বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী)-র কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের সদস্য কমরেড ডাঃ জয়দীপ ভট্টাচার্য ও কমরেড রাসেদ শাহরিয়ার-এর একটি লেখা আমরা প্রকাশ করলাম।
৫ আগস্ট দুপুরে হাজারো মানুষ যখন গণভবনে ঢুকছেন, ততক্ষণে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। পালিয়েছেন দেশ ছেড়ে। ফেসবুক ছয়লাপ হয়ে গেল একটি শব্দে, ‘স্বাধীন’।
‘স্বাধীনতা’ মানুষের সবচেয়ে আকাঙিক্ষত শব্দ। পরাধীন মানুষ বা জাতির জীবনে এর চেয়ে বড় আর কিছুই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু আমরা তো স্বাধীন হয়েছিলাম ১৯৭১ সালে। পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার, অবিচার, বৈষম্যের অবসান ঘটানোর লড়াই ছিল এটি। অথচ দেখা গেল– স্বাধীনতার পর আমরা দেশ পেলাম, কিন্তু স্বাধীন হলাম না। একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য, একটি মুখের হাসির জন্য– দেশের মানুষ সে দিন যুদ্ধে গিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হল, আমরা একটা ভূখণ্ড পেলাম। কিন্তু স্বাধীন দেশে শত শত ফুল ঝরে পড়ল, কত হাসিমাখা মুখ হারিয়ে গেল। আবার শুরু হল লড়াই। সেটা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। স্বৈরাচারী এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরানো হল। কিন্তু স্বাধীনতা এল না। জনগণকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটা দলের পরিবর্তে আর একটা দল সরকারে এল। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে না পারায় এদের চরিত্র না বুঝতে পেরে বারবার ঠকল, প্রতারিত হল।
আমাদের স্বাধীনতা ছিল না দুই দলের পালা করে নির্বাচিত হওয়া শাসন-আমলেও। কিন্তু গত ১৬ বছর ধরে আওয়ামি লিগের একচ্ছত্র শাসনামল আগের সব ইতিহাসকেই ম্লান করে দিয়েছে। পাকিস্তানী শাসনের সেই দিনগুলোর তুলনা এসেছে বারবার। এই সময়ে একাত্তরের মতোই গভীর রাতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দরজায় টোকা পড়েছে। তাদের জোর করে গাড়িতে তোলা হয়েছে। পরিবারের লোকেরা পরের দিন থানায় থানায় ঘুরেছে। কিন্তু কোনও থানা, কোনও বাহিনী গ্রেফতারের কথা স্বীকার করেনি। তাদের খোঁজ মেলেনি। কারও মিলেছে, কাউকে পরে রাস্তায় অর্ধমৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এইসকল ঘটনা ছিল অহরহ। নিখোঁজ এমন বেশ কয়েকজনকে বের করা হয়েছে এক গোপন আস্তানা থেকে, যার নাম ‘আয়নাঘর’। সেখানে আলো বাতাস ঢুকত না। অন্ধকার ঘর, মিলত অবিরাম নির্মম অত্যাচার আর পশুরও অখাদ্য খাবার। সেখানে কেউ আট বছর, কেউ ১০ বছর ধরে বন্দি ছিলেন।
খুব বেশি বড় নেতা হওয়ার দরকার ছিল না। সরকারের বিরুদ্ধে কার্টুন এঁকে গ্রেফতার হয়েছেন কিশোর। ফেসবুকে লিখে গ্রেফতার হওয়া মুশতাক তো আর ফিরলেনই না, জেলেই মারা গেলেন। এই সকল উদাহরণ ব্যতিক্রম নয়, সাধারণ। দেশে সরকার বিরোধী কার্টুন, লেখা, সমালোচনা প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এটা ছিল সত্যিকারের মৃত্যু উপত্যকা। এই তীব্র ক্ষোভই ফেটে পড়েছিল ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে। আর এ কারণেই আওয়ামি লিগের পতনের পর সবাই বুকের চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলছেন, ‘স্বাধীন’।
কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান
শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা-কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আত্মদান ও আত্মত্যাগের কারণেই দেশের মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে স্বাধীনতার এত বছর পরও তাদের সন্তান সন্ততি শুধু নয়, নাতি-নাতনিদের জন্যও এই কোটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা সহ ৫৬ শতাংশ নিয়োগই হত কোটার ভিত্তিতে। আর এ দিকে দেশ জুড়ে তীব্র বেকার সংকট। শিক্ষিত-অশিক্ষিত মিলেপ্রায় ৩ কোটি বেকার। খোদ সরকারি হিসাবেই উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৮ লাখ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংখ্যা আরও বেশি। ‘বিআইডিএস’-এর এক গবেষণায় প্রকাশ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাশ করা ৪৮ শতাংশইবেকার। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে শ্রম বাজারে প্রবেশ করছেন। কিন্তু সে তুলনায় চাকরির বাজার সীমিত। সরকারি শূন্যপদে নিয়োগ বন্ধ। নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে না। বেকারত্বের বোঝা বয়ে বয়ে গ্লানিতে হতাশায় প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছে। বাবা-মায়ের হাড় জিরজিরে শরীরে পরিশ্রমের মুষ্টিমেয় পুঁজি সম্বল করে, টিউশন করে, হলের বারান্দায়-মসজিদে কোনও রকমে রাত পার করে অসম্ভব অনিশ্চয়তায় অবশেষে পাশ করেও চাকরি নামক সোনার হরিণ দুর্লভ। ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজন-পোষণ, প্রশ্নফাঁস তাদের এ যাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলে। ফলে বৈষম্য ও বেকারত্বের সাথে সাথে দীর্ঘদিনের এই নিপীড়ন ছাত্র বিক্ষোভকে অনিবার্য করে তুলেছে।
২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করে যে নির্দেশিকা জারি করেছিল, সেটি গত ৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে বাতিল করে দেওয়া হয়। ওই দিনই তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা বিক্ষোভ করে। নির্দেশিকা বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে লাগাতার বিক্ষোভ চলতে থাকে। জুন মাসের মধ্যে দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে আশানুরূপ কোনও উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ঈদের ছুটির পর বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সাথে সাথেই জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে আবার বিক্ষোভ শুরু হয়। দেশের প্রথম সারির প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা রাজপথে জড়ো হতে থাকে। পরবর্তীতে প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসে যোগ দেয়। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ জুলাই আপিল বিভাগে শুনানি হলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেনি। এ দিন শিক্ষার্থীরা ঢাকার শাহবাগ সড়ক অবরোধ করেন। দেশের অনেক জায়গায় একই কর্মসূচি পালিত হয়। পরদিন শুক্রবারও দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়ক অবরোধ করা হয়। ৫ জুলাই সর্বত্র ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। ৬ জুলাই থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করা হয়।
১০ জুলাই আপিল বিভাগ সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম)কোটার বিষয়ে ৪ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ এবং পরবতী শুনানির জন্য ৭ আগস্ট দিন ধার্য করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরির সব গ্রেডে কোটা সংস্কারের দাবি করে বলেন, এই বিষয়ে আদালত নয়, সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। এবং এই দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।
আদালতের দোহাই দিয়ে সরকার এ সময় নীরব ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ না নিয়ে আন্দোলন বন্ধে চাপ প্রয়োগ করে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করেন, কোটা আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষার্থীরা ‘লিমিট ক্রস’ করে যাচ্ছেন।