Breaking News

চিকিৎসার নামে লুটেরারা সক্রিয়, সরকার নিষ্ক্রিয়

70 Year 32 Issue 30 March 2018

 

  ধরা যাক, অ্যাম্বুলেন্স চালকের নাম তপন৷ তপন রোজ মরণাপন্ন রোগীদের নিয়ে যায় বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে৷ রোগী যাওয়ার আগেই খবর পৌঁছে যায় সেই সেই হাসপাতালের ‘দাদা’দের কাছে৷ রোগী পিছু তপনের কমিশনও বাঁধা৷ মরতে বসা মানুষগুলোর আত্মীয়স্বজন তখন পরম ভরসায় খডকুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারকে৷ তারপর হাতেগোনা ক’জন বেঁচে ফেরে আর ক’জনের গোটা পরিবারই ঘটিবাটি বেচে শেষ হয়ে যায় হিসেব থাকে না তপনের৷ একদিন হঠাৎ একটা ফোন৷ তারই ছোট্ট মেয়েটাকে সাপে কামড়েছে, অবস্থা ভাল না৷ তপনের সব হিসেব গুলিয়ে যায়৷ অ্যাম্বুলেন্স এর মুখ ঘুরিয়ে রোগী নিয়ে সরকারি হাসপাতালের দিকে ছোটে তপন, মনে মনে মাথা কোটে–‘ভাল’ চিকিৎসার নামে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর শাপ আমার মেয়েটার ওপর যেন না লাগে ঠাকুর৷

সম্প্রতি প্রকাশিত এরকম একটি গল্পের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে রাজস্থানের গোপেন্দ্র সিং পারমারের অভিজ্ঞতা৷ অ্যাম্বুলেন্স চালকের থেকে খোঁজ পাওয়া গুরুগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন গোপেন্দ্র৷ ষোলো লক্ষ টাকা খরচ করে, জমি–জিরেত বেচেও বাঁচাতে পারেননি তাকে৷ এমনই আর একটি বেসরকারি হাসপাতালে সুচিকিৎসার আশায় মেয়েকে নিয়ে ছুটে এসেছিলেন জয়ন্ত সিংহ৷ পনের দিনে সাড়ে পনের লক্ষ টাকা বিল চুকিয়ে মেয়ের মৃতদেহ নিয়ে ফিরতে হয় তাকে৷ একের পর এক এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ন্যাশনাল ফারমাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি (এনপিপিএ) দিল্লি এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের কয়েকটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতালের মাত্রাতিরিক্ত বিলের অঙ্ক নিয়ে যে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, এক কথায় তা ভয়াবহ৷

রিপোর্ট বলছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলো ওষুধ, বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থেকে ১৭৩৭ শতাংশ পর্যন্ত লাভ ওঠাচ্ছে৷ মূল্যনিয়ন্ত্রণের আওতার বাইরে থাকা ওষুধের ক্ষেত্রে এই লাভের মার্জিন ১৬০ থেকে ১২০০ শতাংশ, আর মূল্যনিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকা ওষুধে লাভ হচ্ছে ১১৫ থেকে ৩৬০ শতাংশ৷ হাসপাতালগুলো বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির থেকে একসাথে প্রচুর পরিমাণ ওষুধ কেনে এবং সেসব কোম্পানিকে প্যাকেটে কয়েকগুণ বর্ধিত দাম ছাপার হুকুম দেওয়া থাকে৷ যেমন, ৮–৯ টাকায় কেনা একটি আই ভি সেট (ইন্ট্রাভেনাস ইনফিউশন সেট) হাসপাতাল রোগীকে বিক্রি করছে ১১৫ টাকায়৷ লাভ দাঁডাচ্ছে ১৩৭০ শতাংশ৷ ১.৫ টাকার সিরিঞ্জের দাম ৪৮৩ টাকা, ২ টাকার ভিটামিন ইঞ্জেকশনের দাম ১০৮ টাকা৷ ২৬ টাকার অক্সিজেন মাস্ক আর ৮২ টাকার ইঞ্জেকশন বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ২৩০ টাকা আর ৪২৮ টাকায়৷ একইভাবে স্টপকক ভালভ, সারজিকাল গ্লোভ, ইলাস্টিক ব্যান্ডেজের দামে লাভ রাখা হচ্ছে যথাক্রমে ১৭০০, ৬৬১ ও ৬২৫ শতাংশ৷ প্রিয়জন সুস্থ হয়ে বাডি ফিরবেন কি না সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থেকেই রোগী ও তার অসহায় পরিবার বাজার–মূল্যের থেকে বহুগুণ বেশি দামে এই জিনিসগুলি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন৷ বিপুল অঙ্কের বিলের প্রায় ৫০ শতাংশ আসছে এই দাম থেকে৷ হাসপাতালের দেওয়া প্যাকেজের বাইরে এই বিশাল খরচ মেটাতে গিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, অথচ ‘প্যাকেটে লেখা দামই ধার্য হয়েছে’ তাই আইনি পথেও এগোতে পারছেন না রোগীর পরিবার–পরিজনেরা৷ কেন্দ্রীয় সরকারের রাসায়নিক ও সার মন্ত্রকের অধীনে থাকা এই সংস্থাটি (এনপিপিএ) তার রিপোর্টে বলেছে হাসপাতালগুলোই এই দুর্নীতির জন্য দায়ী, তারাই কোম্পানিগুলোকে বেশি মুনাফার জন্য বেশি দাম ছাপতে বাধ্য করে৷ কেন্দ্রীয় রাসায়নিক ও সারমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করে খুব দ্রুত নতুন ওষুধ নীতি আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ আবার রাজ্যগুলো যথাযথ আইন প্রণয়ন না করলে এক্ষেত্রে কেন্দ্র বা এনপিপিএ–এর মত কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর খুব বেশি কিছু করার নেই, এমন আক্ষেপও উঠে এসেছে কোনও কোনও কর্তাব্যক্তির মন্তব্যে৷

