কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান মেয়াদ যখন শেষ হতে চলেছে, সাড়ে চার বছর কেটে গেছে, তখন বিজেপি নেতারা হঠাৎ উচ্চবর্ণের পিছিয়ে পড়া মানুষদের শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য একটি বিল শীত অধিবেশনের একেবারে শেষ অংশে তড়িঘড়ি নিয়ে এসে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাশ করিয়ে নিলেন৷
আইনটি আনতে কেন তাঁদের এত তড়িঘড়ি? এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একটি বিল অধিবেশনের একেবারে শেষ সময়ে এসে পেশ করলেন কেন? কেন এ নিয়ে সাংসদদের বিস্তৃত আলোচনা করতে দেওয়া হল না? যদি দেশের মানুষকে এটা বিশ্বাস করতে হয় যে, তাঁরা উচ্চবর্ণের পিছিয়ে পড়া মানুষদের দুরবস্থায় অতিমাত্রায় কাতর হয়ে পড়েছেন, তবে সরকারে এসেই এই আইন নিয়ে এলেন না কেন? এই কাতরতা সত্য হলে অন্তত কর্মসূচি হিসাবেও তো তাঁরা এটা ঘোষণা করতেন বাস্তবে বিজেপির রাজনীতিতে জনগণের জন্য কাতরতার কোনও জায়গা নেই৷ বুঝতে অসুবিধা হয় না, লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে আসার মরিয়া চেষ্টায় বিজেপি নেতারা আরও একবার সেই ধোঁকাবাজির রাস্তাই ধরলেন৷
এই সংরক্ষণের দ্বারা আদৌ কি কোনও সুবিধা হতে পারে উচ্চবর্ণের পিছিয়ে পড়া মানুষদের? এর দ্বারা চাকরি জুটবে তাঁদের? বাস্তবে দেশে চাকরি কোথায় যে দেবেন বিজেপি সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা আর যা নেই তার দশ শতাংশ কি একশো শতাংশ, তাতে কী যায় আসে? সংরক্ষণ করে দিলেই যদি চাকরি হত তবে গত সত্তর বছর ধরে যাঁরা সংরক্ষণের আওতায় রয়েছেন সমাজের সেই সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষেরা তো চাকরি পেতেন তাঁদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু জন ছাড়া অধিকাংশের কী কাজ জুটেছে? আজও তো তাঁরা নিচের তলাতেই পড়ে আছেন আজও তো তারা দলিত হিসাবেই থেকে গেছেন সামাজিক–অর্থনৈতিক বিষয়গুলি নিয়ে সর্বশেষ জনগণনায় দেখা যাচ্ছে, একজন সদস্য সরকারি চাকরি করে এমন এসসি–এসটি পরিবারের সংখ্যা দেশে মাত্র ৪ শতাংশ এবং এমন ওবিসি পরিবারের সংখ্যা মাত্র ১২ শতাংশ৷ এই উদাহরণই তো স্পষ্ট প্রমাণ করে দেয়– আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটিয়ে শুধুমাত্র সংরক্ষণের দ্বারা কোনও পিছিয়ে পড়া অংশেরই যথার্থ উন্নয়ন ঘটতে পারে না৷
বিজেপি সরকার উচ্চবর্ণের সংরক্ষণের আওতায় আসার সর্বোচ্চ আর্থিক সীমা ধরেছে ৮ লক্ষ টাকা বার্ষিক পারিবারিক আয়কে৷ কীসের ভিত্তিতে এই মাপকাঠি ধরলেন বিজেপি নেতারা? বছরে আড়াই লক্ষ টাকার বেশি রোজগার হলে এই সরকারই তো আয়কর ধার্য করে৷ অর্থাৎ তাদের আর দরিদ্র বলে ধরে না৷ তা হলে এখন বার্ষিক আট লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ের মানুষ, যাঁদের মাসিক আয় প্রায় ৬৬ হাজার টাকা পর্যন্ত, তারা সবাই পিছিয়ে পড়া তথা দরিদ্র হয়ে গেলেন কী করে? অর্থাৎ যাঁদের ৫–১০–১৫ হাজার টাকা আয় আর যাঁদের ৫০–৬০–৬৬ হাজার টাকা আয়, তাঁরা সকলেই একই সংরক্ষণের আওতায় এসে গেলেন৷ সেই তো পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষদের সুবিধাভোগী অংশের মানুষদের সাথেই প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে৷ তা হলে এই সংরক্ষণের দ্বারা সত্যিকারের পিছিয়ে পড়াদের নতুন কী সুবিধা হল?