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের হুমকি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে রাজপথ-রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। ১৪ জুলাই একই দাবিতে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এ দিন গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোটার বিষয়ে আমার কিছু করার নেই। …মামলার পর আদালত যে রায় দেন, এতে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। আদালতেই সমাধান করতে হবে।’ সংবাদ সম্মেলনে এক পর্যায়ে তিনি এ মন্তব্যও করেন যে, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা পাবে না, তা হলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে’? এ মন্তব্যের মাধ্যমে বাস্তবে তিনি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরই অবমাননা করেন।
এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে লাখ লাখ মানুষের রক্তে রঞ্জিত ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক শক্তিদের সাথে তুলনা করায় মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনা যে প্রজন্মের বুকে আজও লালিত তা তারা সহজভাবে নেয়নি। এটা ছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কাছে আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। তাই বিদ্রুপের বাণ হেনে ‘তুমি কে আমি কে– রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে– স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’স্লোগানে নিজেদের মর্যাদা রক্ষার্থেই সেদিন রাতে হল ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে। মেয়েরা হলের গেট ভেঙে রাস্তায় নেমে আসে। প্রধানমন্ত্রীর কটূক্তির জবাবে আন্দোলন শুধু আর কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমাবদ্ধ থাকল না, স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল। রাতেই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। কয়েক জায়গায় ছাত্রলিগ হামলা করে।
পরের দিন দুপুরে আওয়ামি লিগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এর জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলিগ প্রস্তুত।’ তার এ মন্তব্যের পরপরই দেখা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ছাত্রলিগ বহিরাগত সন্ত্রাসী ভাড়া করে এনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করল। এমনকি নারী শিক্ষার্থীদের উপরও দফায় দফায় হামলা করা হল। প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী এ দিন আহত হয়। আহতরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও হামলা চালানো হয়। চিকিৎসা নেওয়া অবস্থায় হাসপাতালে আক্রমণের মতো নজিরবিহীন ঘৃণ্য বর্বরতার উদাহরণ তৈরি করল ছাত্রলিগের সন্ত্রাসীরা।
১৬ জুলাই রংপুরের বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহিদ হন। এ দিন বিভিন্ন স্থানে ৬ জনকে হত্যা করা হয়। প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে সারা দেশ। সর্বস্তরের জনগণ নেমে আসে রাজপথে। ‘সর্বাত্মক অবরোধ’-এর পর ‘কমপ্লিট শাটডাউনে’ সারা দেশ কার্যত অচল হয়ে যায়।
আওয়ামি ফ্যাসিস্ট সরকার নৃশংস আক্রমণে গণআন্দোলন দমনের পথে হেঁটেছে। সরকার পুরো রাষ্ট্রশক্তি ও তার দলীয় বাহিনীকে ছাত্র-জনতার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। পুলিশ-ব়্যাব-বিজিবি ও ছাত্রলিগ-যুবলিগ-আওয়ামি লিগের সন্ত্রাসী বাহিনী ইতিমধ্যে কয়েক শত ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছে। পত্রিকার তথ্যমতে এ সংখ্যা ৫ শতাধিক হলেও প্রকৃত সংখ্যা এখনও অজানা। গুলিবিদ্ধ হয়ে চোখের আলো হারিয়েছেন ৫০ জনের অধিক। আহত ছয় হাজারেরও বেশি, যার বেশিরভাগই গুলিবিদ্ধ। গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ১১ হাজার আন্দোলনকারীকে। ঢাকা ও বাইরের জেলাগুলোতে পাড়ায় পাড়ায় ব্লক রেইড করে গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছে আওয়ামি লিগ সরকার।
