স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অবশেষে স্বীকার করলেন, তাঁরা চাকরি দিতে পারবেন না। সে জন্য ক্ষমতায় এলে অলীক রোজগারের স্বপ্ন দেখালেন। আনন্দবাজারে (৩০ মার্চ, ‘২১) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
শাহরা বলছেন, তাঁরাই বাংলায় আসল পরিবর্তন আনবেন। সেই আসল পরিবর্তনের রূপটি কেমন, টুকরো কথায় তার কিছু ইঙ্গিতও দিয়েছেন সাক্ষাৎকারে।
সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারে চাকরির দিশা কোথায়? উত্তরে অমিত শাহ বলেছেন, ‘বাংলায় এক কোটি রোজগার’ হবে। রোজগার মানে কি চাকরি? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ‘রোজগার মানে চাকরি নয়’। তা হলে সেটা কী বস্তু? অমিত শাহ তা অবশ্য স্পষ্ট করে বলেননি।
তা হলে রোজগারটা কোন পথে আসবে? হতে পারে সরকার ছোটখাটো ব্যবসা করার জন্য কিছু ঋণ দিল, যাকে বলে স্ব-নিযুক্তি প্রকল্প। কিন্তু এই জাতীয় প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গে তো আছেই। সিপিএম আমলে এই স্বনিযুক্তি প্রকল্পে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কতজনকে সর্বস্বান্ত হয়ে পুলিশি জুলুমের শিকার হতে হয়েছে, তা ভুক্তভোগীরা জানেন। তৃণমূলের আমলেও ওই প্রকল্পগুলি চলছে। কিন্তু তার দ্বারা তো বেকার সমস্যার বিন্দুমাত্র সমাধান হয়নি! এই জাতীয় রোজগার প্রকল্প নাম পাল্টে আনা হলে সেটা কি আসল পরিবর্তনকে সূচিত করে?
আর কোন পথে রোজগার হতে পারে– কেন্দ্র থেকে সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে? আপনি ভাবতে পারেন, মন্দ কী! কিন্তু বাস্তব কী বলছে? তিন চার বছর আগেও গ্যাসে ভরতুকি মিলত দুশো-আড়াইশো টাকা করে। এখন তা কমতে কমতে ১৯ টাকায় ঠেকেছে। রেশনে বরাদ্দ কমছে, বাড়ছে দাম। জনকল্যাণমূলক খাতে ভরতুকি কমতে কমতে বন্ধের পথে। তা হলে রোজগার কোন পথে আসবে? রোজগার কিছুটা হতে পারে ১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্পে। সেটাও ধুঁকতে ধুঁকতে চালু আছে। ১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্প বাড়িয়ে ২০০ দিনের করা এবং তাতে বেতন বাড়ানোর দাবি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার অস্বীকার করে চলেছে। তা হলে এক কোটি রোজগারের প্রতিশ্রুতিও কি নোট বাতিলের সময় অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো নির্বাচনী জুমলা?
শাহ আরও বলেছেন, পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটাবেন। পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হলে পাটজাত পণ্যের বাজার তৈরি করতে হবে। কিন্তু এর সামনে প্রধান বাধা হল সিন্থেটিক লবি। শিল্পপতি আম্বানির রিলায়েন্স গোষ্ঠীর চাপে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন প্যাকেজিং-এর কাজে সিন্থেটিক বস্তার ব্যবহার বাড়িয়েই চলেছে। আগে চটের বস্তা ব্যবহারের যে বাধ্যবাধকতা ছিল সেটা কেন্দ্রীয় সরকার তুলে দিয়েছে। ফলে চটের বস্তার ব্যবহার ক্রমাগত কমছে। তা হলে পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটবে কী করে? পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটালে কৃষকরাও পাটের দাম পেত। জেসিআইকে কেন্দ্রীয় সরকার পাট কিনতে নামালে ফড়েদের খপ্পর থেকে চাষিরা কিছুটা বাঁচতে পারত, অভাবি বিক্রির হাত থেকে বাঁচত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পাট ব্যবসায়ীদের স্বার্থে জেসিআইকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। এই অবস্থায় পাটের বস্তার ব্যবহার আবশ্যিক করার আইন না আনলে এই প্রতিশ্রুতিও ভাঁওতা হতে বাধ্য।
শিল্পের প্রশ্নে কী বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? বলেছেন সাতটা শিল্প পার্ক হবে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি তো নতুন নয়। বিজেপি শাসিত নানা রাজ্যে এমন ‘পার্ক’ বানিয়েছেন অমিত শাহরা। পশ্চিমবঙ্গেও সিপিএম আমল থেকে তৃণমূল আমল– কত শিল্প পার্ক হয়েছে রাজ্যে! সেখানে গবাদি পশুরা ঘাস খায়। শিল্প কোথায়?
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, রাজ্যে বড়, ছোট, মাঝারি শিল্প করতে হবে। শিল্পের জন্য জল প্রয়োজন। বলেছেন গুজরাটে ১২০০ ফুট নিচে জল, আর বাংলায় ৬০ ফুট নিচে। প্রশ্ন হল, শিল্পের সামনে সঙ্কট কি জল? কেউ বলেনি সঙ্কট জলের। মূল সঙ্কট ক্রয়ক্ষমতার, যেটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখই করলেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটাও বললেন না, সিঙ্গুর থেকে গুজরাটের সানন্দে গিয়ে ন্যানো কারখানা বন্ধ হল কেন? দিল্লি-গুজরাত ডবল ইঞ্জিন সরকার হওয়া সত্ত্বেও একটা ন্যানো কারখানা বাঁচাতে পারল না কেন?
এরপর কী পড়ে থাকল? প্রধানমন্ত্রী কথিত পকোড়া এবং মুখ্যমন্ত্রী কথিত তেলেভাজা শিল্প, চপ শিল্প। বিজেপি কি এরই নতুন সংস্করণ বের করবে? তা হলে রোজগার কোন পথে? ভিক্ষাবৃত্তি, অভাবের তাড়নায় অভুক্ত সন্তানের মুখে ভাত তুলে দিতে অন্ধকারে জননীর রাস্তায় দাঁড়ানো? অমিত শাহদের সোনার রাজত্বে দেশে বেকারির হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। ফলে রোজগার নিয়ে আর কত ধানাই-পানাই করবেন মিথ্যা ভাষণের গুরুমশাই? চাকরির বদলে ‘রোজগার’ আসলে দুধের বদলে পিটুলি গোলা জল।