ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলির ৯ হাজার কোটি টাকা পকেটে পুরে রীতিমতো লটবহর নিয়ে সকলের চোখের সামনে দিয়ে ২০১৬ সালের ২ মার্চ লন্ডনে উড়ে গেছেন বিজেপি সাংসদ তথা ধনকুবের মদ ব্যবসায়ী বিজয় মাল্য৷ এখন জানা যাচ্ছে তিনি যাওয়ার আগের দিন সংসদে খোদ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে জানিয়ে গেছেন৷ বিজেপি সরকারের আশীর্বাদ মাল্য সাহেবের উপর সর্বদা থেকেছে একথা সুবিদিত৷ কিন্তু দূর যাত্রার প্রাক্কালে ‘অভিভাবকের’ অনুমতিটুকুতেও তিনি বঞ্চিত হননি সে কথা মাল্য নিজেই ১২ সেপ্টেম্বর লন্ডনে সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছেন৷ তার পরদিন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও অস্বীকার করেননি যে ২০১৬ সালের ১ মার্চ সংসদ ভবনে তাঁর সঙ্গে মাল্যর কথা হয়েছিল৷
অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী এই সাক্ষাৎকার ছিল আকস্মিক৷ তাঁরা দু’জন বসে না দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন, এই নিয়ে তরজা চলছে৷ কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর অর্থমন্ত্রী এড়িয়ে যাচ্ছেন– রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ৯ হাজার কোটি টাকা গায়েব করে দেওয়ার অভিযোগে যার বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে তেমন একজন দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে শুনেও অর্থমন্ত্রী ব্যবস্থা নিতে সিবিআই বা পুলিশকে নির্দেশ দিলেন না কেন?
আরও প্রশ্ন উঠছে, ১৬ অক্টোবর ২০১৫ সিবিআই মাল্যর বিরুদ্ধে ‘লুক আউট’ নোটিশ জারি করে, যাতে দেশ ছাড়তে দেখলেই তাঁকে এয়ারপোর্টে ‘ব্লক’ বা আটক করা হয়৷ একমাস যেতে না যেতেই ২৪ নভেম্বর নোটিশ বদলে তারা ‘ব্লকে’র বদলে ‘ইনফর্ম’ অর্থাৎ শুধু জানানোর নির্দেশ দেয়৷ ফলে মাল্য সাহেব বিপুল পরিমাণ মালপত্র নিয়ে বিদেশগামী বিমানে উঠছেন দেখেও এয়ারপোর্টে নিরাপত্তা রক্ষীরা তাকে আটক না করে সিবিআইকে শুধু জানিয়ে দেয়৷ বিশেষ কোনও কারণে তাতেও সিবিআই হাত গুটিয়েই থেকেছে৷ এতবড় একজন আর্থিক অপরাধীর বিরুদ্ধে নোটিশ হাল্কা করে দিল কে, কার নির্দেশে? ৩০ মাস ধরে সিবিআই নাকি সে বিষয়ে তদন্ত শুরুই করতে পারেনি এ বিষয়ে উঠে আসছে গুজরাট ক্যাডারের প্রধানমন্ত্রী–ঘনিষ্ঠ এক আইপিএস অফিসারের নাম৷ যিনি সিবিআইয়ের জয়েন্ট ডিরেক্টর হিসাবে কর্মরত৷ তিনিই এক্তিয়ার বহির্ভূতভাবে মাল্য সংক্রান্ত নোটিশে পরিবর্তন করছেন জেনেও সিবিআই প্রধান কিছুই বলতে পারেননি৷ ‘উচ্চমহলের’ প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপই যে এর কারণ, আজ সে সত্যও স্পষ্ট৷ (এনডি টিভি ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮) প্রধানমন্ত্রী তাঁকে নাকি বিশেষ পছন্দ করে এই পদে নিয়ে এসেছেন হস্তক্ষেপটা তবে কোন স্তর থকে হয়েছে, সরকার দেশকে জানাবে কি? সুপ্রিম কোর্ট একসময় সিবিআইকে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘খাঁচার তোতা’ আখ্যা দিয়েছিল৷ তারা কোন দাঁড়ে বসে আছে, কোন শিকলে বাঁধা– তা আবার প্রমাণ হচ্ছে৷
এখানেই শেষ নয়, ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি স্টেট ব্যাঙ্ক সহ ১৭টি প্রতারিত ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিদের আইনজীবী দুষ্মন্ত দাভে পরামর্শ দেন পরদিন ২৯ ফেব্রুয়ারিতেই মাল্যর দেশছাড়া আটকাতে তারা সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করুক৷ কিন্তু ব্যাঙ্কগুলি ‘অতি উচ্চমহলের’ নির্দেশে মামলা করে ৫ মার্চ৷ বলা বাহুল্য মাল্য সাহেব ততদিনে লন্ডনের বিলাসবহুল ভিলায় আয়েশ করছেন৷ এই দেরিটা কি স্বাভাবিক? এর জন্য অর্থমন্ত্রক, সিবিআই, ইডি কোনও তদন্ত করল না কেন? কার নির্দেশে এই দেরি তা দেশবাসীকে সরকার কেন জানাবে না?