পুলিশ-ব়্যাব-বিজিবি ও দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়েও সরকার আন্দোলন দমাতে না পেরে কারফিউ জারি করেছে। সেনাবাহিনী নামিয়েছে। ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট করেছে। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করেছে। ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ করে দিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে একতরফা সরকারি বক্তব্য প্রচার করেছে। তারপরও যতটুকু খবর এসেছে, ভিডিও চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতে গভীর বিস্ময় ও ক্রোধের সাথে মানুষ লক্ষ করেছে– নৃশংসতার সমস্ত অতীত নজিরকে হার মানিয়ে কী ঠাণ্ডা মাথায় পুলিশ গুলি করছে– কারও বুকে, কারও মাথায়। বারান্দায়, বাড়ির ছাদেও গুলি চালিয়ে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত খবর পাওয়া গিয়েছে ৩২ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
এত অল্প সময়ে কোনও আন্দোলনে এত মৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যতীত হয়নি। কী পাকিস্তান আমল, কী স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে। আন্দোলনের গর্ভেই জন্ম এ দেশের। ভাষা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৯০-এর গণঅভ্যুত্থান সহ ছোট বড় অসংখ্য আন্দোলন এ দেশে হয়েছে। অত্যাচার-নির্যাতন তাতেও কম হয়নি। কিন্তু এত রক্তস্রোত, এত এত লাশের সারি পাড়ি দিতে হয়নি। সে দিক থেকে অতীতের সমস্ত স্বৈরশাসকের নৃশংসতাকেও হার মানিয়েছে আওয়ামি ফ্যাসিস্ট সরকার। কিন্তু অকুতোভয় বীরের মিছিলের স্রোত থামেনি, দমে যায়নি ছাত্র-জনতা। নিভে যায়নি ক্ষোভের আগুন।
এ আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে
কোটা সংস্কারের দাবি থেকে যে স্ফূলিঙ্গের সূচনা তা একসময় দাবানলের রূপ নেয়। এ পর্যায়ে আন্দোলন আর শুধু ছাত্র আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনি, দাবিও আর কোটা সংস্কারে আবদ্ধ থাকেনি। আন্দোলন দমাতে নির্বিচার গুলি ও হত্যাকাণ্ডে সারা দেশ স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রাথমিক স্তব্ধতা-বিহ্বলতা কাটিয়ে, শোক ছাপিয়ে গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। প্রতিদিন আন্দোলনের শক্তি বাড়তে থাকে। অন্য দিকে বাধ্য হয়ে সরকার তড়িঘড়ি করে আদালত বসিয়ে কোটা সংস্কার করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। একই সাথে গুম-খুন, গণগ্রেফতার, আন্দোলনের সমন্বয়কদের হাসপাতাল থেকে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে তাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন করে বাধ্য করে বিবৃতি ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল গ্রহণ করে।
সর্বস্তরের জনগণ শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে একাত্ম হয়ে রাজপথে নেমে আসে এ কথা ঠিক। কিন্তু মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভও তাকে রাস্তায় নামিয়েছে। গত ১৫ বছরে আওয়ামি লিগের ফ্যাসিস্ট শাসনের সময়ের অত্যাচার-নির্যাতন, গুম-খুন সামান্যতম প্রতিবাদের সমস্ত পথ রুদ্ধ করেছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পর পর তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে– যেখানে জনগণ তার ম্যান্ডেট প্রকাশ করতে পারেনি। নির্বাচন ছিল সাজানো নাটক। গায়ের জোরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে আওয়ামি লিগ। এ ভাবে একতরফা ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে যা ইচ্ছে তা-ই করেছে। আর তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী-পুঁজিপতিরা। