সদ্য অতিক্রান্ত হল রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ৷ একশো বছর আগে বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ার গ্রামীণ জীবনের যা অবস্থা ছিল, ভারতের অবস্থাও ছিল প্রায় তেমনই৷ খণ্ড খণ্ড জমিতে হাল–বলদ নিয়ে চাষ, জমিদারের অত্যাচার, মহাজনের কাছে ঋণে বাঁধা পড়া, দুর্ভিক্ষ–হাহাকার, অশিক্ষা, সামন্তী কুসংস্কার, ম্যালেরিয়া–কলেরা–ব্যাধিতে গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়া– এই ছিল ভারতের চাষির অবস্থা৷ এর সাথে রাশিয়ার গ্রাম জীবনের পার্থক্য বিশেষ ছিল না৷
১৯১৪ সালে জারশাসিত রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল৷ প্রায় চার বছর ধরে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতিতে নেমে এসেছিল চরম বিপর্যয়৷ কৃষি ও শিল্প উৎপাদন পৌঁছেছিল একেবারে তলানিতে৷ ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি–বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জারকে উৎখাত করে বুর্জোয়া সরকার প্রতিষ্ঠিত হল৷ কিন্তু নতুন শাসকরা যুদ্ধ বন্ধ করল না৷ ফলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এগোল আরও খারাপের দিকে৷ নভেম্বর মাসে লেনিনের নেতৃত্বে সংগঠিত হল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব৷ যুদ্ধবিধ্বস্ত, দুর্ভিক্ষপীড়িত, অত্যন্ত পশ্চাৎপদ এই দেশকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিলেন লেনিন ও তাঁর দল বলশেভিক পার্টি৷
নভেম্বর বিপ্লবের পর রাশিয়ায় শুরু হল এক সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ভূমি–সংস্কার, সূচনা হল নতুন ভূমি–ব্যবস্থার৷ কৃষিপণ্যের বাণিজ্যেও চালু হল সম্পূর্ণ নতুন একটি নিয়ম৷ সেই নতুন ব্যবস্থার ফলে রাশিয়ার চাষিরা কী পেয়েছিল, কী রকম ছিল তার ভূমিব্যবস্থা, কী ভাবে তা চালু হয়েছিল– নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপনের প্রেক্ষাপটে সেগুলি ফিরে দেখা যাক৷
মার্কস–এঙ্গেলসের তত্ত্বগত পথনির্দেশ
১৯১৭ সালের ৭ থেকে ১৭ নভেম্বর দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনে মহান লেনিনের নেতৃত্বে বুর্জোয়া শ্রেণির হাত থেকে ক্ষমতা দখল করেছিল রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণি৷ বিপ্লবকে জয়যুক্ত করার এই কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন৷ কিন্তু তার চেয়েও কঠিন ছিল বিপ্লবকে রক্ষা করা এবং কৃষি, শিল্প সহ সমস্ত কিছুর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটানো৷ এর জন্য প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বগত পথনির্দেশ৷ সেই পথনির্দেশ দিয়েছিলেন মহান মার্কস ও এঙ্গেলস– যা আমাদের কাছে মার্কসবাদ নামে পরিচিত৷ সেই মার্কসবাদ দেখিয়েছে, সমাজের অন্যান্য সম্পত্তির সাথে ভূ–সম্পত্তির উপরও ব্যক্তি–মালিকানার অবসানের মধ্য দিয়েই একমাত্র চাষির জীবনে শোষণের অবসান ঘটানো সম্ভব৷ তাই ‘কমিডনিস্ট পার্টির ইস্তেহার’–এ মার্কস–এঙ্গেলস দ্ব্যর্থহীন ভাবে ‘জমির মালিকানার অবসান’–এর কথা ঘোষণা করেছিলেন৷ জমির এই মালিকানার অবসান ঘটানো যে শুধু চাষি বা শুধুই শ্রমিকদের পক্ষে সম্ভব নয়, ১৮৪৮ থেকে ’৫০ সালে ফ্রান্সে গড়ে ওঠা শ্রেণি সংগ্রামকে বিশ্লেষণ করে তা দেখিয়ে মার্কস শ্রমিক শ্রেণির সাথে চাষির মৈত্রী গড়ে তুলতে বলেছেন৷ মার্কস বলেছেন– ‘‘যতদিন তা করা যাচ্ছে না, ততদিন শ্রমিকরা এক পা–ও অগ্রসর হতে পারবে না এবং বুর্জোয়া ব্যবস্থার কেশও স্পর্শ করতে পারবে না৷’’১ এঙ্গেলসও ‘জার্মানির কৃষক যুদ্ধ’ গ্রন্থের ভূমিকায় চাষিদের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যের কথা বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন৷২
কিন্তু সমাজতন্ত্রের পক্ষে শ্রমিক শ্রেণির সাথে ঐক্য গড়ে তুলতে বললেই কি চাষিরা এগিয়ে আসবে? কলকারখানায় যে শ্রমিকরা কাজ করে, জীবনধারণের জন্য তাদের রয়েছে শুধু শ্রমশক্তি৷ শ্রমশক্তি বিক্রির প্রতিটি মুহূর্তে তারা শোষিত হয়ে মালিকের মুনাফার পাহাড় তৈরি করে৷ এটা যখন তারা বোঝে তখন তাদের সমাজতন্ত্রের পক্ষে থাকাটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু যারা ক্ষুদ্র বা অতি ক্ষুদ্র জোতের মালিক অথবা মধ্যচাষি, তারাও জমিদার বা পুঁজির মালিকের দ্বারা নানাভাবে শোষিত হয়৷ কিন্তু যত সামান্য জোতই তাদের থাকুক না কেন, সম্পত্তির মালিকানাবোধ তাদের সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আশঙ্কায় রাখে৷ তাই এঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘‘ছোট কৃষকদের এমনিতেই আগ্রহ নিয়ে সোস্যালিস্টদের বক্তব্য শোনা উচিত৷ কিন্তু তা সে আপাতত করতে পারছে না৷ তার মনের বদ্ধমূল সম্পত্তিবোধ তাকে এ কাজে বাধা দিচ্ছে৷ তার দুর্দশাপন্ন জমির টুকরোটা বাঁচানো তার পক্ষে যতই দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে, ততই সে বেপরোয়া হয়ে তাকে আঁকড়ে ধরছে এবং ততই সে সমাজতন্ত্রীদের মহাজন ও উকিলদের সমগোত্রীয় দুশমনের মতো সাংঘাতিক বলে মনে করছে৷ কারণ সোস্যালিস্টরা যে যাবতীয় ভূসম্পত্তিকে গোটা সমাজের সম্পদে পরিণত করার কথা বলে’’৩
এই সম্পত্তিবোধ–জাত বিরূপতা কাটিয়ে কীভাবে ছোট চাষিদের সমাজতন্ত্রের পক্ষে টেনে আনা যাবে সে সম্পর্কে এঙ্গেলস বলেছেন, ‘‘… আমরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে যেমন ছোট কৃষকদের সম্পত্তি জোর করে দখলের কথা চিন্তাই করব না (ক্ষতিপূরণ দিয়ে বা না দিয়ে কি না তা বিচারই করব না), তেমনই আবার বড় বড় জোতের মালিকদের বেলায় সেটাই করতে হবে৷ ছোট কৃষকদের সম্পর্কে আমাদের কাজ হল, প্রথমত তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সম্পত্তিকে সমবায়ে রূপান্তরিত করা৷ জোরজবরদস্তি করে নয়, দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, এই উদ্দেশ্যে সামাজিক সাহায্য দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসে৷ তখন অবশ্য আমরা ছোট কৃষককে তার আগামী দিনের সম্ভাব্য সুযোগ সুবিধাগুলি নানান ভাবে দেখিয়ে দিতে পারব …৷’’৩
