অভাবি বিক্রির হাত থেকে চাষিকে বাঁচানোর একমাত্র রাস্তা চুক্তিচাষ–এই ধারণা বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির তরফ থেকে প্রচার করা হয়ে থাকে৷ এ প্রচারে কেউ কেউ সাময়িকভাবে বিভ্রান্তও হন৷ এই বিভ্রান্তি কাটাতে আসামের হাইলাকান্দির জাট্রফা চাষিদের জীবনের মর্মান্তিক পরিণতি অনেকটা আলোকপাত করতে পারে৷
বায়োডিজেল উৎপাদনকারী উদ্ভিদ জাট্রফা৷ ২০০৭ সালে ডি ওয়ান উইলিয়ামসন ম্যাগর বায়োফুয়েল লিমিটেড নামে একটি বহুজাতিক সংস্থা হাইলাকান্দির চাষিদের জাট্রফা চাষের জন্য প্রলোভিত করে৷ সংস্থার কর্মকর্তারা চাষিদের বোঝান, জাট্রফা চাষ করলে বেশি মুনাফা মিলবে৷ উৎপাদিত জাট্রফা গুটি উপযুক্ত মূল্য দিয়ে কোম্পানি সরাসরি কিনে নেবে৷ কোম্পানি এও বলে, চাষের জন্য ৫০ শতাংশ টাকা সাবসিডি দেওয়া হবে৷
এই প্রচারে বিশ্বাস করে চাষিরা ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে চাষ শুরু করেন৷ তাঁদের জমির মূল্যবান গাছপালা এবং পানের জুম কেটে কোম্পানির দেওয়া জাট্রফা চারা রোপণ করেন৷ চুক্তি অনুযায়ী জনপ্রতি ন্যূনতম ৭ বিঘা থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতম ২২ বিঘা জমিতে জাট্রফা চাষ শুরু হয়৷ কোম্পানি বলেছিল, গাছপ্রতি ৬–৭ কেজি গুটি ধরবে৷ কিন্তু দেখা গেল গুটি ধরেছে কম৷ ২০০৯–’১০ সাল নাগাদ যখন গুটি পূর্ণ আকার নেয়, তখন কোম্পানি চুক্তিমতো সেই গুটি ক্রয় না করে পালিয়ে যায়৷ ঋণগ্রহীতা কৃষকদের কোনও খোঁজ খবর নেয়নি৷ বার বার বলা সত্ত্বেও জাট্রফা বাগান পরিদর্শনে আসেনি৷ যে সমস্ত ব্যাঙ্ক থেকে চাষিরা ঋণ নিয়েছিলেন, সেই ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তারাও সাড়া দেয়নি৷ ফলে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে সেই জমি থেকে চাষিরা বাস্তবে কিছুই পাননি৷ তীব্র আর্থিক সঙ্কটে প্রায় অনাহারে অর্ধাহারে চাষিদের দিনাতিপাত করতে হচ্ছে৷
কোম্পানির প্রতারণার শিকার চাষিরা৷ ব্যাঙ্ক ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা তাদের নেই৷ অথচ ব্যাঙ্ক ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধের জন্য৷ কৃষকরা দিশাহারা৷ এই অবস্থায় অল ইন্ডিয়া কিষাণ খেতমজদুর সংগঠন (এ আই কে কে এম এস) এবং জাট্রফা ফার্মার্স সংগ্রাম কমিটি হাইলাকান্দি জেলা উপায়ুক্তের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়৷
কৃষকদের দাবি, জাট্রফা চাষিদের সমস্ত ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করতে হবে, ১২ বছর ধরে চাষের সমস্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে, প্রতারক ডি উইলিয়াম ম্যাগর কোম্পানিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে৷ এস ইউ সি আই (সি) হাইলাকান্দি জেলা সম্পাদক তথা ফার্মার্স কমিটির সম্পাদক কমরেড প্রভাস সরকার বলেন, ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার কৃষকদের এই দাবিগুলি উপেক্ষা করছে৷ তিনি বলেন, সরকার বৃহৎ পুঁজিপতিদের কোটি কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে, অথচ দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না, তাদের ঋণ মকুব করছে না৷ এর বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চলবে৷
যে চাষিরা নিজস্ব জমিতে চাষ করে কোনও ক্রমে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন, আজ চুক্তিচাষের ফাঁদে পড়ে তাঁরা বিপন্ন৷ এই ঘটনা আবারও দেখাচ্ছে শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কৃষকের মুক্তি নেই৷ হয় ফড়ে–পাইকার–বৃহৎ ব্যবসায়ীদের শোষণ বঞ্চনা, নয়তো চুক্তিচাষের মাধ্যমে বহুজাতিক পুঁজির শোষণ বঞ্চনা– এই জাঁতাকলেই বিপন্ন চাষির জীবন৷