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে তারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। প্রভাব খাটিয়ে, পরিকল্পিতভাবে ব্যাঙ্কগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছে। সিন্ডিকেটের কারণে, লুটপাট ও চাঁদাবাজির কারণে দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ জেরবার হয়েছে। বারবার ভুগেছে সাধারণ জনগণ। আর চোখের সামনে ধনী থেকে আরও ধনী হয়েছে একটি গোষ্ঠী। এ সবের ফলে দিনে দিনে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল– এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের ফলে তা বারুদের মতো বিস্ফোরিত হয়েছে। এ বারই প্রথম নয়, এই ছাত্ররা ২০২১ সালে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে নেমেছিল তাদের দুই বন্ধুকে বাসচাপা দিয়ে হত্যার প্রতিবাদে, যা জনতার ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছিল।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সরকারি চক্রান্ত– ‘তকমা দেওয়ার রাজনীতি’
এই ১৫ বছরব্যাপী শাসনে আওয়ামি লিগ যত বারই সংকটে পড়েছে, তত বারই সে আন্দোলনকারীদের জামায়াত-শিবির-জঙ্গিবাদের তকমা দিয়েছে, ধর্মান্ধ-সেকুলার দ্বন্দ্ব লাগিয়ে সংকট থেকে উদ্ধার পেতে চেয়েছে। দেশের মানবিক, উদার, গণতন্ত্রমনা মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে সে তার শাসন টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে।
এই আন্দোলন দমনেও সরকার দুই দিক থেকেই আক্রমণ করেছে। একদিকে সে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছে, অন্য দিকে আন্দোলন আর ছাত্রদের হাতে নেই, আন্দোলনে ‘বিএনপি-জামায়াত’ ঢুকে পড়েছে– এই বলে আন্দোলনকারীদের স্বাধীনতা-বিরোধী অপশক্তি হিসেবে তকমা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, আন্দোলনে যুক্ত গণতন্ত্রমনা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে। কতিপয় সরকারি ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য সামনে এনে দেখাতে চেয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত নাশকতা করছে। এ ভাবে জনগণের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করেছে, সরকারি দমন-পীড়নের পক্ষে জনমতকে প্রভাবিত করতে চেয়েছে। অথচ পত্রিকায় সংবাদ এসেছে যে, মেট্রোরেলে আগুন দিয়েছে বাস মালিকরা, চট্টগ্রামে শ্রমিক লিগের নেতা সন্ত্রাসী ভাড়া করে বিআরটিসির বাস পুড়িয়ে দিয়েছে, এই অভিযোগে সে গ্রেফতারও হয়েছে। এই আন্দোলনে মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে সকল ছাত্র-জনতাই সামিল হয়েছে। একত্রে লড়েছে, প্রাণ দিয়েছে। কোনও ভেদাভেদ ছিল না। শেখ হাসিনা পালাতে বাধ্য হওয়ায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামি লিগের লোকজন ও স্বার্থান্বেষী মহল আন্দোলন কালিমালিপ্ত করার জন্য সংখ্যালঘুদের কিছু ধর্মস্থানে হামলা করেছে, কোথাও কোথাও লুটপাট করেছে। কিন্তু সাথে সাথেই আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা এই চক্রান্ত রুখে দিয়েছে।
তাই বহুল ব্যবহৃত এই কৌশল এ বার আর কাজে লাগেনি। সরকারের সমস্ত গুমর ফাঁস হয়ে গিয়েছে জনগণের কাছে, দেশবাসীর কাছে। তাই আন্দোলন লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। বরংপ্রতিদিন জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণ বেড়েছে। দেশের বিশিষ্ট অধ্যাপক-শিক্ষক, অভিনয় শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, কণ্ঠশিল্পী, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক সহ বিভিন্ন অংশের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে। নিজ নিজ জায়গা থেকে সৃজনশীল উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষার্থী-জনতার পাশে দাড়িয়ে আন্দোলন বেগবান করেছে।
দফা এক, দাবি এক– খুনি হাসিনার পদত্যাগ
১৫ জুলাই আবু সাঈদ সহ ৬ জন আন্দোলনকারী শহিদ হন। ১৬ জুলাই বাম গণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বামমোর্চা ও বাংলাদেশ জাসদ– সম্মিলিত বিবৃতিতে শেখ হাসিনার ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে পদত্যাগের দাবি তোলে।