অপেক্ষাকৃত মাঝারি ও বড় চাষি সম্পর্কে এঙ্গেলস বলেছেন, ‘‘… অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচারে আমরা নিশ্চিত যে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং বিদেশি সস্তা শস্যের প্রতিযোগিতার চাপে বড় ও মাঝারি চাষিদের ধবংস অনিবার্য৷ চাষিদের ক্রমবর্ধমান ঋণ এবং সর্বত্র প্রকট ভাঙনের চেহারা তারই নিদর্শন৷ আমরা এই ভাঙন রুখতে কিছুই করতে পারি না, কেবল খামারগুলোকে জড়ো করে সমবায়ের উদ্যোগ গড়ে তোলার প্রস্তাবটা দেওয়া ছাড়া৷ এই সমবায়গুলোতে ক্রমশ মজুরি–শ্রমিকদের শোষণ বন্ধ করা হবে এবং ক্রমশ এগুলোর জাতীয় উৎপাদকদের বৃহৎ সমবায়ে রূপান্তর ঘটানো যাবে– যেখানে প্রতিটি শাখার সমান অধিকার ও কর্তব্য থাকবে৷ যদি এই কৃষকরা তাদের বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী বিনাশের পরিণতির কথাটা বুঝতে পারে এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে তারা আমাদের দিকে আসবে৷ আর তখন আমাদের দায়িত্ব হবে– সর্বশক্তি দিয়ে তাদের পরিবর্তিত উৎপাদন পদ্ধতিতে নিয়ে যাওয়ার কাজকে ত্বরান্বিত করা৷’’৩
বড় জমিদারি সম্পত্তি সম্পর্কে এঙ্গেলস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ‘‘একমাত্র বড় জমিদারি সম্পত্তিগুলির ব্যাপারটি সহজ৷ … যে মুহূর্তে আমাদের পার্টি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করবে, সেই মুহূর্তেই তার কাজ হবে শিল্পের উৎপাদকের মতো সোজাসুজি বড় বড় ভূ–সম্পত্তির মালিকদের মালিকানা কেড়ে নেওয়া৷ … এইভাবে বড় বড় সম্পত্তিগুলি সমাজের হাতে আসার পর গ্রামের শ্রমিকদের, যারা আগে থেকেই চাষ–বাস নিয়ে রয়েছে, তাদের মধ্যে তা বিলি করে দিতে হবে, তাদের সমবায় সংস্থার মাধ্যমে সংগঠিত করতে হবে৷ সমাজের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে তাদের ব্যবহার ও উপকারের জন্য তা ন্যস্ত করা হবে৷ তাদের ভোগ–দখলের শর্ত কী হবে তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না৷ যাই হোক, একটা পুঁজিবাদী উদ্যোগকে সামাজিক ডদ্যোগে রূপান্তরিত করার পূর্ণ প্রস্তুতি এখানে চলছে …৷ এইভাবে শহরের শিল্পশ্রমিকদের মতোই গ্রামের সর্বহারাদের সামনেও একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বার আমরা উন্মুক্ত করে দিতে পারি৷’’৩
গ্রামীণ রাশিয়ার বিশেষ অবস্থা
ভূমিদাস প্রথা বিলোপ করে কৃষকের হাতে জমি দেওয়ার দাবি ছিল সে যুগের একটি গণতান্ত্রিক দাবি৷ ইউরোপের অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি দেশে ভূমিদাস প্রথা রদ ও চাষিদের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের প্রভাব রাশিয়ার মাটিতেও পড়েছিল৷ ফলস্বরূপ জারতন্ত্রের রাশিয়ায় ভূমিদাস ব্যবস্থার অবসান এবং চাষির হাতে জমির দাবি ১৮৫০ সালের পর থেকেই জোরদার হতে থাকে৷ শুরু হয় কৃষক বিদ্রোহ৷ এর বিপরীতে জার, অভিজাত ও জমিদাররা যেমন ছিল, তেমনি ভূস্বামীদের স্বার্থে পুরোহিতদের প্রধান ধর্মাধ্যক্ষ ফিলারেতও ধর্মপ্রাণ মানুষকে বোঝাতে থাকেন ‘ভূমিদাসত্ব হল পবিত্র শাস্ত্র অনুমোদিত এবং ঈশ্বর অনুমোদিত’৷ কিন্তু কৃষকরা তখন আর পুরোহিতদের এইসব কথা বিশ্বাস করেনি৷ তাদের বিদ্রোহ দানা বাঁধতে থাকে৷ কিছুদিন পর ক্রিমিয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে জার সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে এবং চাষি–বিদ্রোহে শঙ্কিত জার সরকার ১৮৬১ সালে ভূমিদাস প্রথা বিলোপে আইন করতে বাধ্য হয়৷
