সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পরে গত শতকের ৯০’র দশকের সূচনাপর্ব থেকে আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী প্রচারযন্ত্র এ কথা মানুষের মনে গেঁথে দিতে চেয়েছিল যে সাম্যবাদী আন্দোলন এবং সমাজতন্তে্রর দিন শেষ। ২১ শতাব্দী প্রযুক্তি বিস্ফোরণের যুগ। প্রযুক্তির সাথে খোলা বাজার অর্থনীতি জনগণকে উন্নতির নতুন দিশা দেবে। কিন্তু বাস্তবে একুশ শতাব্দীর তথাকথিত প্রযুক্তি বিস্ফোরণ জনজীবনের সংকট কমাতে পারেনি, বরং তা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। দেশে দেশে শ্রমিক ছাঁটাই, বেকার সমস্যা, শিক্ষা এবং চিকিৎসার সুযোগ বহুমূল্য হয়ে শ্রমজীবী জনগণের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া, ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাঙ্ক, বিমা, যোগাযোগ, পরিবহণ সহ সমস্ত পরিষেবা ক্ষেত্রকে একচেটিয়া পুঁজির অবাধ লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করা, বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে কৃষকের থেকে জমি কেড়ে নেওয়া-এসবের ফলে বিশ্বের দেশে দেশে জনগণের ক্ষোভ ধূমায়িত হতে হতে বিস্ফোরণের রূপে ফেটে পড়েছে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই খোলা বাজার অর্থনীতির ফলে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির তীব্র শোষণের বিরুদ্ধে একের পর এক আন্দোলনের ঢেউ উঠতে থাকে। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডে শিক্ষার ফি বৃদ্ধি ও বেসরকারিকরণ, বাজেট ছাঁটাই প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ ওঠে এবং তা ফ্রান্স ও অন্যান্য রাষ্টে্রও ছড়িয়ে পড়ে। ২০১০ এ তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়, তারপর আগুনের মতো পর পর মিশর সহ বিভিন্ন আরব দেশে ছড়িয়ে পড়ে যা ‘আরব বসন্ত’ বলে পরিচিত হয়। সৌদি আরব, কুয়েত প্রভৃতি যেসব দেশে কখনও কোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়নি সেই সব দেশেও এর প্রবল প্রভাব পড়ে। ২০১১ সালে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি আমেরিকার বুকে ফেটে পড়ে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন। এর পথ বেয়েই মেক্সিকো, কানাডা প্রভৃতি উত্তর আমেরিকার দেশ চিলি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল সহ বিভিন্ন ল্যাটিন আমেরিকান দেশ, আবার ইউরোপের বনেদি পুঁজিবাদী দেশ জার্মানি, ইটালি, ইংলন্ড, ফ্রান্স সহ গ্রিস, তুরস্ক প্রভৃতি একের পর এক তুলনামুলক উন্নত দেশেও একই ধরনের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও তা জঙ্গি গণবিক্ষোভের রূপ নেয়। ২০১৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিও-লিবারাল অর্থনৈতিক নীতির ফলে গ্রিসে যে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয় তার বিরুদ্ধে তীব্র গণ-আন্দোলন ফেটে পড়ে। চিলির এবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বোরিচ ২০১১-১৫’র ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বামপন্থী নেতা হিসাবে দেশের রাজনীতিতে সামনে আসেন।
কিন্তু চিলি সহ বিভিন্ন দেশে এই সমস্ত আন্দোলন একদিকে যেমন বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে একচেটিয়া পুঁজির অবাধ শোষণ-লুন্ঠনের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে, পাশাপাশি ‘পুঁজিবাদই অনতিক্রম্য ভবিতব্য’ এই প্রচারের ফানুস ফেটে গেছে। একুশ শতকের প্রযুক্তির তথাকথিত চোখধাঁধানো অগ্রগতি সমাজের শ্রেণিগত ধনবৈষম্যকে বহুগুণ বাড়িয়েছে যার ফলে শ্রেণিসংগ্রাম নতুন রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ইউরোপে, ল্যাটিন