১৭ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে এবং ১৯ জুলাই থেকে কারফিউ ঘোষণা করে দেশের মানুষের উপর এক নির্মম আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়। পাড়ায় পাড়ায় ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে যাকে ইচ্ছা তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। ২৬ জুলাই সকাল ১১টায় সংস্কৃতিকর্মীরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ‘গানের মিছিল’ বের করে। বিকেলে বাম গণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বামমোর্চা ও বাংলাদেশ জাসদ সম্মিলিতভাবে শহিদদের স্মরণে ‘শোকমিছিল’ বের করে। ২৭ জুলাই সকালে নারীদের উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২৯ জুলাই দেশব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশ, ৩০ জুলাই মুখ ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ ও প্রোফাইল লাল করার কর্মসূচি দেয়। এই কর্মসূচিতে সারা দেশের ব্যাপক মানুষ অংশগ্রহণ করেন, এমনকি বিভিন্ন সেক্টরের পরিচিত তারকারাও এতে অংশ নেন। ৩১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে অনুষ্ঠিত হয় ‘মার্চ ফর জাস্টিস’। সেদিন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে আন্দোলনকারীদের পুলিশ গ্রেফতার করতে চাইলে উচ্চ আদালতের আইনজীবীরা পুলিশকে বাধা দেন। ১ আগস্ট ‘রিমেম্বারিং দি হিরোস’ শিরোনামে সারা দেশে শহিদদের স্মরণ করা হয়। ২ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
২ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত ছাত্র-জনতার দ্রোহযাত্রার পূর্বের বিরাট সমাবেশ থেকে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ শেখ হাসিনার পদত্যাগের সুস্পষ্ট দাবি তোলেন। এই সমাবেশে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দশ হাজারেরও বেশি মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের হাত থেকে মুক্তির যে আকুতি জনগণের মনে গুমরে গুমরে কাঁদছিল তা ভাষা পায়। পরদিন শহিদ মিনারের লাখো মানুষের সমাবেশ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবি তোলে। এই দাবিতে তখন গোটা দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এক দফা দাবিতে ৪ আগস্ট থেকে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করা হয়। ৬ আগস্ট থেকে ঘোষণা করা হয় ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি। ৪ আগস্ট অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন সারা দেশে পুলিশ ও আওয়ামি লিগ সন্ত্রাসীদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে ‘ঢাকা মার্চ’ একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নিয়ে আসা হয়।
৫ আগস্ট, ২০২৪, সোমবার। বেলা একটু বাড়ার সাথে সাথে ঢাকামুখী বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে লাখ লাখ মানুষের মিছিলের স্রোত শহিদ মিনার ও গণভবন অভিমুখে রওনা দেয়। এ জোয়ার ঠেকানোর কোনও উপায় রাষ্ট্রশক্তির ছিল না। গণঅভ্যুত্থানের কাছে রাষ্ট্রশক্তি পরাজিত হয়। দুপুরের মধ্যেই শেখ হাসিনা বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করে গণভবন থেকে পালিয়ে দেশ ছাড়েন।
বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন এই আন্দোলনে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অসংখ্য মানুষ যুক্ত হয়েছিলেন এই আন্দোলনে। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ লুকিয়ে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনে ছিল বহুদিন ধরে। আন্দোলনের সময় তারা সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ১৭ জুলাই তারা শাহবাগ থানা থেকে দুই আন্দোলনকারীকে বের করে আনেন। জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকরা মিছিলে নামেন। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা!
