কমরেড অজয় সাহার স্মরণসভায় কমরেড প্রভাস ঘোষের শোকবার্তা
এসইউসিআই(সি)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রবীণ সদস্য কমরেড অজয় সাহা গত ২৫ ডিসেম্বর রাতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৩০ ডিসেম্বর পদ্মের হাট পেট্রোল পাম্প মাঠে প্রয়াত কমরেডের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিপুল জনসমাগমে মাঠ ভরে গিয়ে রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। স্বেচ্ছাসেবকদের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সভাপতিত্ব করেন রাজ্য ও জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড তরুণ নস্কর। উপস্থিত রাজ্য কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা প্রয়াত কমরেডের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান। দলের কর্মী সমর্থক ও সাধারণ মানুষ দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে প্রয়াত নেতার প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা জানান। প্রধান বক্তা ছিলেন দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসু। এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের পাঠানো শোকবার্তা পাঠ করেন রাজ্য কমিটির সদস্য ও জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড নন্দ কুন্ডু। শোকবার্তাটি নিচে প্রকাশ করা হল।
কমরেড সভাপতি, কমরেডস ও বন্ধুগণ,
কমরেড অজয় সাহার আকস্মিক অকালমৃত্যু আমার কাছে, আমাদের দলের কাছে, গভীর বেদনাদায়ক। আপনারা অনেকে জানেন, বিশেষত যারা দীর্ঘদিন ধরে এই দলকে দেখে আসছেন, তারা জানেন, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) অন্যান্য দলের মতো নিছক কিছু নেতা, মন্ত্রী, এমএলএ, এমপি বা পদ পাওয়ার জন্য, টাকা-পয়সা, সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে কিছু কর্মী সংগ্রহের জন্য দল নয়। এই দল সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক মতাদর্শ ও উন্নত নৈতিকতার আধারে প্রতিষ্ঠিত একটি বিপ্লবী দল, যার উদ্দেশ্য শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে বিপ্লব সংগঠিত করা, বিপ্লবী আদর্শ ও চরিত্রে বলিয়ান উপযুক্ত বিপ্লবী যোদ্ধা তৈরি করা এবং জনগণকে সংগঠিত করে, রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করে গণঅন্দোলন ও শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে তুলে বিপ্লবের প্রস্তুতি চালিয়ে যাওয়া। এই দলে যাঁরা যুক্ত হন তাঁরা ব্যক্তিগত কিছু পাওয়ার লোভে আসেন না। আসেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনে, সর্বস্ব দেওয়ার মন নিয়ে, মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিয়ে। এই রকম বিপ্লবী চরিত্র কোনও দেশে, কোনও যুগেই হঠাৎ করে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে না বা তৈরি হয় না। কিন্তু যাঁরা আসেন তাঁরা সেই সমাজের শ্রেষ্ঠ সন্তান।
এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-কে কমরেড শিবদাস ঘোষ উন্নত বিপ্লবী আদর্শ, সংস্কৃতি ও হৃদয়বৃত্তির আধারে একটি ক্রমবর্ধমান বৃহৎ পরিবারের মতো গড়ে তুলেছেন। তাই আমাদের দলের নেতা, কর্মী সকলেরই পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যক্তিগত স্বার্থহীন গভীর স্নেহ, মমতা ও ভালবাসার। সেখানে কোনও ধর্ম, বর্ণ, জাতের পরিচয় নেই। এই পরিবারের কোনও স্বজনকে হারানো, এই বিপ্লবী বাহিনীর যে কোনও বলিষ্ঠ যোদ্ধাকে হারানো খুবই দুর্বিষহ দুঃখজনক। এ বেদনা আরও মর্মান্তিক ও অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়, যখন বয়োজ্যেষ্ঠ হয়ে বয়োকনিষ্ঠের মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করতে হয়। কমরেড অজয় সাহার মৃত্যুজনিত বেদনা আমি এই ভাবেই বহন করছি। আবার কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা অনুযায়ী পূর্বের অন্যান্য নেতা ও কর্মীর মৃত্যুজনিত দুঃখ-ব্যথার মতো এই ক্ষেত্রেও শোককে শক্তিতে পরিণত করার সংগ্রাম চালাচ্ছি। এই পরম শোকের মুহূর্তে কমরেড ঘোষের এই মূল্যবান শিক্ষাকে স্মরণ করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।
আজকের এই সভা সাধারণ ভাবে নিছক শোক প্রকাশ, মাল্যদান ও স্মৃতিচারণের জন্য নয়। যিনি প্রয়াত, তাঁর বিগত দিনের জীবনসংগ্রাম থেকে যারা জীবিত তারা কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, তিনি কী ভাবে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে পাথেয় করে সংগ্রামী জীবনের পথে কতটা যোগ্যতার সাথে কী কী গুণাবলি অর্জন করতে পেরেছিলেন, তার থেকে আমরা কতটা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, এ জন্যই এই স্মরণসভার আয়োজন। এই ক্ষেত্রে প্রয়াত নেতার থেকে যেমন জীবিত কর্মীরা শিক্ষা গ্রহণ করে, তেমনি জীবিত নেতারাও প্রয়াত কর্মীর থেকে শিক্ষা নেয়।
আমি যতদূর জানি, কমরেড অজয় সাহা গরিব পরিবারের সন্তান হিসাবে শৈশব থেকেই দুঃসহ দারিদ্রের জ্বালা অনুভব করেছিলেন। এই দারিদ্রই তাঁকে অসময়ে শিক্ষাজীবন অসমাপ্ত রেখে বাস কন্ডাকটরের চাকরি নিতে বাধ্য করে। বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকের মাঝামাঝি, যৌবনের প্রারম্ভেই আমাদের দলের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার নেতৃস্থানীয় সংগঠক কমরেড পাঁচু নস্করের মাধ্যমে কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন ও অনুপ্রাণিত হয়ে দলে যুক্ত হন কমরেড অজয় সাহা। যে সময়ে তিনি যুক্ত হন, তখন জয়নগর, কুলতলি, মথুরাপুর, মন্দিরবাজার, পাথরপ্রতিমা, ক্যানিং এই সব থানায় কৃষক সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের দল প্রভাব বিস্তার করে এবং জয়নগর কুলতলি কেন্দ্রে বহুবার ও মথুরাপুর মন্দিরবাজার বিধানসভা নির্বাচনে দু’বার জয়লাভ করলেও সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে ও ভারতবর্ষে দল আজকের মতো প্রভাব ও বিস্তার ঘটাতে পারেনি। তখন বামপন্থীদল ঐক্যবদ্ধ সিপিআই ও পরবর্তীকালে সিপিএম এর প্রভাব ও শক্তি ছিল। এদের আজকের মতো এতো অধঃপতন হয়নি, সাধারণ মানুষের মধ্যে সিপিআই, সিপিএমের প্রতি যথেষ্ট মোহ ও আস্থা ছিল। সেই পরিস্থিতিতে তুলনামুলক একটি ছোট্ট দলের আহ্বানে দরিদ্র পরিবারের সন্তান চাকরি ও অন্যান্য পিছুটান ছেড়ে সম্পূর্ণ ভাবে বৈপ্লবিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া সহজসাধ্য ছিল না। জীবনের দুঃসহ দারিদ্রের অনুভূতি জাত হৃদয়বৃত্তিই তাঁকে উন্নত বৈপ্লবিক আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল এবং অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