আমেরিকায় নতুন করে মার্কসবাদ এবং সমাজতন্তে্রর প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাফল্য এবং বহু সমাজতান্ত্রিক দেশ মিলিয়ে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আত্মপ্রকাশ এশিয়া ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিতে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন এবং গণ-আন্দোলনের ঝড় তুলেছিল। কিন্তু তখন ইউরোপের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি বা আমেরিকা ছিল প্রায় শান্ত। একমাত্র আমেরিকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন মাথা চাড়া দেয়। কিন্তু একুশ শতকের এই পর্যায়ে উন্নত দেশগুলি এবং তেলসমৃদ্ধ আরব দেশ, যেগুলির কয়েকটিতে প্রায় কোনও বড় আন্দোলনই হয়নি, সেখানেও এই আন্দোলন ফেটে পড়ার ঘটনা গভীর তাৎপর্য বহন করে।
কিন্তু সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব, সঠিক নেতৃত্ব এবং সঠিক বিপ্লবী পার্টির অনুপস্থিতি বা এই আন্দোলনগুলিকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে পারার মতো শক্তি নিয়ে কোনও কমিউনিস্ট বিপ্লবী দলের সামনে আসতে না পারার ফলে এই আন্দোলনগুলি ধাপে ধাপে বিকাশের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদকে ভেঙে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে পরিণত হতে পারেনি। শুধু তাই নয়, এমনকি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় জনগণ শোষণের যন্ত্রণায় বার বার বিক্ষোভ আন্দোলনে ফেটে পড়ে। সেটাকে কাজে লাগিয়ে বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া নানা দল সরকারি ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করে। কিন্তু এর দ্বারা সরকারের হয়ত পরিবর্তন হয় কিন্তু বিপ্লব ছাড়া জনজীবনের মূল সমস্যাগুলির সমাধান হয় না। মার্কস-লেনিন সহ সমস্ত মার্কসবাদী চিন্তানায়কই শান্তিপূর্ণভাবে সমাজ পরিবর্তনের তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছেন।
মার্কসবাদের সর্বোন্নত উপলব্ধি ছাড়া আজকের
দিনে বিপ্লবী আন্দোলন সঠিক পথে এগোতে পারে না
সর্বহারার মহান নেতা কমরেড লেনিন বলেছিলেন সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লব হবে না। অর্থাৎ বিপ্লবী রাজনীতিকে সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব, যা রাজনীতি, অর্থনীতি সংস্কৃতি সহ সামগ্রিক জীবনদর্শন, তার উপর দাঁড় করাতে হবে। আজকের বিজ্ঞানসম্মত সঠিক আদর্শ এবং তত্ত্ব অবশ্যই মার্কসবাদ। তাই বিভিন্ন গণআন্দোলন যারা পরিচালনা করবেন তাদের মার্কসবাদকে হাতিয়ার করতে হবে। কিন্তু নতুন নতুন পরিস্থিতিতে মার্কসবাদের যত প্রয়োগ হয়েছে মার্কসবাদ তত উন্নত এবং উন্নততর উপলব্ধির জন্ম দিয়েছে। এসেছে লেনিনবাদ এবং লেনিন পরবর্তীকালে মার্কসবাদ-লেনিনবাদেরও উন্নততর উপলব্ধি। রাশিয়া এবং চীনে সমাজতন্তে্রর বিপুল সাফল্য এবং অগ্রগতি সত্ত্বেও কী ভাবে সেখানে সংশোধনবাদ জন্ম নিল, আধুনিক সংশোধনবাদের প্রকৃতি ও চরিত্র কী? আজকের দিনে ব্যক্তিবাদের সমস্যা কী চেহারা নিয়েছে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরে কী ভাবে ব্যক্তিবাদ জন্ম নিয়েছে ও ক্রিয়া করেছে, কী ভাবে তা সংশোধনবাদের রূপ নিয়েছে, ভিতর থেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ঘুণ ধরিয়েছে, বিংশ শতকের শুরুর পর্বের পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে এবং তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উপস্থিতির পটভূমিতে এবং তারপর সমাজতান্ত্রিক শিবির আধুনিক সংশোধনবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যৌথ ষড়যন্তে্র অবলুপ্ত হওয়ার পর পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের চরিত্রে কী নতুন বৈশিষ্ট্য তা বুঝতে না পারলে আজকে গণআন্দোলনকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। নানা চিন্তাগত বিভ্রান্তির বেড়াজালে গণআন্দোলন পথভ্রষ্ট হবে। তাই বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও ছাড়াও তাঁদের অনুগামী, এ যুগের অগ্রগণ্য মার্কসবাদী চিন্তানায়ক ও দার্শনিক সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ ব্যক্তিবাদ, আধুনিক সংশোধনবাদ, সমাজতান্ত্রিক ব্যক্তিবাদ, পুঁজিবাদ-ফ্যাসিবাদ সম্বন্ধে যে বিশ্লেষণগুলি তুলে ধরেছেন সেগুলি এক্ষেত্রে দিগদর্শী ভূমিকা পালন করে।
বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি শর্ত
ভারতে গত শতাব্দীর ৫০-৬০-এর দশকে যে উত্তাল বামপন্থী আন্দোলনের পরিবেশ ছিল সেই পটভূমিতে এই দিকটি ব্যাখ্যা করে কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, ‘‘নভেম্বর বিপ্লব থেকে আর যে শিক্ষাটা আমাদের নিতে হবে তা হচ্ছে, বিপ্লবের জন্য তিনটি শর্ত দরকার। প্রথম শর্ত–সঠিক আদর্শ, তত্ত্ব এবং বিপ্লবী রাজনৈতিক লাইনের ভিত্তিতে একটি সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উপযুক্ত শক্তি নিয়ে উপস্থিত হওয়া। …দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে যুক্তফ্রন্ট। প্রথমে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্তরে বামপন্থী এবং গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির যুক্তফ্রন্ট এবং এই স্তর উত্তীর্ণ করবার পর পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লবের অবশ্যপ্রয়োজনীয় যুক্তফ্রন্ট অর্থাৎ প্রোলেটারিয়ান ইউনাইটেড ফ্রন্টের জন্ম দেওয়া। বিপ্লবের জন্য তৃতীয় অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিস হচ্ছে, সংযুক্ত এবং সম্মিলিত লড়াইগুলোর মধ্য দিয়ে জনগণের নিজস্ব সংগ্রামের হাতিয়ার– যাকে জনতার রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেওয়া বোঝায় তা গড়ে তোলা…এই তিনটি শর্ত পূরণ না হলে বারবার সংগ্রামের ঢেউ আসবে, বারবার লড়াইয়ের ময়দানে প্রাণ দেবার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে সংগ্রামে–কিন্তু বিপ্লব হবে না। বিপ্লব আর বিদ্রোহ, বিক্ষোভ এক জিনিস নয়। বিপ্লব হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সচেতন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, সঠিক আদর্শ ও বিপ্লবী রাজনৈতিক লাইনের ভিত্তিতে জনগণের সংঘবদ্ধ, সচেতন ও সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান।” (নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকী উপলক্ষে ৮ নভেম্বর ১৯৭৪ প্রদত্ত ভাষণ)
‘জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র‘ নয়,
বিপ্লবের মধ্য দিয়েই সমস্যার সমাধান সম্ভব
ভারতে নেহরুর সমাজতন্ত্রের স্লোগান, জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র এবং ‘মিশ্র অর্থনীতি’র তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ আরও দেখিয়েছেন, সংকটের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্যই পুঁজিবাদের সামগ্রিক স্বার্থে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র জনকল্যাণকামী রাষ্টে্র্রর ছদ্মবেশ ধারণ করে। জনগণকে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে তার ক্ষোভকে প্রশমিত করে। কিন্তু যতক্ষণ বুর্জোয়া রাষ্ট্র, তার পুলিশ মিলিটারি, আইন ও বিচারব্যবস্থা টিকে থাকবে, ততদিন পুঁজিবাদী শোষণ শাসনও টিকে থাকবে। যখন জনগণ পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে ফেটে পড়ে, সমাজতন্ত্রের আকাঙ্খা নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে নেমে যায় তখন জনগণের ক্ষোভকে প্রশমিত করার জন্যই বামপন্থী, সমাজতন্ত্রী নামধারী, কিন্তু বুর্জোয়াদের সাথে বোঝাপড়া আছে, এমন কোনও দলকে, বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে প্রচার দিয়ে সামনে এনে দেবার চেষ্টা করে। জনগণের কিছু দাবি মেনে নেয়, আর জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে কিছু ব্যক্তি খারাপ তাদের সরকার থেকে হঠাতে পারলেই এই ব্যবস্থার মধ্যেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এভাবে তারা আন্দোলনের শক্তিকে পার্লামেন্টারি রাজনীতির চৌহদ্দির মধ্যে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে। আন্দোলনের মধ্যে কোনও প্রকৃত বিপ্লবী শক্তি থাকলে তাদের কাজ হচ্ছে আন্দোলনের মধ্যে যে জনগণ সক্রিয় হয়েছে তাদের সে সক্রিয়তা ধরে রাখা। এই শক্তিকে স্থায়ী সাংগঠনিক রূপ অর্থাৎ সোভিয়েত বা গণকমিটির মতো শোষিত শ্রেণির নিজস্ব সংগঠনগুলি গড়ে তোলা, যেগুলি হবে জনতার রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি। আন্দোলনের মধ্যে শ্রেণি-সচেতনতা গড়ে তোলা। আন্দোলনকারী মানুষকে দেখানো যে মূল সমস্যা কোনও ব্যক্তি বা বিশেষ দল নয়। আসল সমস্যা হল শাসক পুঁজিপতিদের শ্রেণিস্বার্থ, যা সরকারে যে দলই থাক নানা কৌশলে সেটাকে রূপায়িত করে। ফলে গণআন্দোলন আসলে শ্রেণি সংগ্রাম, শুধু কিছু দাবি আদায়ের মধ্যেই তা শেষ হবে না, ধাপে ধাপে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনতার রাজনৈতিক শক্তিকে সংহত করে তার আঘাতকে এই ব্যবস্থা, তার রক্ষক রাষ্ট্রশক্তিকে ধ্বংস করে নতুন ভিত্তির উপর নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আর এর জন্য চাই সঠিক পথ, উন্নততর জীবনাদর্শ এবং নতুন সংস্কৃতি।
চিলিতে বামপন্থী সরকারের বিপুল জয় সংগ্রামী জনগণের পুঁজিবাদী শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু চিলিতে কোনও সঠিক বিপ্লবী শক্তি আছে কি না, গ্যাব্রিয়েল বরিচ বিপ্লবী, না পুঁজিপতিদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি তা সময়ই বলবে। কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, কোনও প্রকৃত বিপ্লবী দল যদি আন্দোলনের পথ বেয়ে সরকারে যায় তা হলে তারা যতদিন সরকারে আছে তত দিন সরকারি ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পুঁজিবাদের দমন-পীড়নের হাতিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র অর্থাৎ পুলিশ মিলিটারিকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ করে শ্রেণি সংগ্রামকে তীব্রতর করবে, তাতে যদি সরকার পড়ে যায় তাতেও পরোয়া না করে শ্রমিক শ্রেণিকে, বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রকে উচ্ছেদ করে, সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। গ্যাব্রিয়েল বরিচ যদি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরকারে থেকে তার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের কথা ভাবেন সে ক্ষেত্রে তাঁকেও পূর্বতন আলেন্দে সরকারের মতো প্রবল আক্রমণের সামনে পড়তে হতে পারে। আর না হলে এই সরকার সমাজতন্ত্র এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্রের স্লোগান দিতে দিতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে আপস করে পুঁজিবাদের সামগ্রিক স্বার্থে কাজ করলে সেই সরকার দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে কিন্তু তাতে জনগণের বিশেষ কোনও লাভ হবে না। কোনও সঠিক বিপ্লবী দল উপযুক্ত ভূমিকা পালন না করলে বরং যে জনগণ পরিবর্তন হল বলে ভাবছেন, উল্লাস করছেন তাদের মনে হতাশা, নিরাশা, রাজনীতি বিমুখতা বৃদ্ধি পাবে। (শেষ)