এস ইউ সি আই (সি) রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ৩ নভেম্বর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে এক চিঠি দিয়ে চিকিৎসায় স্বাস্থ্যসাথী কার্ড বাধ্যতামূলক করার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। চিঠিতে তিনি বলেছেন,
রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের ২৫ অক্টোবরের নির্দেশিকা অনুযায়ী এখন থেকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তির জন্য সর্বসাধারণের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক। ২০১৬ সালে চালু হওয়া এই কার্ড প্রথমে কিছু নির্দিষ্ট পেশার মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। ২০২০-র ডিসেম্বর থেকে তা চাকরিজীবী ছাড়া সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে এবং সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে চিকিৎসায় তা কাজে লাগানো যেত, কিন্তু বাধ্যতামূলক ছিল না। উপরোক্ত নির্দেশের ফলে ওই কার্ড বাধ্যতামূলক হল। অর্থাৎ ওই কার্ড ছাড়া কেউই সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবে না। যদিও বলা হয়েছে যাঁদের কার্ড থাকবে না তাঁদের হাসপাতাল থেকে সঙ্গে সঙ্গে কার্ড তৈরি করে ভর্তি করাবে। এই কার্ডধারীরা পরিবার পিছু বছরে ৫ লক্ষ টাকার চিকিৎসা বিমার পরিষেবা পাবে। এই টাকার ১.৫ লক্ষ টাকা সরকার প্রিমিয়াম হিসাবে বিমা কোম্পানিকে দেয় এবং বাকি ৩.৫ লক্ষ টাকা অ্যাসিওরেন্স হিসাবে থার্ড পার্টি মারফত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল নার্সিংহোমের চিকিৎসা বিল মেটায়। সরকারি দেয় টাকা আসত স্বাভাবিক ভাবে জনসাধারণের ট্যাক্সের মাধ্যমে। আপাতদৃষ্টিতে এই ৫ লক্ষ টাকায় বিনা পয়সায় চিকিৎসার সুযোগ ভাল মনে হতে পারে। কিন্তু গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে যাঁরা এই পরিষেবা নিয়েছিলেন তাঁদের অভিজ্ঞতা হল কর্পোরেট হাসপাতাল মালিকদের মুনাফার প্রয়োজনে সাদা-কালো-গোপন নানা বিলের মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই ৫ লক্ষ টাকা সাফ হয়ে যেত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীর চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকত।
সরকারি হাসপাতালে বিনা পয়সায় চিকিৎসার দাবি বহু দিনের এবং ৯০-র দশকের আগে তা অন্যান্য কিছু রাজ্যের সঙ্গে এই রাজ্যেও ছিল। সিপিএম পরিচালিত ফ্রন্ট সরকার আউটডোর টিকিটের দাম ও বেড-ভাড়া চালু করে এবং হাসপাতালে পিপিপি মডেলে বেসরকারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সেই সুযোগ অবলুপ্ত করে এবং প্রায় পুরো চিকিৎসা পরিষেবা কিনতে মানুষকে বাধ্য করে।
২০১৫ সালে আপনার সরকার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা ফ্রি ঘোষণা করার পর থেকে নিম্নমানের ও অপ্রতুল হলেও সাধারণ মানুষ বিনা পয়সায় চিকিৎসা পেয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ২০১৬ সালে আপনার সরকার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড চালু করে এবং ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার অন্যান্য রাজ্যে পিএম জনআরোগ্য যোজনা কার্ড চালু করে। এতদসত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসার সুযোগ এত দিন ছিল। বর্তমানে বিমা নির্ভর এই প্রকল্পকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করার মধ্য দিয়ে এক দিকে রাজ্য সরকার স্বাস্থে্যর দায়িত্ব অস্বীকার করল। অন্য দিকে মানুষ হারালো তাদেরই টাকায় গড়ে ওঠা হাসপাতালে ফ্রিতে চিকিৎসার সুযোগ অর্থাৎ কার্যত কেড়ে নেওয়া হল জনসাধারণের স্বাস্থ্যের অধিকার।
বিশ্বের মানুষের বিশেষ করে এই করোনা কালের তিক্ত অভিজ্ঞতায় এটা আজ প্রমাণিত যে, কোনও ধরনের বিমা-নির্ভর স্বাস্থ্য প্রকল্প জনগণের সাথে প্রতারণাই বেশি করে এবং তা কখনও জনসাধারণের স্বাস্থ্যের অধিকারের সমতুল্য হতে পারে না। যেখানে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সমস্ত মানুষেরই ফ্রিতে স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার সুযোগ ছিল, সেখানে জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে প্রথমে বহুজাতিক বিমা কোম্পানি, থার্ড পার্টি এজেন্সি (টিপিএ) এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্য ব্যবসার কর্পোরেট মালিকদের সর্বোচ্চ মুনাফা সুনিশ্চিত করার পরে, যদি কিছু ছিটেফোঁটা থাকে, সেটুকু রোগীর জন্য ব্যবহৃত হবে। অর্থাৎ মালিকদের মুনাফার লোভের শিকার হয়ে সাধারণ মানুষ কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন।
স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের মাধ্যমে পরিষেবা পাওয়ার প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, গত ভোটের পর থেকে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দেখলেই বেসরকারি হাসপাতাল বলছে ‘বেড খালি নেই’, অন্য দিকে এই হাসপাতালগুলি লক্ষ লক্ষ টাকা বকেয়া বিল না পেয়ে কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ করেছে। আমরা জানি, বিমাকার্ড সব সময়ই নানা শর্ত নির্ভর এবং বিমা কোম্পানি ও থার্ড পার্টির মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। ফলে মানুষের স্বাভাবিক চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হতে বাধ্য। এ ছাড়াও যে প্রশ্নগুলি উঠছে তা হল, ৫ লক্ষ টাকা শেষ হলে পরিবারের বাকিরা চিকিৎসা পাবেন কি না, অন্য রাজ্যের মানুষ এই পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হবেন কি না এবং স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থাকা সত্তে্বও মানুষ যে হয়রানির শিকার হন তা দূর হবে কি না।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দাবিঃ
১)সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড বাধ্যতামূলক করা বন্ধ করুন।
২)জনগণের ট্যাক্সের টাকা বিমা কোম্পানি ও থার্ড পার্টি এজেন্সির মুনাফা গড়ার কাজে না দিয়ে সেই টাকায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতি সাধন করে জনসাধারণের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করুন।