চলবে মহান মাক্সর্বাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষের শিক্ষায়।
মনে রাখতে হবে, সমস্ত ছাত্রের শিক্ষার দাবি নিছক একটা দাবি নয়। মানবসভ্যতা বিকাশে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যৌথ জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে তুলেছে মানুষ। তাই সভ্যতার এই সম্পদে সবার অধিকার। টাকার কারণে এ সম্পদ থেকে কাউকে বঞ্চিত করা চলে না। কোনও ব্যক্তিমালিকের তা নিয়ে ব্যবসা করাও তাই অনৈতিক। কিন্তু চিরকাল শাসক শ্রেণি সমাজের অসহায় মানুষকে জ্ঞানচর্চার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। কারণ তারা জানে জ্ঞান চর্চার মধ্য নিয়ে অসহায় শোষিত মানুষ ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বোঝে, সাদা-কালোর প্রভেদ চেনে। জ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায় না। সে প্রশ্ন তোলে। তাই গরিব শোষিত মানুষেরই জ্ঞানচর্চার প্রয়োজন সব থেকে বেশি।
মালিকি স্বার্থে পরিচালিত ব্যবস্থায় সরকার গরিব মানুষের স্বার্থের বিপরীতে দাঁড়িয়েই শিক্ষানীতি তৈরি করে, সে কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম, তৃণমূল যে সরকারই হোক না কেন। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে গরিব ঘরের সন্তানদের শিক্ষার সমস্ত অধিকার। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। সেই আন্দোলনকে ভাঙতে সরকার যে তrপরতা দেখিয়েছে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য তার একাংশ তrপরতা দেখালেও রাজ্যের মানুষকে সরকারি শিক্ষার এই দুর্দিন দেখতে হত না। সরকারের ষড়যন্ত্র এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারি শিক্ষাঙ্গন বাঁচানোর দাবিতে আন্দোলনকে ধারাবাহিক ভাবে পরিচালিত করতে জনসমাজের সব অংশের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। ‘সরকারি সন্ত্রাস নয়, সরকারি শিক্ষালয় চাই’ এই দাবিতে রাজ্যের সর্বত্র আরও ব্যাপক অংশের ছাত্র শিক্ষক অভিভাবকদের অংশগ্রহণে আরও বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই পথেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শিক্ষাকে কেড়ে নেওয়ার সরকারি ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করা যাবে।