এটা উল্লেখযোগ্য যে, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ ছাত্ররা কেউ কেউ সংগ্রামে অনেক দূর এগিয়ে, কেউ কিছুটা এগিয়ে আবার পিছিয়ে পড়েন। আবার কেউ পিছিয়ে পড়েও আবার সংগ্রাম করে এগিয়ে যান। এটা নির্ভর করে কে কতটা সঠিক ভাবে আদর্শ বুঝে কী ভাবে জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে কতটা যোগ্যতার সাথে সংগ্রাম করতে পারেন। তার উপর কেউ বিপ্লবী আদর্শ বুঝে গ্রহণ করে প্রথমেই সব কিছু পিছনে ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন, কেউ কেউ তেমন করে পারেন না। পিছিয়ে থেকেও কেউ সাধ্যমতো বৈপ্লবিক সংগ্রামের দায়িত্ব পালন করে যান। পরবর্তীকালে এই স্তরের কেউ কেউ আবার সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বিপ্লবী সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে সফল হন।
আমি এই সমাবেশে এই কথা সগর্বে বলব, কমরেড অজয় সাহা যে মুহূর্তে বিপ্লবী আদর্শের মর্মবস্তু গ্রহণ করতে পেরেছিলেন, আর্থিক রোজগারের কাজ, পারিবারিক দায়িত্ব পালন ইত্যাদি ত্যাগ করে দলের সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে জীবনসংগ্রাম শুরু করেন এবং কমরেড পাঁচু নস্করের নেতৃত্বে নিজ এলাকায় ও বাইরে দলীয় দায়িত্ব পালনে, জনসংযোগ স্থাপনে এবং গণআন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে থাকেন। এর পরেই শুরু হয় তাঁর একটি অতি ক্ষুদ্র ঘরে কমরেড পাঁচু নস্কর ও অজয় সাহার যৌথজীবন। এই ঘরটি বাস্তবে আর তাঁর ছিল না। এটি একাধারে পার্টি অফিস ও বাসস্থান এবং সর্বসাধারণের যোগাযোগের স্থান হয়ে উঠেছিল। আমি নিজেও কাজ উপলক্ষে বহুবার এই ঘরে গিয়েছি, থেকেছি, খেয়েছি।
তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক শিক্ষাশিবিরে, রাজনৈতিক ক্লাসে ও জনসভায় কমরেড শিবদাস ঘোষের অমূল্য আলোচনার দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে নিজের তত্ত্বগত জ্ঞান উন্নত করেছেন। প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক কমরেড নীহার মুখার্জী, প্রখ্যাত জননেতা তদানীন্তন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রয়াত কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার পার্টি প্রতিষ্ঠায় প্রধান উদ্যোক্তা তদানীন্তন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রয়াত কমরেড শচীন ব্যানার্জীর স্বল্প সময়ের জন্য হলেও গভীর সান্নিধ্যে এসে এবং দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা সম্পাদক কমরেড ইয়াকুব পৈলান ও রাজ্য কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট কৃষক নেতা শহিদ কমরেড আমির আলি হালদারের গাইডেন্সে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনার সুযোগ পান। একদিকে এই সব নেতৃবৃন্দের প্রভাব এবং অন্য দিকে গরিব মানুষের ব্যথা বেদনার সাথী হয়ে নানা আন্দোলন ও কর্মসূচি গ্রহণ করার মাধ্যমে ক্রমাগত তাঁর চরিত্র, ক্ষমতা, যোগ্যতা ও দক্ষতাকে সর্বোপরি রাজনৈতিক চেতনা বিকশিত হতে সাহায্য করেছে। যার ফলে সাধারণ কর্মীর স্তর থেকে ধারাবাহিক ভাবে উন্নত হতে হতে জেলা কমিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা, জেলা পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও রাজ্য কমিটির সদস্যের স্তরে উন্নীত হন এবং বিশিষ্ট জননেতায় পরিণত হন।