আরও একটি প্রশ্ন৷ অতি সম্প্রতি দেশব্যাপী দু’দিনের যে সাধারণ ধর্মঘট হয়ে গেল তার দাবিগুলির অন্যতম ছিল শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন মাসে ১৮ হাজার টাকা করতে হবে৷ এটি শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি যা কোনও সরকারই মানেনি৷ অর্থাৎ সংরক্ষণের প্রশ্নে সরকার নিজেই যে দারিদ্রসীমা নির্ধারণ করে দিল সেই সীমার এক–তৃতীয়াংশ বেতনটুকুও কিন্তু সে দেশের শ্রমিকদের দিতে রাজি নয়৷ যে সরকার দরিদ্র শ্রমিকদের এটুকু দিতে রাজি নয়, সেই সরকারই তাদের সন্তানদের শিক্ষা এবং চাকরির জন্য খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছে, এ কথা ভাবার কোনও কারণ থাকতে পারে কি? এটা একটা ডাহা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়৷
ক’দিন আগেই পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপি গোহারা হেরেছে৷ তার মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যেই ছিল বিজেপি শাসন৷ এই ফল বিজেপি নেতাদের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বইয়ে দিয়েছে৷ গত সাড়ে চার বছরে বিজেপি সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ দেশের সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা বলে প্রমাণ হয়েছে৷ কালো টাকা উদ্ধার, মূল্যবৃদ্ধি রোধ, কর্মসংস্থান, সব কা বিকাশ, আচ্ছে দিন, মেক ইন ইন্ডিয়া, নোট বাতিল, জিএসটি– প্রত্যেকটি এর মধ্যে কালো টাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতিকে বিজেপি সভাপতি নিজেই জুমলা অর্থাৎ জনগণকে দেওয়া মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বলে স্বীকার করেছেন৷ অন্যগুলি বিজেপি নেতারা নিজেরা স্বীকার না করলেও দেশের মানুষের আজ আর বুঝতে অসুবিধা নেই যে সেগুলিও সবই এক একটি জুমলা, তাঁদের সাথে প্রতারণা৷ সদ্য হয়ে যাওয়া বিধানসভাগুলির নির্বাচনে বিজেপি নেতারা রামমন্দির নির্মাণের সাম্প্রদায়িক তাসটি খেলেছিলেন৷ কিন্তু জীবনের অজস্র সমস্যায় জর্জরিত সাধারণ মানুষ সেই ফাঁদে পা দেয়নি৷ বাস্তবে বিজেপি নেতাদের একের পর এক চালাকি আর প্রতারণার রাজনীতির কোনওটিই কাজে আসেনি৷ বিজেপি নেতারা বুঝেছেন, এগুলির দ্বারা দেশের মানুষকে ভোলানো যাচ্ছে না৷ অথচ সামনেই নির্বাচন৷ মানুষকে ভোলাতে নতুন একটা কিছু চাই৷ তাই মরিয়া হয়ে এবার উচ্চবর্ণের তাস খেলেছেন– যদি কাজ দেয়!
সত্যিই যদি পিছিয়ে পড়া মানুষদের শিক্ষা এবং কাজ দেওয়া বিজেপি সরকারের উদ্দেশ্য হত, তবে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসার আগে বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরি দেওযার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পালন করার চেষ্টা করত৷ বাস্তবে বছরে দু’লক্ষ চাকরিও সৃষ্টি করতে পারেনি৷ উপরন্তু রেল, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র সহ সরকারি সমস্ত ক্ষেত্রে নিয়োগ বন্ধ৷ লক্ষ লক্ষ সরকারি পদ খালি৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট শিক্ষক নেই, হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, কর্মী নেই৷ অফিসগুলিতে কর্মচারীর সংখ্যা কম৷ যতটুকু নিয়োগ হচ্ছে তার সবই ঠিকা প্রথায়, চুক্তির ভিত্তিতে৷ এর উপর বিজেপি সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে লক্ষ লক্ষ মানুষ, কাজ হারিয়েছেন, উদারিকরণ নীতির ফলে ক্রমাগত কর্মসংকোচন হয়ে চলেছে৷ এই অবস্থায় চাকরির জন্য নতুন করে সংরক্ষণ– বেকার সমস্যায় জর্জরিত যুবসমাজের সঙ্গে এক নির্মম রসিকতা ছাড়া আর কিছই নয়৷ যখন মণ্ডল কমিশনের মধ্য দিয়ে অন্য পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য সংরক্ষণ নিয়ে আসা হয়েছিল, সেদিনও আমরা বলেছিলাম, এর দ্বারা মানুষের আর্থিক দুরবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটবে না৷ এ শুধু ভোটের লক্ষ্যে মানুষকে প্রতারণা৷ জাতপাতের ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করে দেওয়া৷ ইতিমধ্যেই জাঠ, প্যাটেল, মারাঠা প্রভৃতি নেতারা তাঁদের গোষ্ঠীর জন্য আলাদা করে সংরক্ষণের দাবি তুলতে শুরু করেছেন৷ এ জিনিস যে ঘটবে, তা বিজেপি নেতা–মন্ত্রীদের অজানা নয়৷ বাস্তবে শোষিত–বঞ্চিত জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে তাদের দুরবস্থার জন্য পরস্পরকে দায়ী করে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত করিয়ে দেওয়া এবং তার থেকে নির্বাচনে ফয়দা তোলার লক্ষ্যেই নতুন সংরক্ষণের ধুয়া তুলছে বিজেপি৷