কিন্তু ভূমিদাস প্রথা বিলোপের ফলে কিছু অধিকার অর্জন করলেও প্রকৃত অর্থে ইডরোপের অন্যান্য দেশের মতো জমিদারের জুলুমের হাত থেকে চাষিরা মুক্তি পেল না৷ ভূমিদাস প্রথা রদ হলেও ভূস্বামীরা ঘুর পথে জমির বড় বড় অংশ চাষিদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজেদের কুক্ষিগত রাখল৷ পুরুষানুক্রমে চাষিরা যে জমি চাষ করত, অভিজাতদের কমিটির সুপারিশ মতো সেই জমিই তাদের কিনে নিতে বাধ্য করা হল৷ শুধু তাই নয়, কমিটির জারি করা সনদ চাষিদের মানাতে এবং অনুর্বর ছাঁট–জমিগুলি জোর করে চাষিদের ইজারা নিতে বাধ্য করতে জার সরকার সামরিক পিটুনি ব্যবস্থা চালু করে এবং বহু ক্ষেত্রে সৈন্য পর্যন্ত প্রেরণ করে৷ লেনিন একে জার সরকারের সহযোগিতায় অভিজাতদের কমিটির চাষিদের উপর সরাসরি ডাকাতি হিসেবে অভিহিত করেন৷ ইউরোপের অন্যান্য দেশে ভূমিদাস প্রথার অবসানের পর চাষিরা ছিল অনেক বেশি স্বাধীন৷ তারা কারও অনুমতি না নিয়েই যাকে খুশি জমি বিক্রি করতে পারত৷ কিন্তু জারের রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথার অবসানের পর অভিজাত ও ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছে মতো জমি বিক্রির অধিকারি হলেও চাষিরা গ্রামগোষ্ঠীর অনুমতি ছাড়া জমি বিক্রি করতে পারত না৷ কারণ হিসেবে বলা হত, গরিব চাষিকে নিজের জমি বিক্রির অধিকার দিলে নাকি চাষি জমি বিক্রি করে টাকাটা বাজে নষ্ট করবে৷ নারোদনিক এবং সোস্যালিস্ট রেভলিউশনারিরাও এইসব কথায় বিশ্বাস করে ‘চাষির মঙ্গল কামনায়’ চাষির জমি বিক্রি নিষিদ্ধ করার কথা মেনে নিত এবং বলত যে, জমি বিক্রি করতে দেওয়ার চেয়ে বরং তাদের খানিকটা ভূমিদাস হয়ে থাকাই ভাল৷
ভূমিদাস প্রথা রদ হলেও তখনও সামন্তী গোলামির মতোই চাষিদের জমিদারের কাছে নানা রকম আদায়ী–ট্যাক্স দিতে হত৷ জমি বন্টনও জমিদাররা এমনভাবে করেছে যাতে চাষির পক্ষে যে জমি অপরিহার্য তেমন জমি অর্থাৎ গোচারণভূমি, জলাশয়– যা ছাড়া চাষির চলে না, তা জমিদারের হাতেই রেখে দেওয়া হয়৷ ছাঁট–জমি ব্যবহারের জন্য জমিদারের জমিতে আগের মতোই ধনী গরিব নির্বিশেষে চাষিকে বেগার খাটতে হত৷ আবার সেই জমি চাষ করার জন্য যে চাষির ঘোড়া ও লাঙল নেই, জমিদারের কাছ থেকে তা নেওয়ার বিনিময়ে বিনা পারিশ্রমিকে জমিদারের জমির অংশবিশেষ চাষ করে দিতে চাষিরা বাধ্য থাকত৷ অনেককেই নিজেদের ঘোড়া দিয়ে চাষ করে দেওয়া, ফসল তোলা, জমিদারের গবাদিপশুর বিচালি কেটে দেওয়া, শস্য ঝাড়াই–মাড়াই করা, জমিদারের জন্য ঘরে বোনা কাপড়, ডিম, মুরগি পৌঁছে দেওয়া– এসবও করতে হত, ঠিক একেবারে ভূমিদাসত্বের মতোই৷
ধনী চাষিরা মাঝে মাঝে জমিদারকে টাকা দিয়ে বেগার খাটুনি থেকে রেহাই পেলেও জমিদার ধনী চাষিকে ভাল রকমেই শুষে খেত৷ তাই ধনী চাষিরাও ছিল জমিদার ও অভিজাতদের বিরুদ্ধে৷ পলতাভা, খারকভ ও অন্যান্য গুর্বেনিয়ার অঞ্চলের জমিদাররা চাষির বোনা ফসলও দখল করত৷ এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৯০২ সালে চাষিরা জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তাদের গোলাবাড়ি ভেঙে ফেলে ফসল বিলিয়ে দেয় ক্ষুধার্তদের মধ্যে৷ জমির পুনর্বন্টনও তারা দাবি করে৷ কিন্তু জার সরকার এদের দাঙ্গাবাজ এবং ডাকাত বলে ঘোষণা করে সৈন্য পাঠিয়ে চাষিদের পরাস্ত করে৷ গুলি করে হত্যা করে অনেককে, নির্মমভাবে বেত মারা হয় চাষিদের উপর৷ মেয়ে–বৌদের বলাৎকার করে জারের সৈন্যরা৷ এত সব কিছুর পরেও চাষিদেরই বিচার হয়েছে জারের আদালতে৷ জমিদারদের জন্য ৮ লক্ষ রুবল ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়েছে চাষিদের৷ জুলুম কুঠুরির মধ্যে চালানো এইসব মোকদ্দমায় আসামীদের পক্ষে ডকিলকেও বলতে দেওয়া হয়নি৷