পার্টির নেতা পার্টির অভ্যন্তরীণ কাজকর্মে নেতৃত্ব দেন, জননেতা জনগণের আন্দোলনে, কাজকর্মে নেতৃত্ব দেন। এই ক্ষমতা দুই ধরনের। কেউ পার্টির নেতা হিসাবে যোগ্য হন, কেউ জননেতা হিসাবে যোগ্যতার পরিচয় দেন। আবার কেউ কেউ একই সাথে দুই ধরনের নেতারই যোগ্যতার অধিকারী হন। যদিও এই যোগ্যতা অর্জন করা কঠিন। কমরেড অজয় সাহা এই দুই ধরনের যোগ্যতা অর্জনের সংগ্রামেও অগ্রণী ছিলেন।
গরিব মানুষের সাথে, সাধারণ মানুষের সাথে তার সম্পর্ক ছিল হৃদয়ের, স্বাভাবিক ভালবাসার। সেই জন্যই তিনি সর্বসাধারণের আপনজন, সুখ দুঃখের সাথী, এক রকমের ঘরের মানুষই হয়ে গিয়েছিলেন। এই হওয়াটা খুব সহজ নয়। এটা শুধু বুদ্ধি দিয়ে নয়, স্বাভাবিক হৃদয়বৃত্তি থেকেই হয়ে গিয়েছিল। যে কেউ বিপদে পড়ে বুদ্ধি পরামর্শ চেয়েছে, ডেকেছে, তিনি ছুটে গিয়েছেন, দলীয় পার্থক্য এই ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। দলীয় পার্থক্য সত্ত্বেও দলমত নির্বিশেষে সকলের জন্যই একরকম দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। শরীর ভাঙছে, রোগাক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করেননি। এটা বলা হয়ত বাহুল্য হবে না, যদি তাঁর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও কেউ কোনও পরামর্শের জন্য, কোনও কাজের জন্য আসত, তিনি শেষ মুহূর্তেও অস্পষ্ট ক্ষীণ কণ্ঠে কিছু বলার চেষ্টা করে যেতেন। এই হচ্ছে জনগণের প্রকৃত জননেতা। এই জেলা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত বেশ কিছু আঞ্চলিক ও জেলা স্তরে এই ধরনের নেতার জন্ম দিয়েছে। যাঁরা প্রায় সকলেই প্রয়াত। অনেকেই শহিদের মৃত্যুবরণ করেছেন।
তিনি অত্যন্ত জনদরদি, সৎ, নির্ভীক ও সংগ্রামী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। যে কেউ তাঁর সংস্পর্শে এসেছে, দলের লোক হোক, সাধারণ মানুষ হোক, বিরোধী দলের লোক হোক সকলেই তাঁর সততায়, সরলতায়, ভদ্রতায়, মিষ্টভাষী আচরণে মুগ্ধ হতেন। আত্মপ্রচারবিমুখ ছিলেন, জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র দাম্ভিকতা ছিল না। সিনিয়ার নেতাদের, জুনিয়ার কর্মীদের সমালোচনা গ্রহণ করতে পারতেন, কোনও সঠিক বা ভুল সমালোচনায় কখনও কষ্ট পেলেও তার জন্য বাইরে উল্টোপাল্টা ব্যবহার করেননি। কেউ দুর্ব্যবহার করলে বা আঘাত করলে নীরবে সহ্য করতেন বা মৃদু প্রতিবাদ করতেন, কিন্তু প্রত্যাঘাত বা রূঢ় আচরণ করতেন না। দল ও নেতৃত্বের প্রতি গভীর আনুগত্য ছিল। দল যখনই যে দায়িত্ব দিয়েছে, যত কঠিনই হোক নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন। যে কোনও সভায় অতি স্বল্প কথায় সুচিন্তিত বক্তব্য রাখতে পারতেন। দলের কঠিন রাজনৈতিক তত্ত্বও অতি সহজ সরল ভাষায় নিজের উপলব্ধি অনুযায়ী সাধারণের মধ্যে উপস্থিত করতে পারতেন।
স্থানীয় স্তরে, জেলা স্তরে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যে কোনও আন্দোলনে, দলীয় কর্মসূচি রূপায়ণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। দলীয় নেতা হিসাবে তিনি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস এতটাই অর্জন করেছিলেন যে, তিনি ছ’বার জয়নগর এক নম্বর ব্লকের সভাপতি নির্বচিত হয়ে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এটা শুনে সকলেই হয়ত বিস্মিত হবেন যে, ছ’বার নির্বাচিত এই সভাপতির দু’বেলা খাওয়ার সংস্থান ছিল না। অন্যের মুখে এই খবর পেয়ে আমি জেলা নেতৃত্বকে জানাই চাঁদা সংগ্রহ করে যেন তাকে সাহায্য করা হয়। হয়ত নিতে অস্বীকার করবে, আমার নির্দেশ বলে নিতে তাঁকে যেন বাধ্য করা হয়। দুই একজন দরদিও তাঁকে সাহায্য করতেন এই অভাব জেনে। এই চরিত্র অর্জন একমাত্র এই দলেই সম্ভব।