ক্ষমতায় ফেরার উদগ্র বাসনায় বিজেপি নেতারা সংবিধানকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে– সংরক্ষণ কোনও ভাবেই ৫০ শতাংশ ছাড়ানো যাবে না৷ এসসি, এসটি, ওবিসি সব মিলিয়ে তা এতদিন ছিল ৪৯.৫ শতাংশ৷ এবার ১০ শতাংশ বেড়ে তা হয়ে গেল ৫৯.৫ শতাংশ৷ ফলে শেষ পর্যন্ত সাংবিধানিক বিচারেও এই আইন দাঁড়াবে কি না, তা দেখার৷
এই আইনটিকে আনতে গিয়ে বিজেপি নেতারা সমস্ত সংসদীয় রীতিনীতিকেও দু’পায়ে মাড়িয়েছেন৷ যে কোনও আইন পাশ করানোর আগে তা নিয়ে যে দীর্ঘ আলাপ–আলোচনার দরকার হয়, পরিকল্পিত ভাবেই তা করতে দিলেন না বিজেপি নেতারা৷ বিলের কপিও সাংসদদের আগে থেকে দেওয়া হয়নি৷ এ নিয়ে দেশের মানুষের মতামতও নিলেন না তাঁরা৷ গণতন্ত্র সম্পর্কে বিজেপির সত্যিকারের মনোভাবটা কী তা এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট৷ প্রধানমন্ত্রীর প্রথম দিন সংসদে ঢোকার সময়ে সিঁড়িতে সাষ্টাঙ্গে প্রণামের দৃশ্য সবার মনে আছে৷ পার্লামেন্টকে সেদিন গণতন্ত্রের মন্দির বলেছিলেন তিনি৷ এই কি তার পরিচয় দেশের মানুষের সাথে প্রতারণার উদ্দেশ্যেই সেদিন এই নাটক করেছিলেন তিনি৷ বাস্তবে আজ দেশে দেশে সমস্ত পুঁজিবাদী দলগুলির চেহারাই এই৷ পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের খোলসটুকুই টিঁকে আছে মাত্র৷ ইরাকে সাদ্দাম হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন দোসর হিসাবে সেনা পাঠানোর জন্য পার্লামেন্টকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কীভাবে প্রতারিত করেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, তা আজ সবার জানা৷ সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার পার্লামেন্টের চরিত্রও ধারাবাহিকভাবে দেশের এবং সারা বিশ্বের জনগণের সাথে প্রতারণারই ইতিহাস৷ ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া সহ বিশ্বের বহু দেশই তার সাক্ষী৷
যে সরকারগুলি সংরক্ষণের টোপ ঝুলিয়ে নির্বাচনে মানুষের সমর্থন জোগাড়ে এত তৎপর, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তাদের কোনও তৎপরতা নেই৷ তা ছাড়া, তাঁরা এ প্রশ্নের উত্তর দেন না যে, দেশের খনিজ, বনজ, জলজ এত সম্পদ, এত উর্বর জমি, কর্মক্ষম এত মানুষ, মানুষের এত প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও কেন সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত উৎপাদন হয় না, কেন সেই উৎপাদনের জন্য অজস্র কলকারখানা স্থাপন করে বেকারদের কাজের ব্যবস্থা করা হয় না? শোষক এবং শোষিতে বিভক্ত এই সমাজে এই সব দলগুলিই যেহেতু পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে তাদের স্বার্থই রক্ষা করছে, তাই এই প্রশ্নের উত্তর এরা দেবে না৷ উত্তর দিলে এ সত্য উদঘাটিত হয়ে যাবে যে, শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য উৎপাদন হয় না, উৎপাদন হয় পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার দিকে লক্ষ রেখে৷ দেশের যুব সমাজ কাজ পেল কি না, সাধারণ মানুষ খেতে–পরতে পেল কি না, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না৷ বিজেপির আনা এই সংরক্ষণের উদ্দেশ্যও তাই৷ তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বেকার যুব সমাজের সামনে চাকরির এই টোপ ঝুলিয়ে নির্বাচনে তাদের সমর্থন আদায় করা৷ কিন্তু দেশের মানুষ আগের প্রতারণাগুলির মতো এই প্রতারণাও ঠিক ধরে ফেলবে৷ তারপর হয়ত আবার নতুন কোনও প্রতারণার ফাঁদ পাতবেন বিজেপি নেতারা!