লেনিনের নেতৃত্ব
মার্কস–এঙ্গেলসের সুযোগ্য উত্তরসূরি কমরেড লেনিন রাশিয়ার মাটিতে ব্যর্থ এই কৃষক–বিদ্রোহ সম্পর্কে বলেছেন– ‘‘কৃষক বিদ্রোহ দমিত হয়েছে কারণ এটা ছিল অজ্ঞান ও অচেতন মানুষের বিদ্রোহ, পরিষ্কার ও সুনির্দিষ্ট এক রাজনৈতিক দাবি অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবি ছাড়াই এক বিদ্রোহ৷ কৃষক বিদ্রোহ দমিত হল কারণ বিদ্রোহের জন্য কোনও প্রস্তুতি ছিল না৷ কৃষক বিদ্রোহ দমিত হল কারণ শহরের প্রলেতারীয়দের সঙ্গে গাঁয়ের প্রলেতারীয়রা তখনও জোট বাঁধেনি৷ কৃষকদের প্রথম ব্যর্থতার এই হল তিনটি কারণ৷ সফল হতে হলে অভ্যুত্থান হওয়া চাই সচেতন ও প্রস্তুত, তাকে ছড়িয়ে পড়তে হবে সারা রাশিয়ায় এবং জোট বাঁধতে হবে শহরের শ্রমিকদের সঙ্গে৷’’৪
রাশিয়ার এই বিশেষ পরিস্থিতিতে ভূমিদাসত্ব থেকে সকল চাষির পরিপূর্ণ মুক্তির জন্য লেনিন ধনী চাষিদেরও সঙ্গে নিয়ে লড়াইয়ের কথা বলেছিলেন৷ আবার একই সঙ্গে ধনী চাষিদের সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন– ‘‘যত দ্রুত এবং যত বেশি করে আমরা ভূমিদাসত্ব দূর করতে পারব, চাষিরা যতই বেশি স্বাধীনতা পাবে, ততই দ্রুত গাঁয়ের গরিবেরা নিজেদের ভিতর একত্র হবে এবং ততই দ্রুত ধনী চাষিরা মিলবে সমস্ত বুর্জোয়াদের সঙ্গে৷’’৪
ভূমিদাস প্রথা রদ হওয়ার পর ১৮৭৭–’৭৮ সালের হিসাব অনুযায়ী রাশিয়ায় জমির মালিকানায় কী বিপুল বৈষম্য ছিল লেনিন চাষিদের তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখান৷ রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশে, রাষ্ট্রীয় অধিকারে থাকা জমি বাদে, মোট ২৪ কোটি দেসিয়াতিনা (প্রায় ৫৩.৩ কোটি একর) চাষিবিলি জমি ও খাস জমির ৫৪.৬ শতাংশ যেখানে এক কোটিরও বেশি চাষির দখলে, সেখানে মাত্র পাঁচ লক্ষ ধনী ব্যক্তি মালিকের দখলে ছিল ৪৫.৮ শতাংশ জমি৷ অন্যভাবে বললে, গড়ে প্রতিটি চাষি পরিবারের দখলে যেখানে মাত্র ১৩ দেসিয়াতিনা (বা ২৮.৯ একর) জমি ছিল, সেখানে ধনী চাষিদের বেলায় পরিবার পিছু জমির গড় পরিমাণ ২১৮ দেসিয়াতিনা (বা ৪৮৪.৫ একর)৷ আবার এই পাঁচ লক্ষ ধনী চাষির মধ্যে ১৬ হাজার পরিবারের দখলে ছিল পরিবার পিছু এক হাজার দেসিয়াতিনা জমি এবং মাত্র ৯২৪টি পরিবারের প্রতিটির হাতে ছিল ১০ হাজার দেশিয়াতিনারও বেশি জমি৷ আর শুধুমাত্র জারের পরিবারের দখলেই ছিল ৭০ লক্ষ দেসিয়াতিনা জমি, যা সেই দেশের পাঁচ লক্ষ চাষি পরিবারের জমির সমান৷