২৯ জুলাই, যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে আটক করে রাখা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে জোর করে বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেখা করতে গেলেও তাদের দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না, সেই সময়ে উচ্চ আদালতের আইনজীবী আইনুন্নাহার লিপি ও মানজুর আল মতিন ‘ছয় সমন্বয়কের আটকাদেশের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে ও আন্দোলনে গুলি না করার নির্দেশ চেয়ে’ একটি রিট আবেদন করেন। পরবর্তীতে এই ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয় আর ‘গুলি না করার নির্দেশ চেয়ে’ রিটটি খারিজ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে সারা দেশের অসংখ্য আইনজীবী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়ান। হত্যার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য নাগরিকদের পক্ষ থেকে গঠন করা হয় ‘গণতদন্ত কমিটি’।
বিভিন্ন মাধ্যমে কর্মরত অভিনয়শিল্পী, পরিচালক, কলাকুশলীরা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’ নামে তারা এই প্লাটফর্মে এখনও সক্রিয়। আন্দোলনে নেমেছিলেন চারুকলার শিল্পীরাও। ঢাকা শহরের রিকশাচালকরা এই আন্দোলনে প্রায় সংগঠিত ভূমিকা রাখেন। তারা শুধু রিকশা মিছিলই আয়োজন করেননি, কারফিউ-এর সময় ও অন্যান্য সময় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আন্দোলনকারীদের গন্তব্যে পৌঁছানোর কাজটি করেছেন তারা সুচারুভাবে। তাদের প্রত্যেকে ইশারার মাধ্যমে ভাব বিনিময় করতেন ও বুঝে নিতেন সামনে কোনও বিপদ আছে কি না। ছাত্র আন্দোলন থেকে এই আন্দোলন যখন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়, তখন এই আন্দোলনে দোকান কর্মচারী, ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া অনেক মানুষ যুক্ত হয়েছেন, গুলি খেয়েছেন, মৃত্যুবরণও করেছেন।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ঃ ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ চলবে’
একটি দেওয়াল লিখন ফেসবুকে অনেকেরই চোখে পড়েছে। সেখানে ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ।’ এই কথাটি লিখে, ‘নিষিদ্ধ’ শব্দটি কেটে ‘চলবে’ শব্দটি লেখা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের আগে প্রায় সকল চায়ের দোকানে বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ’ কথাটি লেখা ছিল একটা সাধারণ ব্যাপার। কেউ রাজনৈতিক আলাপ অনুমোদন করতেন না। কারণ কোনও বিরুদ্ধ মত প্রকাশের ক্ষেত্রে একটা বড় ঝুঁকি ছিল। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে এক নতুন ভোর এনেছে এই গণঅভ্যুত্থান। সবাই আজ বুঝতে চাইছেন, পথ খুঁজছেন। আর যেন মত প্রকাশের অধিকার বাধাগ্রস্ত না হয়, স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠিত না হয়। এটা প্রায় সকলের মনের আকাঙ্খা এবং এ ব্যাপারে সকলেই একটা রাস্তা পেতে চাইছেন। এটাও দেখা গেছে যে, জনগণের এই আকাঙ্খা কোনও প্রতিষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির দিকে যায়নি। যে দলগুলো বিভিন্ন সময় দেশ শাসন করেছে, তারা জনগণের আস্থার জায়গায় নেই। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। প্রচলিত বড় বড় দলকে, তাদের রাজনীতিকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে এই সময়ে রাষ্টে্রর বিভিন্ন কাঠামোর সংস্কার কী হতে পারে, এই আলোচনাগুলো প্রধান হয়ে আসছে।
আওয়ামি লিগের ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র উচ্ছেদের সংগ্রাম বেগবান করুন
শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামি লিগের ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন হয়েছে মাত্র। এটা এই গণঅভ্যুত্থানেরপ্রাথমিক বিজয় নিঃসন্দেহে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, অতীতেও এ দেশে বড় বড় আন্দোলন হয়েছে, গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, মানুষ অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা থেকে সকল প্রকার বৈষম্য ও বেকারত্বের জন্ম, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তার অবসান হয়নি, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর পতন হয়নি। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার জন্ম দেয়। ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের স্বার্থে পরিচালিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণমূলক চরিত্রের কারণে এই রাষ্ট্র যথার্থ গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে গড়ে ওঠে না। শোষণের প্রয়োজনে ক্রমাগত প্রচলিত ছিটেফোঁটা গণতান্ত্রিক অধিকারও হরণ করে। ফলে ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা ধ্বনিত হচ্ছে, তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে, পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
বাম গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে গণআন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। রাজনৈতিক ভাবে সচেতন, সংঘবদ্ধ, নৈতিক শক্তিতে বলিয়ান এই গণআন্দোলনই গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন ও রক্ষার একমাত্র গ্যারান্টি।