আজ একদিকে পশ্চিমবঙ্গে, ভারতবর্ষে পার্টির বিস্তার ঘটছে। এই দলের প্রতিষ্ঠা এই জেলাতেই, জয়নগর শহরে। এইখানেই ভারতবর্ষের এই দলের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনের দুর্গ গড়ে উঠেছিল। প্রথম যুগের বিপ্লবী নেতারা, সংগ্রামী যোদ্ধারা প্রয়াত, পরবর্তীকালে বহু যোগ্য নেতা ও কর্মী প্রথমে কংগ্রেস শাসনের যুগে, তার পরে সিপিএম শাসনের সময়ে, আর এখন তৃণমূল সরকারের আমলে, বিশেষ করে সিপিএম শাসনের সময়ে তাদের ঘাতক বাহিনীর আক্রমণে শহিদের মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রায় বলতে গেলে এমন কোনও গ্রাম পঞ্চায়েত নেই যেখানে একাধিক এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) নেতা বা কর্মী শহিদ হননি। এই জেলা যেমন পার্টিকে প্রতিষ্ঠা করার স্থান দিয়েছে, তেমনই এই জেলার বহু নেতা-কর্মী কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আন্দোলনে মৃত্যুবরণ করেছেন এই দলকে রক্ষার জন্য, শহিদের মৃত্যুবরণ করেছেন এবং অনেকেই বুকের রক্ত ঢেলেছেন। সেই দিক থেকে ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে এই জেলা বিশেষ স্থান হিসাবে থাকবে।
যখন বহু আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও এই জেলার অসংখ্য গরিব মানুষ, সাধারণ মানুষ আমাদের দলকেই একমাত্র ভরসা হিসাবে দেখছেন এই অবস্থায় এত শহিদ ও এত মৃত্যুর পর যে কয়জন অবশিষ্ট নেতা উদ্যোগ নিয়েছিলেন দলকে আরও শক্তিশালী করার, তাঁদের অন্যতম ছিলেন কমরেড অজয় সাহা। তাঁর এই মৃত্যু দলের বিরাট ক্ষতি হিসাবে এসেছে। এই ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব নিতে হবে এই সভায় যাঁরা এসেছেন বা কোনও কারণে আসতে পারেননি তাদের। বিশেষত দায়িত্ব নিতে হবে ছাত্র-যুবকদের, গরিব-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের। কমরেড অজয় সাহাকে আমি প্রথম থেকেই জানি, তাঁর এলাকায় অনেক মিটিং, ক্লাস করেছি, অন্যত্রও তাঁকে নিয়ে গিয়েছি, বহু প্রশ্ন নিয়ে, বহু সমস্যা ও দুঃখ-ব্যথা নিয়ে আমার কাছে এসেছেন, অনেক কথাবার্তা হয়েছে, অন্যদের কাছে থেকেও তাঁর সম্পর্কে শুনেছি। এই সব অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর যে সব গুণাবলি আমার চোখে পড়েছে, আপনাদের কাছে রাখলাম, যাতে আগামী দিনে এই সব গুণ থেকে শিক্ষা নিয়ে, প্রয়াত নেতা ও শহিদদের গুণাবলি থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনারা কমরেড শিবদাস ঘোষের উপযুক্ত ছাত্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারেন। অন্যান্য প্রয়াত নেতাদের মতো, কমরেড অজয় সাহার মতো নিজেদের গড়ে তুলতে পারেন আজ এই শপথ নিন।
মনে রাখবেন আজ দেশের বড় দুর্দিন, এ রকম সর্বগ্রাসী দুর্দশা এ দেশে আর আসেনি। একদিকে কোটি কোটি গরিব শিক্ষিত-অশিক্ষিত যুবক বেকার, আরও কয়েক কোটি ছাঁটাই শ্রমিক-কর্মচারী, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষ দীন-দরিদ্র পথের ভিখারি। প্রতিদিন হাজার হাজার গরিব মানুষ অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, আত্মহত্যা করছে, অভাবের তাড়নায় নারী-শিশু বিক্রি করছে, ঘর সংসার ভেসে যাচ্ছে। পারিবারিক জীবনে স্নেহ মায়া মমতা ধসে যাচ্ছে। শিশুকন্যা থেকে শুরু করে বৃদ্ধা নারী পর্যন্ত