ভারতের মহাকাশযান চাঁদে অবতরণ করায় আমরা আনন্দিত। এই কঠিন কাজটি সম্পন্ন করতে পারার জন্য সাধুবাদ অবশ্যই প্রাপ্য ইসরোর বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের। এইসব মহাকাশ-অভিযানের উদ্দেশ্য অবশ্যই চাঁদকে জানা, সৌরজগতের নানা গ্রহ-উপগ্রহ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করা।
কিন্তু প্রশ্নটা ওঠেই যে, বিশ্বের এতগুলি দেশ একসঙ্গে চাঁদে রকেট পাঠানোয় এত আগ্রহী হয়ে পড়ল কেন? শুধুই কি জ্ঞানার্জন তাদের লক্ষ্য? আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া, চিন আগেই চাঁদে ধীরগতি অবতরণ করতে পেরেছিল। জাপান, ইজরায়েল, আজকের পুঁজিবাদী রাশিয়া এরাও চেষ্টা করেছে। এখনও করছে। এমনকি আমেরিকার ধনকুবের পুঁজিপতি ইলন মাস্ক তাঁর কোম্পানির উদ্যোগেই একটি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা গড়ে তুলেছেন, মহাশূন্যে কয়েকটি রকেট উৎক্ষেপণও করেছেন। সাফল্য তেমন কিছু আসেনি। এরকম কঠিন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ব্যর্থতা আসেই। মহাকাশ-গবেষণায় সবচেয়ে যারা এগিয়ে আছে, সেই আমেরিকা ও পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়া, তাদের বেশিরভাগ মহাকাশযানই লক্ষ্যে পৌঁছতে বিফল হয়েছে। ২০০৩ সালে কলম্বিয়া মহাকাশযান দুর্ঘটনায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত নভোশ্চর কল্পনা চাওলার মৃত্যুর কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। তাই এখনও পর্যন্ত ইলন মাস্কের মহাকাশ-অভিযানে ব্যর্থতা থেকে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। ভবিষ্যতে সাফল্য আসতেই পারে। আর, তিনি ঘোষণা করেই রেখেছেন, তাঁর লক্ষ্য চাঁদ।
কিন্তু কেন? কারণ হল, চাঁদের প্রাকৃতিক সম্পদ। মনে হতে পারে, চাঁদ তো শুধু একটা রুক্ষ-শুষ্ক গোলক। জল-হাওয়া কিছুই নেই। সেখানে কী পাওয়া যেতে পারে?
পৃথিবীর নানা খনিজ সম্পদ অতিব্যবহারে নিঃশেষ হওয়ার পথে। এদিকে পুঁজিবাদ তার মুনাফার জন্য যেসব জিনিসের বাজার আছে তা উৎপাদন করবেই। তা করতে গিয়ে প্রকৃতির নানা সম্পদ যে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তা তার ধর্তব্যের মধ্যেই নেই। আর যখন তা হয়, তখন নতুন নতুন ক্ষেত্রের দিকে চোখ পড়ে তাদের। এভাবেই এখন চোখ পড়েছে কুমেরুর দিকে, সমুদ্রের তলদেশ থেকে খনিজ আহরণ করা যায় কি না সেই দিকে।
ধরা যাক অ্যান্টার্কটিকায় ভূবিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান চালালেন এবং মূল্যবান কিছু আকরিকের সন্ধান পেলেন। সেখানে খনি তৈরি বা খনিজ উত্তোলনের অধিকার কার থাকবে? সেরকমভাবে সমুদ্রের তলদেশে কোথাও যদি মূল্যবান আকরিক পাওয়া যায়, তা উত্তোলন করার অধিকারী কে হবে? সমুদ্রের তলার জমি কার সম্পত্তি? এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রাথমিক ভাবে সেখানে পদক্ষেপ যারা করেছে, তারাই সে অধিকার দাবি করে। তারপর একসময় দাবিদার দেশগুলি বসে বন্টন নিয়ে একটা চুক্তিতে আসে। এমনকি পরমাণু শক্তি নিয়ে যখন চুক্তি হয়, তখনও ব্যাপারটা এরকমই হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলি একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নেয় যে ১ জানুয়ারি ১৯৬৭-এর আগে যেসব দেশ পরমাণু শক্তিধর হয়েছে, তারাই শুধু পরমাণু শক্তিতে বলিয়ান থাকবে, অন্য কোনও দেশ তা হতে পারবে না।