বিজেপি সরকারের বদান্যতায় একইভাবে হিরে ব্যবসায়ী ধনকুবের নীরব মোদি ও তাঁর দোসর মেহুল চোকসি পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক সহ বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্কের ১৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নিশ্চিন্তে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন৷ সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট (ইডি), গুরুতর আর্থিক অপরাধ দমন দফতর (এসএফআইও) ইত্যাদি কেন্দ্রীয় সংস্থার ভূমিকাও এক্ষেত্রে আলাদা কিছু নয়৷ হওয়ার কথাও নয়৷ নীরব মোদি টাকা নিয়ে চম্পট দেওয়ার পর সুইজারল্যান্ডের দাভোসে নরেন্দ্র মোদির সাথে তাঁর ছবি এখনও জ্বলজ্বল করছে৷ সরকার এবং বিজেপি এক্ষেত্রেও বলেছিল এটা পরিকল্পিত নয় আকস্মিক৷ কিন্তু একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরে কী যে কেউ কাছে ঘেঁষতে পারে, কাছে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারে? যদি প্রধানমন্ত্রীর দফতর তার অনুমতি না দেয়? আর মেহুল চোকসি? তাঁকে সংসদ ভবনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নিজে ‘হামারে মেহুল ভাই’ বলে সম্বোধন করেছেন এ তো জানা৷ সেই সময়েই তিনি ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলিকে গ্যারেন্টার করে বহু কোটি টাকা বিদেশ থেকে লুটে নিয়েছেন এবং দেশের মানুষের সঞ্চয় থেকে ব্যাঙ্ক সেই দায় মেটাতে বাধ্য হচ্ছে৷ এতবড় জালিয়াতির কথা অর্থদফতর এবং সিবিআই ইত্যাদি গোয়েন্দাদের না জানার কথা নয় তাহলে? শুধু তাই নয়, মেহুল চোকসি বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করছেন বলে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অভিযোগ জানিয়েছে জেনেও একই সময় তাঁর হয়ে ভারত সরকার নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দিয়েছে যাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় ‘মেহুল ভাই’ অ্যান্টিগুয়ার নাগরিকত্ব নিয়ে নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারেন৷
তরজা চলছে, কে বিজয় মাল্যদের বড় দোসর? কংগ্রেস না বিজেপি? বিজয় মাল্যের কিংফিশার এয়ারলাইন্স ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করছে না দেখেও তৎকালীন কংগ্রেস সরকার স্টেট ব্যাঙ্ক সহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বাধ্য করেছিল মাল্যের কোম্পানিকে আরও ঋণ দিতে৷ নীরব মোদি, মেহুল চোকসিদের কংগ্রেসই ভুয়ো ‘লেটার অফ আন্ডার টেকিং’–এর ভিত্তিতে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে টাকা লোটার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল৷ বিজেপি তাকে ব্যাপক জায়গায় নিয়ে গেছে৷ কংগ্রেস নীরব মোদিদের পাইয়ে দিয়েছিল ৪০০ কোটি টাকা৷ আর নরেন্দ্র মোদির ‘চৌকিদারিত্বে’ চার বছরে তারা হাতিয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন সম্প্রতি জানিয়েছেন, তিনি পদে থাকাকালীন বিপুল ঋণখেলাপি কর্পোরেটদের একটি তালিকা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়েছিলেন৷ কিন্তু বিজেপি সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি৷ ব্যাঙ্কের কাছে কর্পোরেট মালিকদের খেলাপি ঋণ বাড়তে বাড়তে ১২ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে৷ জনগণের কষ্টে জমানো পয়সা থেকে দেওয়া বিপুল পরিমাণ এই ঋণ উদ্ধারে সরকারের কোনও চেষ্টা দূরে থাক, আরও পাইয়ে দিতেই সরকার তৎপর৷ কংগ্রেসও অতীতে ঠিক এই কাজই করেছে৷ শুধু ঋণের পরিমাণটা তখন একটু কম ছিল৷ ললিত মোদিকে আইপিএল কেলেঙ্কারির পর পালাতে সাহায্য করেছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার এবং রাজস্থানের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যৌথভাবে৷ সাম্প্রতিক রাফাল বিমান কেলেঙ্কারি, কয়লা কেলেঙ্কারি সবেতেই জড়িয়ে এই দুই দল৷ পার্থক্য শুধু কখনও কংগ্রেস বেশি বিজেপি কম, কখনও বা উল্টোটা৷
অর্থাৎ? দুর্নীতিবাজদের দোসর হিসাবে বুর্জোয়া শাসকদলগুলি কেউই কম যাচ্ছে না৷
(৭১ বর্ষ ৮ সংখ্যা ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)