প্রশ্ন হল, বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমগুলোতে যে দিনের পর দিন এই লোকঠকানো ব্যবসা চলছে তা কি এই প্রথম জানা গেল? সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাব্যবস্থার বেহাল দশা দেখে সুচিকিৎসার আশায় অসুস্থ পরিজনকে নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে আসেন৷ ভাবেন, যা টাকা লাগে লাগুক মানুষটা তো সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে৷ তাই এই জোচ্চুরির পরিসংখ্যান চট করে পাওয়া যায় না৷ রোগীমৃত্যুকে কেন্দ্র করে কোথাও প্রশ্ন দেখা দিলে বা জোরালো বিক্ষোভ হলে তখন এই রক্ত নিংড়ে নেওয়া ‘স্বাস্থ্য পরিষেবা’র স্বরূপটা সামনে আসে৷ মিডিয়ায় হইচই চলে কিছুদিন৷ তারপর আবার যে কে সেই৷ দিল্লির হাসপাতাল নিয়ে তদন্ত হলেও এটা যে আজ কমবেশি সারা দেশের চিত্র তা আর বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না৷ খোদ কলকাতার বুকে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যুবক সঞ্জয় রায়ের স্ত্রীকে স্বামীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য না দিয়েই পারিবারিক ফিক্সড ডিপোজিট–এর কাগজ জমা দিতে বাধ্য করেছিল অ্যাপোলো কর্তৃপক্ষ, পরে সঞ্জয় মারা যান৷ অতি সম্প্রতি আমরি হাসপাতালে শিশুকন্যা ঐত্রির মৃত্যুকে ঘিরেও একইরকম অভিযোগ উঠেছে৷ কিছুদিন আগে কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারি স্কুলের অতিরিক্ত ফি নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠে, তদন্ত হয়৷ মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলন করে এসব স্কুল কর্তৃপক্ষকে ফি কমানোর নির্দেশ দেন, মিডিয়া সরগরম হয় দিনকয়েকের জন্য৷ তারপর প্রায় একবছর অতিক্রান্ত৷ অভিভাবকদের অভিজ্ঞতা বলছে কোনও স্কুলেই এই বাড়তি ফি–এর বোঝা এতটুকু কমেনি, বরং আরও বেড়ে চলেছে৷ ঠিক যেভাবে দিল্লির হাসপাতালগুলো তাদের ‘নিজস্ব’ ওষুধ কোম্পানির চড়া দামের ওষুধ কিনতে রোগীদের বাধ্য করে, তেমন বিভিন্ন স্কুলও তাদের ‘নিজস্ব’ প্রকাশনা সংস্থাকে বইয়ের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি ছাপার ফরমান দেয় এবং অভিভাবকদের স্কুলের থেকে বই–খাতা–ইউনিফর্ম সহ বহু জিনিস কিনতে বাধ্য করে৷ দেশে জনগণের নির্বাচিত সরকার, আইন–আদালত থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে এই ধরনের খোলাখুলি জালিয়াতি চলছে কীভাবে? সরকারের যোগসাজশ, বলা ভাল প্রত্যক্ষ মদত না থাকলে দিনের পর দিন আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এ জিনিস চালিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? যে হাসপাতালের বিল নিয়ে এনপিপিএ–এর তদন্ত তারা এতটাই ‘প্রভাবশালী’ যে, রিপোর্টে সেই হাসপাতাল–ওষুধ লবির নাম পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি৷ সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে, রোগীকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলার দায়িত্বে থেকে যারা জোচ্চুরি করে রোগীর পরিবারকে শেষ করে দিচ্ছে সেই খুনি জালিয়াতদের এই ‘প্রভাব’, দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে তাদের নাম গোপন রাখার ক্ষেত্রে এই তৎপরতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল দেশের সরকার আসলে কাদের রক্ষক৷