কুমেরুর ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হয়েছিল। দেখা গেল, যে সাতটি দেশ প্রথম কুমেরু অঞ্চলে অভিযাত্রী দল পাঠিয়েছিল, সেই আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, চিলে, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, আর ব্রিটেন কুমেরু ভূভাগে তাদের অধিকার দাবি করে বসল। প্রাথমিক অভিযান চালানো দেশগুলির মধ্যে শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকা ছিল না। তাই তাদের উদ্যোগে ১৯৫৯ সালে কুমেরু চুক্তি হয়, যাতে কুমেরু কোনও দেশেরই সম্পত্তি নয় এটা স্বীকৃত হয়। সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি আমেরিকা যদি প্রাথমিক অভিযানকারী দেশগুলির মধ্যে থাকত তবে কুমেরুর ভবিষ্যৎ সম্ভবত অন্যরকম হত।
মোদ্দা কথা, এসব ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপের গুরুত্ব থাকে। আর তাই চাঁদে ধীরগতি অবতরণ, সেখান থেকে মাটি নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসা এসব ক্ষমতা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালী দেশগুলি জানে, একদিন চাঁদের অধিকার নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসতে হবেই। আর তখন অগ্রাধিকার পাবে সেসব দেশ, যারা এ কাজে আগে সাফল্য অর্জন করেছে।
কিন্তু, সত্যিই কি চাঁদ অথবা চাঁদের জমি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে? অথবা তা কি কোনও দেশের, অর্থাৎ সেই দেশের পুঁজিপতিশ্রেণির সম্পত্তি হতে পারে? না, পারে না। চাঁদে সমগ্র মানবজাতির অধিকার। চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছতে যে বিজ্ঞান, যে প্রযুক্তি প্রয়োজন হয়েছে, তা কোনও বিশেষ বিজ্ঞানী তৈরি করেননি। কোনও বিশেষ দেশের বিজ্ঞানীরাও তৈরি করেননি। নানা দেশের বিজ্ঞানী বহু প্রচেষ্টায় তিলে তিলে এই জ্ঞান সৃষ্টি করেছেন। তাই চাঁদের উপর অধিকার সমগ্র মানবজাতির।
কিন্তু পুঁজিবাদ থাকতে সে অধিকার স্বীকৃত নয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং তার দ্বারা সৃষ্ট যা কিছু, এক কথায় যাকে বলে উৎপাদিকা শক্তি সবই পুঁজির দখলে। তাই এমনকি চাঁদকেও তারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবেই দেখবে।
তাই যেসব আকরিক নানা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয়, সেগুলির উৎস নিশ্চিত করতে এখন থেকেই নানা দেশ ও ধনকুবেররা তৎপর। এ সবের মধ্যে আছে নানারকম মৌলপদার্থ, যাদের রেয়ার-আর্থ এলিমেন্ট বলা হয়। যখন থেকে জানা গেছে চাঁদে এইসব মৌলের ভালরকম অস্তিত্ব আছে, তখন থেকেই চাঁদের ব্যাপারে নতুন করে তৎপরতা শুরু হয়েছে। যদি একদিন সত্যি সত্যিই চাঁদ থেকে আকরিক আহরণ সম্ভব হয়, তার থেকে কিন্তু সমগ্র মানবজাতির কোনও উপকার হবে না। হবে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির।
তাই পুঁজিবাদী শোষণ, ব্যক্তিগত মুনাফার জাঁতাকল সরাতে না পারলে শুধু পৃথিবীই নয়, চাঁদও রক্ষা পাবে না।