প্রতিদিন শত শত ধর্ষিতা গণধর্ষিতা হচ্ছে এবং তাদের নৃশংস ভাবে হত্যা করা হচ্ছে। নীতি-নৈতিকতা মনুষ্যত্ব বলে আর কিছু নেই। অন্য দিকে মুষ্টিমেয় বড় বড় পুঁজিপতি আম্বানি আদানি টাটারা দৈনিক কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন করছে। পুঁজিপতিদের কেনা গোলাম হিসাবে কাজ করছে বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল সহ সব জাতীয় ও আঞ্চলিক দলগুলি। এমনকি সিপিএমও প্রায় একই পথের যাত্রী। ফলে একদিকে গদিলোভী, ভোট সর্বস্ব, মিথ্যাচারী, লোকঠকানো, ভণ্ড, পুঁজিবাদের গোলামির রাজনীতি, অন্য দিকে শোষিত-অত্যাচারিত গরিব মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকার জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রাম করার জন্য এবং পুঁজিবাদী শোষণ উচ্ছেদ করার জন্য এস ইউ আই (কমিউনিস্ট) দলের বিপ্লবী রাজনীতি। এই দুই রাজনীতির মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে।
এই প্রশ্নে কমরেড অজয় সাহা কিন্তু ভুল করেননি বলেই তিনি এই চরিত্র অর্জন করেছেন। অনেকে প্রশ্ন করেন, আপনাদের দলে সবই ঠিক আছে। কিন্তু আপনাদের কী ‘পাওয়ার’ আছে? পাওয়ার বলতে তাদের এই গদিসর্বস্ব দলগুলি বুঝিয়েছে মন্ত্রীত্ব, এমপি, এমএলএ, পুলিশ প্রশাসন, টাকার থলি, ক্রিমিনাল বাহিনী, সংবাদমাধ্যমের প্রচার। এই যদি পাওয়ার হয় তা হলে বুদ্ধ, যীশুখ্রিস্ট, শঙ্করাচার্য, হজরত মহম্মদ থেকে শুরু করে বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র, ভগৎ সিং-দের কোনও পাওয়ার ছিল না। তাঁদের পাওয়ার বা শক্তির উৎস ছিল সঠিক আদর্শ ও উন্নত চরিত্রবল। আজও পাওয়ার কাকে বলে দেখিয়ে দিচ্ছে একমাসের অধিক দিল্লিতে প্রবল শীতে আন্দোলনরত লক্ষ লক্ষ কৃষক। ইতিমধ্যে ৪০ জন প্রাণ হারিয়েছেন, তবুও সংগ্রামী কৃষকেরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় অটল। কালা কৃষি আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন। তারা পথ অবরোধ করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে এক রকম ঘেরাও করে রেখেছে, যেখানে মিলিটারি, পুলিশ, কামান, বন্দুক সব কিছু পরাস্ত হয়ে গিয়েছে। এই হচ্ছে জনগণের নিজস্ব পাওয়ার, গণঅন্দোলনের শক্তি। গ্রামে শহরে বিপ্লবী আদর্শে ও উন্নত চরিত্রে বলিয়ান জনগণের সংগ্রামে এই শক্তি অর্থাৎ পিপলস পাওয়ার গড়ে তোলার উপরেই কমরেড শিবদাস ঘোষ বার বার জোর দিয়েছেন। কমরেড অজয় সাহা কিন্তু এই সব সরকারি দলগুলির তথাকথিত পাওয়ারের প্রলোভনে ভোলেননি, তিনি বিপ্লবী দলের যথার্থ পাওয়ারকে চিনে নিয়ে কষ্টসাধ্য সংগ্রামকেই গ্রহণ করেছিলেন, তাই আজ আপনারা এখানে সমবেত হয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছেন। মনে রাখবেন, বাঁচার একমাত্র পথ পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, একমাত্র আদর্শ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা, গরিব শোষিত জনগণের একমাত্র দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)। এই সব বুঝে নিয়ে আপনারা এগিয়ে আসুন, এই দলকে শক্তিশালী করুন, কমরেড অজয় সাহার জীবন সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিন।
কমরেড অজয় সাহা লাল সেলাম
সর্বহারার মহান নেতা
কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা জিন্দাবাদ
এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) জিন্দাবাদ