চিকিৎসার স্বার্থেই চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষা করতে হবে


আমাদের দেশ এবং রাজ্যে করোনো রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। যা অচিরেই অসংখ্য মানুষের হাসপাতালে ভর্তির এবং বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখানো পর্যন্ত যে সব বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে রোগটি ড্রপলেটের (থুথু, কাশি, হাঁচি ইত্যাদি) মাধ্যমে একজন ব্যক্তি থেকে আরেকজন ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করে।
এক্ষেত্রে হাসপাতাল অথবা স্বাস্থ্যকেন্দে্র যেসব রোগী আসেন তাঁদের মধ্যে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হলে তার শরীর থেকে সহজেই ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীর শরীরে করোনা রোগের ভাইরাসটি (এসএআরএস-কোভ-১৯) প্রবেশ করতে পারে।
করোনা দ্বারা যদি চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হন তাহলে শত শত রোগীর দেহে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে সমাজে রোগটি আগুনের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। অন্য দিকে নিয়ম অনুসারে কোনও চিকিৎসক কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী এই রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর সংস্পর্শে যত চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন তাঁদের সকলকেই ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হবে এবং জ্বর-গলা ব্যথা-কাশি ইত্যাদি উপসর্গ থাকলে তাঁকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করতে হবে। বর্তমানে যেখানে প্রয়োজনের তুলনায় ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ ডাক্তার নার্সের পদ ফাঁকা পড়ে রয়েছে সেখানে একসাথে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়ে গেলে হাসপাতাল পরিষেবা চালাবে কে? স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের এই সময়ে বিশেষ গাউন, মাস্ক, গ্লাভস, হেড ক্যাপ, শু কভার গ্লাভস এক কথায় পিপিই বা পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্টেস পরে রোগী পরিষেবা দেওয়ার কথা। ক্ষেত্র বিশেষে কোথাও এন৯৫ মাস্ক এবং গ্লাভস, কোথাও বিশেষ মেডিকেল মাস্ক ও গ্লাভস এবং যে সব ওয়ার্ডে করোনা রোগী ভর্তি রয়েছেন সেখানে পুরো পিপিই সেটই পরিধান করে রোগী পরিষেবা দিতে হবে। যাতে রোগীর শরীর থেকে কোনও ভাবেই করোনা ভাইরাস ডাক্তারের শরীরে প্রবেশ করতে না পারে।
কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কী? গত বছর ডিসেম্বর মাসেই চীনে সর্বপ্রথম করোনা রোগের সূত্রপাত ঘটে। সেখান থেকে আগুনের মতো দ্রুত পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতে রোগটি প্রথমে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসেই ধরা পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে মার্চের ১৭ তারিখে প্রথম এই রোগী ধরা পড়ে। অর্থাৎ প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় পাওয়া গেছে। বিশেষত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এই নির্দেশিকা দেওয়া সত্তে্বও রাজ্যের প্রথম করোনা হাসপাতাল বেলেঘাটা আইডি-তে এখনও পর্যন্ত পিপিই সরবরাহ হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি। ফলে বেশিরভাগ ডাক্তার-নার্সদের এখনও সাধারণ সার্জিকাল মাস্ক এবং গাউন পরে কাজ করতে হচ্ছে। আইডি হাসপাতালে নার্সদের আন্দোলনের চাপে কর্তৃপক্ষ কিছু পিপিই সরবরাহ করেছে যা অতি নিম্নমানের। রাজ্য জুড়ে সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম এবং মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের আন্দোলনের চাপে কর্তৃপক্ষ সব হাসপাতালেই কিছু পিপিই দিতে শুরু করেছে যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য এবং যা খুবই নিম্নমানের। কোথাও কোথাও পিপিই নামে রেইন কোট সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে। যার প্রতিরোধ ক্ষমতা কী আছে তা নিয়ে চিকিৎসক সমাজ সন্দেহ প্রকাশ করছেন এবং তাঁরা যথেষ্ট অসন্তুষ্ট।
যেখানে দাবানলের মতো এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে সেখানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নির্বিকার। চিকিৎসকরা বলছেন, এখনও চলছে কোন কোম্পানিকে বরাত দিলে কত কাট মানি পাওয়া যাবে– তার হিসেব নিকেশ। সেই জন্য এই সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরেও ভারত থেকে চড়া দামে পিপিই, মাস্ক ও তার কাঁচামাল ইত্যাদি বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গুজরাতের একটি বিশেষ কোম্পানিকেই এর বরাত দেওয়া হয়েছে। আজ যেখানে সমাজ-সভ্যতা ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে আমাদের সরকারের ভূমিকা কতটা নিষ্ঠুর ও নির্মম হতে পারে তা আজ ভাববার বিষয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যেতে পারেন তা জেনেও তারা আজ বিশেষ বিশেষ কোম্পানিকেই ‘পাইয়ে দেওয়ার’ ব্যবস্থার কথা ভাবছে।
এই অনিয়ম এবং রাজ্য তথা দেশজোড়া এই সংকট যাতে কাটানো যায় সেই দাবিতে মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার ও সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম লাগাতার আন্দোলন শুরু করেছে। সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে।