আরেকটা ২১ ফেব্রুয়ারি পার হয়ে গেল। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষার দাবিতে ছত্তিশগড়ে যে আন্দোলন গত পাঁচ বছর ধরে চলছে, তার কোনও খবর কোনও সংবাদমাধ্যমে দেখা গেল না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কথায় মূলত বাংলাদেশ আর আসামের শিলচরের আন্দোলনের নামই উঠে আসে। কিন্তু ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যে যেখানে দণ্ডকারণ্য এলাকায় দেশভাগের কারণে বসতি স্থাপন করা উদ্বাস্তু সহ তিন লক্ষের বেশি বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বাস করেন, মাতৃভাষায় পঠনপাঠনের জন্য তাদের আন্দোলন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবে এই আন্দোলন ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে বর্তমানে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
এই রাজ্যে ২০১৬ সালে বাংলাভাষা সম্পূর্ণ তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে তৎকালীন বিজেপি সরকার। তারপর থেকেই ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও, যুব সংগঠন এআইডিওয়াইও, কৃষক সংগঠন এআইকেকেএমএস লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলে। শিক্ষাপ্রেমী মানুষদের যুক্ত করে মাতৃভাষা শিক্ষা ও সংগ্রাম সমিতি গঠন করে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। মিছিল, মিটিং, কনভেনশন, স্বাক্ষর সংগ্রহ, ডেপুটেশন, ঘেরাও প্রভৃতির মধ্য দিয়ে একদিকে জনমত গঠন, অন্যদিকে সরকারের উপর প্রবল চাপ তৈরি করা হয়। যার ফলে, ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল মাতৃভাষায় ও আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হন।
কিন্তু ঘোষণা হলেও, অস্পষ্টতা রেখে দেয় ধূর্ত সরকার। সেই ঘোষণায় বাংলা ভাষার কোনও উল্লেখ নেই। প্রশ্ন ওঠে, এই রাজ্যে বাংলাভাষীদের মাতৃভাষা কী? বাংলাভাষী সহ সমস্ত ভাষাভাষী গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়, যার চাপে সরকার বাংলা ভাষায় পড়াতে রাজি হয়।
কিন্তু চক্রান্ত এখানেই শেষ নয়, সরকার বাংলা ভাষাকে অন্যান্য স্থানীয় বোলি ভাষার মতো করে পড়াতে চায় এবং বাংলা উচ্চারণে হিন্দি অক্ষরে শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশিকা জারি করে। এতে আগুনে ঘি পড়ে। প্রশ্ন ওঠে, বাংলার কি হরফ নেই? বাংলা কি স্বীকৃত ভাষা নয়? ফলে এই অবমাননার বিরুদ্ধে শুরু হল তীব্রতর আন্দোলন। রাজ্যের নানা স্থানে জনগণ রাস্তা অবরোধ করে। পালন করা হয় মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ছত্তিশগড় বনধ। দাবি না মানলে আন্দোলন আরও তীব্র রূপ নেবে আঁচ করে অবশেষে সরকার বাংলা ভাষাতেই পঠনপাঠনের দাবি মানতে বাধ্য হয়। বাধ্য হয় বাংলা ভাষায় বই ছাপতে।
বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্যে ভাষাগত সংখ্যালঘুদের তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসকরা কীভাবে দমন-পীড়ন চালায় ছত্তিশগড়ের এই ঘটনা তারই একটা উদাহরণ। বিজেপি কিংবা কংগ্রেস–শাসকের নাম যাই হোক না কেন তাদের উভয়ের ভূমিকাই এ ক্ষেত্রে এক। বিজেপি দাবি করছে এ রাজ্যে ক্ষমতায় এলে বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেবে। বাংলা ভাষার প্রতি তারা কোন মর্যাদা দেখিয়েছে ছত্তিশগড়ের চিত্র তারই প্রমাণ।