চাষের কাজে রাশিয়ায় ব্যবহূত হত ঘোড়া৷ ঘোড়ার মালিকানা দিয়ে লেনিন অত্যন্ত সহজভাবে দেখিয়েছেন চাষি পরিবারগুলির কী দুর্দশা তৎকালীন রাশিয়ার এক কোটি চাষি পরিবারের মধ্যে ৩০ লক্ষ পরিবারের চাষের জন্য কোনও ঘোড়া ছিল না, ৩৫ লক্ষ পরিবারের ছিল মাত্র একটি করে ঘোড়া৷ অর্থাৎ এই ৬৫ শতাংশ চাষি পরিবার ছিল একেবারে নিরন্ন, নয়ত খুবই গরিব৷ এরাই হল গ্রামের প্রলেতারিয়েত৷ ২০ লক্ষ পরিবারের ছিল দুইটি করে ঘোড়া, এরা হল মাঝারি চাষি৷ বাকি ১৫ লক্ষ ধনী চাষির ছিল ৭৫ লক্ষ ঘোড়া অর্থাৎ পরিবার পিছু গড়ে পাঁচটি করে ঘোড়া৷ লেনিন সহজ ভাষায় বর্ণনা করে দেখিয়েছেন, সমগ্র রাশিয়ার মোট দেড় কোটি ঘোড়ার অর্ধেক অর্থাৎ ৭৫ লক্ষই মোট চাষি পরিবারের মাত্র ১৫ শতাংশ ধনী চাষিদের দখলে৷ এর অর্থ চাষিদের সমগ্র আবাদী জমির যা পরিমাণ তার অর্ধেকই হল এই ধনী চাষিদের আবাদী জমি৷ পরিবারের জন্য যা দরকার তার চেয়ে অনেক বেশি ফসল তোলে এই ধনী চাষিরা৷ শস্য এরা ফলায় নিজেদের খাওয়া পরার জন্য নয়, বিক্রি করার জন্য, টাকা করার জন্য৷ সেই টাকা তারা ব্যাঙ্কে জমা রাখে, টাকা দিয়ে তারা চিরস্থায়ী স্বত্বে জমি কেনে অভাবগ্রস্ত চাষির কাছ থেকে৷ এছাড়াও নানা অজুহাতে তারা গরিবের সেরা জমিগুলি ছিনিয়ে নেয়৷ আর প্রতিটি দুর্ভিক্ষে, প্রতিটি শস্যহানিতেই হাজার হাজার গরিবের জোতের সর্বনাশ হয়৷ আর তাই বছর বছর বেশি বেশি করে পরিবার ধবংস হয়, তারা হয় দিনমজুরে পরিণত হয়, না হয় চলে যায় শহরে আর ফ্যাক্টরিতে, হয়ে ওঠে গতরখাটা শ্রমিক৷৪
এদের দুর্দশার কথা ডল্লেখ করে লেনিন বলেন, ‘‘… ভরপেট খাওয়া তার কখনওই জোটে না, চিরকালই সে থেকে যায় ভুখা৷ জোত তার ভাঙন ধরা, চাষের পশুর অবস্থা শোচনীয়, ঠিক মতো জমির পরিচর্যা করার ক্ষমতা নেই তার৷ … বছরে কুড়ি রুবলের বেশি সে কিছুতেই খরচ করতে পারে না৷ খাজনা দেওয়া, চাষের জন্য পশু কেনা, কাঠের লাঙল এবং অন্যান্য হাতিয়ার মেরামত করা– ইত্যাদি সবকিছুর জন্য মাত্র কুড়ি রুবল! একে কি চাষি বলা যায় কখনও? এ হল চিরন্তন কৃচ্ছসাধন৷’’৪
এই গতরখাটা কৃষিমজুর, গরিব ও নিম্নবিত্ত চাষির যখন প্রচলিত ব্যবস্থায় ধবংসের দিকে যাওয়া ছাড়া আর কোনও গতি নেই, তখন মার্কসবাদের শিক্ষায় লেনিন দেখালেন, শহরের শ্রমিকদের সাথে একজোট হয়ে এই ব্যবস্থাটা ভেঙে নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্যেই রয়েছে তাদের মুক্তি৷ তিনি দেখালেন, মাঝারি চাষিরাও ধীরে ধীরে ধবংসের পথে এগোচ্ছে৷ ভাল ফসলের বছরে চাষের উপর তার সংসার খরচা পুষিয়ে যায়, কিন্তু অভাব তার পেছন ছাড়ে না৷ খামার থেকে সে টাকা তুলতে পারে নিতান্ত ক্বচিৎ–কদাচিৎ৷ মজুর হিসাবেও তারা খাটতে বাধ্য হয়, অভাবের জ্বালায় জমিদারের কাছে দাসখত লিখে দিতে হয় তাদের, ঋণে জড়ায়৷ আর একবার ঋণে জড়ালে তা থেকে নিস্তার পাওয়া মাঝারি চাষির সাধ্যে প্রায়ই কুলায় না৷ সেই জন্য একবার ঋণে জড়ানো মানেই হাড়িকাঠে গলা দেওয়া৷ মাঝারি চাষির জীবন হল– না ঘরকা, না ঘাটকা! না হতে পারে সে কর্তৃত্ববান মনিব, না মজুর৷ তাই লেনিন দেখালেন, মাঝারি চাষিদের বুঝিয়ে ধনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাদেরও সামিল করতে হবে৷ লেনিন মাঝারি চাষিদের উদ্দেশে বললেন, ‘‘… গরিব কি মাঝারি চাষিকে যদি বলা হয় যে, উন্নত চাষ আর সস্তা লাঙলের দৌলতে তাদের সকলেরই দারিদ্র দূর হয়ে যাবে, নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারবে তারা, এবং তা করে যাবে ধনীদের গায়ে মোটেই হাত না দিয়ে, তবে সে কথাটি প্রবঞ্চনা মাত্র৷ এই সব উন্নয়নে, … সবচেয়ে বেশি উপকার হয় ধনীদেরই৷ ধনীরা আরও শক্তিশালী হয়ে ডঠে গরিব আর মাঝারি চাষির উপর বেশি করে জুলুম করে৷ যতদিন ধনী ধনীই থেকে যাচ্ছে, যতদিন জমি, পশুপাল, হাতিয়ারপত্র এবং টাকার বেশির ভাগটা থাকবে তাদের দখলে, ততদিন অভাবের হাত থেকে গরিব এমনকী মাঝারি চাষির নিস্তার নেই৷ … সমস্ত মাঝারি চাষিকেই যদি ধনী হতে হয়, তা হলে বিতাড়িত করতে হবে ওই ধনীদেরই৷ আর তাদের বিতাড়িত করতে পারে কেবল শহরের শ্রমিক এবং গাঁয়ের গরিবদের সমিতি৷
