সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির ২০২৩–২৪ বর্ষের মাশুল তালিকা (ট্যারিফ অর্ডার) প্রকাশিত হয়েছে৷ তাতে দেখা যাচ্ছে গ্রাহকদের ওপর নানা অযৌক্তিক চার্জ চাপানো হয়েছে৷ এতদিন লাইন কাটা যাওয়ার পর তা জোড়ার জন্য ডিসকানেকশন–রিকানেকশন (ডিসিআরসি) চার্জ ছিল ১০০ টাকা৷ এবার গৃহস্থ, বাণিজ্যিক, ক্ষুদ্রশিল্পে (৫০ কে ভি এ লোড পর্যন্ত) এই চার্জ হবে ৫০০ টাকা৷ এছাড়া দ্বিগুণ হারে ফিক্সড চার্জ ধার্য করা হয়েছে৷ মিনিমাম চার্জ প্রায় তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে৷ গ্রাহকরা বারবার দাবি জানিয়েছেন বিল জমা দিতে দেরি হলে যে লেট পেমেন্ট সারচার্জ দিতে হয় তা কখনওই ব্যাঙ্ক যে হারে সুদ দেয় তার থেকে বেশি হতে পারে না৷ এর আগে এই দাবির যৌক্তিকতা বিদ্যুৎ কোম্পানির অফিসাররা অস্বীকারও করতে পারেননি৷ অল বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন (অ্যাবেকা) এই বিদ্যুৎ গ্রাহক স্বার্থবিরোধী ট্যারিফ অর্ডারের প্রতিবাদে ২২–২৮ মে সারা বাংলা প্রতিবাদ সপ্তাহের ডাক দিয়েছিল৷
২৩ মে প্রতিবাদ সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন অ্যাবেকার নেতৃত্বে রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির চেয়ারম্যান, রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং প্রায় সমস্ত জেলার রিজিওনাল ম্যানেজার ও ডিভিশনাল ম্যানেজারদের কাছে ব্যাপক গ্রাহক বিক্ষোভ হয়৷ গ্রাহকরা এই ট্যারিফ অর্ডার প্রত্যাহার এবং স্মার্ট প্রি–পেইড মিটার বসানো বন্ধ করার দাবি জানান৷
অ্যাবেকার নেতৃবৃন্দ বলেন, এই ট্যারিফ অর্ডারে শুধু ডিসিআরসি চার্জ পাঁচগুণই করা হয়নি, ফিক্সড চার্জ এবং মিনিমাম চার্জও মারাত্মকভাবে বাড়ানো হয়েছে৷ অথচ, ফিক্সড চার্জ আলাদা করে ধার্য করাটাই অযৌক্তিক৷ কারণ বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানি যে মোট খরচের হিসাব ধরে গ্রাহকদের মাশুল ঠিক করে সেই এগ্রিগেট রেভিনিউ রিকোয়ারমেন্টের মধ্যেই ১৯টা বিষয় বা আইটেম ধরা আছে৷ বিদ্যুৎ কেনা, জ্বালানি খরচ ছাড়াও ১৭টা আইটেম এতে আছে৷ সব মিলিয়ে কোম্পানির ফিক্সড বা ভ্যারিয়েবল দুধরনের খরচই পুরোপুরি এর মধ্যে ধরা আছে৷ তাহলে এর বাইরে কোনও বিষয়ের জন্য আলাদা করে ফিক্সড বা ডিম্যান্ড চার্জ নেওয়া যায় না৷ এর পরেও বর্তমান ট্যারিফ অর্ডারে লো এবং মিডিয়াম ভোল্ট কনজিউমারদের ওপর এই অযৌক্তিক ফিক্সড চার্জের বোঝা দ্বিগুণ করা হয়েছে৷ সাধারণ গ্রাহকদের মিনিমাম চার্জ এমন করে বৃদ্ধি করা হয়েছে যেন কম বিদ্যুৎ খরচ করাটাই অন্যায়৷ গৃহস্থ গ্রাহকদের মিনিমাম চার্জ ২৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭৫ টাকা, বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৫ টাকা, কৃষি গ্রাহকদের এতদিন মিনিমাম চার্জ ছিল না, এখন হল ৭৫ টাকা, ক্ষুদ্রশিল্প গ্রাহকদেরও মিনিমাম চার্জ শূন্য ছিল, এখন তা ২০০ টাকা৷ লেট পেমেন্ট সারচার্জ নেওয়া হয় বিলের ওপর ২৪ শতাংশ হারে৷ অ্যাবেকার দাবি তা ব্যাঙ্ক রেটে করতে হবে৷ এই দাবিকে বন্টন কোম্পানির কর্তৃপক্ষ মৌখিকভাবে মান্যতা দিয়েছিলেন৷ কিন্তু তা কমানো হয়নি৷
ক্ষুদ্র গ্রাহকদের ওপর বোঝা চাপালেও দেখা যাচ্ছে, হাই ও এক্সট্রা হাই ভোল্টেজ ব্যবহারকারী বৃহৎ পুঁজির গ্রাহকদের এনার্জি চার্জ কমানো হয়েছে, ফিক্সড চার্জ একই রাখা হয়েছে৷ অ্যাবেকা নেতৃত্ব বলেন, বন্টন কোম্পানি সাধারণ গ্রাহকদের উপর টাকার বোঝা বাড়িয়ে তা দিয়ে বৃহৎ পুঁজির গ্রাহকদের ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে চেয়েছে৷
বন্টন কোম্পানির চেয়ারম্যানের অবর্তমানে তিনজন ডাইরেক্টর প্রায় এক ঘন্টা প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করেন৷ তাঁরা গ্রাহক নেতৃত্বের যুক্তি অস্বীকার করতে পারেননি৷ এই আন্দোলনের চাপে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের নতুন রেগুলেশনে লেট পেমেন্ট সারচার্জ ২৪ শতাংশের পরিবর্তে কমিয়ে কৃষিতে ১২ শতাংশ হারে এবং গৃহস্থ, বাণিজ্য, ক্ষুদ্রশিল্পে ১৫ শতাংশ হারে নেওয়ার কথা জানানো হলেও ব্যাঙ্ক রেট অনুযায়ী কমানো হয়নি৷ ব্যাপক গ্রাহক আন্দোলনের চাপে ২৩ মে রাতেই রাজ্যের সমস্ত বিদ্যুৎ অফিসে খবর যায় ডিসিআরসি চার্জ ১০০ টাকার বেশি নেওয়া হবে না৷
আন্দোলনের এই জয়ের জন্য গ্রাহকদের অভিনন্দন জানিয়ে অ্যাবেকার সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বিশ্বাস বলেন, যতক্ষণ ট্যারিফ অর্ডার পরিবর্তন করা না হচ্ছে এবং ফিক্সড চার্জ ও মিনিমাম চার্জ না কমানো হচ্ছে ততক্ষণ এই ট্যারিফ অর্ডারের বিরুদ্ধে সকল বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চলবে৷ তিনি বিজেপি সরকারের জনবিরোধী বিদ্যুৎ বিল ২০২১ বাতিলেরও দাবি জানান৷