রাশিয়ায় নারোদনিক এবং এমনকী সোস্যালিস্ট রেভলিডশনারি দলও দৃশ্যত ছিল জমিদার ও ধনী চাষিদের বিরুদ্ধে৷ তারা গরিব চাষির জমির উপর অধিকারের কথা বলত এবং গরিবের স্বার্থে আন্দোলনও করত৷ নারোদনিকরা, যারা ‘ক্ষুদে জোতের সমর্থক’ বলে নিজেদের জাহির করত, তাদের মুখোশ খুলে দিয়ে লেনিন বলেছেন, ‘‘বুর্জোয়াদের সমর্থকরা নিজেদের ছোট চাষির পক্ষের লোক এবং বন্ধু বলে ভান করে, আর বুর্জোয়াদের প্রচেষ্টায় সর্ববিধ উপায়ে উৎসাহ ও আনুকূল্য দিতে চায়৷ সরল বুদ্ধির অনেকেই ছদ্মবেশী নেকড়েকে চিনতে না পেরে এই বুর্জোয়া প্রবঞ্চনাটিরই পুনরাবৃত্তি করে যায়, ভাবে যে গরিব আর মাঝারি চাষির বুঝি উপকার করছে৷ … বলা হয়ে থাকে যে, চাষের মধ্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক ও লাভজনক হল ক্ষুদ্রাকার চাষ, ক্ষুদ্র চাষের উন্নতি হচ্ছে এবং সেই জন্য, তাদের মতে, সর্বত্রই কৃষিতে ক্ষুদে চাষির সংখ্যা এত বেশি৷ সেই জন্যই নাকি তারা জমির সঙ্গে অমন আঁকড়ে থাকে …৷ মধুমাখা বুলির এইসব লোকেরা বলে, ক্ষুদে চাষির নাকি বেশি টাকার দরকার নেই৷ বড় চাষির চেয়ে ছোট আর মাঝারি চাষিরা বেশি মিতব্যয়ী, বেশি ডদ্যোগী, সাদাসিধে জীবনযাপন করতে তারা জানে৷ গবাদি পশুর জন্য বিচালি না কিনে তারা শুকনো খড় দিয়েই চালায়৷ দামি একটা যন্ত্র না কিনে ওরা খুব ভোরে উঠে বেশিক্ষণ ধরে মেহনত করে মেসিনের সমান কাজ তোলে৷ নানা রকম মেরামতির জন্য পরকে টাকা না দিয়ে ছোট ও মাঝারি চাষি নিজেই কুড়ুল নিয়ে বসে যায় ছুতোরের কাজ করতে – তাতে বড় চাষির চেয়ে তার মেরামত অনেক সস্তা পড়ে৷ … কী রকম সুবিধা, কী রকম সস্তারই না ব্যাপার এসব মাঝারি ও ছোট চাষিরা যে অমন পরিশ্রমী, অমন সাদাসিধে জীবন কাটায়, বাজে ব্যাপারে সময় নষ্ট করে না, সমাজতন্ত্রের কথা ভাবে না, ভাবে কেবল নিজের জোতটা নিয়ে, সেটা কী প্রশংসারই না ব্যাপার …। মধুমাখা এসব বুলি আসলে প্রবঞ্চনা মাত্র, চাষিকে নিয়ে উপহাস৷ মিষ্টিমুখ এইসব লোকেরা তাকেই বলে সস্তার চাষ, লাভের চাষ, যেটা আসলে হল অভাব, ভয়ঙ্কর রকমের একটা অভাব অনটন, যার জন্য মাঝারি আর ছোট চাষি বাধ্য হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেহনত করতে, রুটির প্রতিটি টুকরো ছোট করে কাটতে, একটা পয়সাও না খরচ করে চলতে৷ তিন বছর ধরে একই প্যান্ট পরে কাটানো, দড়ি দিয়ে কাঠের লাঙলটাকে বেঁধে নেওয়া আর চালের পচা খড় টেনে গরুকে খাওয়ানোর চেয়ে ‘সস্তা’ আর ‘লাভের’ সত্যিই আর কিছু হতে পারে না এমন একটা ‘সস্তা’ আর ‘লাভের’ জোতজমিতে বুর্জোয়া আর ধনী চাষিকে এনে বসালে মিষ্টি মিষ্টি এসব কথা তার উড়ে যাবে মুহূর্তেই’’৪ এভাবেই লেনিন গ্রামের মানুষের মধ্যে শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী কারা বিপ্লবের পক্ষে আসবে এবং কারা বিপ্লববিরোধী শক্তি তা ব্যাখ্যা করে দেখান৷
১৯১৭ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়৷ এতদিন পর্যন্ত বলশেভিকরা ভূমি সংক্রান্ত যে দাবিগুলি প্রচার করছিল, সে বছর মে মাসে কৃষক প্রতিনিধিদের সারা রাশিয়া সম্মেলনে সেই গণতান্ত্রিক দাবিগুলিই বুর্জোয়া সরকারকে রূপায়িত করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়৷ সেই দাবিগুলির অন্যতম ছিল :
(১) সমস্ত জমিদারি ভূ–সম্পত্তি, সমস্ত ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূ–সম্পত্তি, রাজপরিবারের সম্পত্তি বিনা ক্ষতিপূরণে জনগণের কাছে হস্তান্তর করতে হবে৷ (২) কৃষক প্রতিনিধি পরিষদের মাধ্যমে সংগঠিত উপায়ে স্থানীয় এলাকার জমি উদ্ধার করে বিদ্যমান সামন্তী অর্থনৈতিক শোষণ থেকে কৃষক জনসমষ্টিকে রক্ষা করতে হবে৷ (৩)সামগ্রিকভাবে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেশের সমস্ত জমি রাষ্ট্রের সম্পত্তিতে পরিণত করতে হবে৷(৪)ভূমি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থানীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে ন্যস্ত করতে হবে এবং স্থানীয় কৃষকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সংগঠিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে, সংখ্যালঘিষ্ঠ ভূস্বামী বা জমিদারদের সাথে সম্পাদিত কোনও চুক্তির ভিত্তিতে নয়৷(৫)জীবিকা নির্বাহের জন্য ধনীচাষিদের জমিতে কাজ করতেও বাধ্য থাকা খেতমজুর ও গরিব চাষিদের ধনী চাষিদের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে৷ এদের সাধারণ কৃষকদের সোভিয়েতে অন্তর্ভুক্ত রেখেও আলাদা গ্রুপে রাখার ব্যবস্থা করা হবে৷(৬) কৃষি উৎপাদনের যন্ত্রপাতি ও গবাদিপশু– যা ছাড়া কৃষি উৎপাদন সম্ভব নয়, তা সাধারণের ব্যবহারের জন্য ভূস্বামীদের থেকে দখল নিতে হবে৷(৭) সকল বৃহৎ জমিদারিসমূহ আদর্শ খামারে রূপান্তরিত করে, কৃষি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে এবং স্থানীয় খেতমজুর প্রতিনিধিদের সোভিয়েতসমূহের নির্দেশ মতো সর্বোৎকৃষ্ট সরঞ্জামাদির সাহায্যে চাষাবাদ করতে হবে৷
এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভূস্বামীদের পক্ষ অবলম্বন করে সরকার বলে যে, বিনা ক্ষতিপূরণে কৃষকের কাছে জমিদারি ভূসম্পত্তি হস্তান্তর একটা অবৈধ কাজ৷ তারা কৃষি সংক্রান্ত জটিলতাগুলি স্থানীয় পর্যায়ে চাষি এবং ভূস্বামীদের নিয়ে গ্রামীণ সরবরাহ কমিটির অধীনে সালিশি সংস্থা স্থাপন করে মীমাংসা করতে বলে৷ বুর্জোয়া সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে লেনিন বলেন– কোনও ব্যতিক্রম ছাড়াই মূল্য বাবদ কিছুই পরিশোধ না করে জমিদারির ভূসম্পত্তিগুলি অধিগ্রহণ করে স্থানীয় কৃষকদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে৷ তবে চাষের জন্য চাষিদের মধ্যে বন্টন করা হলেও জমির মালিকানা থাকবে রাষ্ট্রের হাতে৷ (পরবর্তী সংখ্যায়)
১৷ ফ্রান্সে শ্রেণি সংগ্রাম (১৮৪৮–’৫০) – কার্ল মার্কস
২৷ জার্মানির কৃষকযুদ্ধ গ্রন্ধের ভূমিকা – ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
৩৷ ফ্রান্স ও জার্মানিতে কৃষকদের সমস্যা – ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
৪৷ গ্রামের গরিবদের প্রতি – ভি আই লেনিন