চিকিৎসক হিসাবে রোগীদের উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করা, চিকিৎসার নামে কারও ক্ষতি না করা, মানুষকে সেবা দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকার যে শপথ চিকিৎসকদের নিতে হয় সেটি ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ নামে পরিচিত। এই শপথে পরিষ্কার বলা আছে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত, ধনী-গরিব, দেশি-বিদেশি ইত্যাদি বিভেদ করা চলবে না। বিশ্বের সর্বত্র চিকিৎসকরা এই শপথ নেন। সেটিকে মোদি সরকার পাল্টে দিতে চলেছে। ৭ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মেডিকেল পাঠক্রম থেকে হিপোক্রেটিক ওথ বাতিল করে তার পরিবর্তে চালু করা হবে মহর্ষি চরক শপথ।
প্রাচীন গ্রিসের প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক হিপোক্রেটিস চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক নামে পরিচিত। অন্য দিকে মহর্ষি চরক প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতির অন্যতম রূপকার। দীর্ঘদিন ধরে ডাক্তারি ছাত্ররা হিপোক্রেটিক ওথ পাঠ করে রোগীর কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার প্রতিজ্ঞা করছেন। হঠাৎ তা পরিবর্তনের কী প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল? সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের রাজ্য সম্পাদক ডাঃ সজল বিশ্বাস বলেন, এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের গভীর চক্রান্ত। এর মধ্য দিয়ে সরকার আসলে মেডিকেল শিক্ষার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করতে চাইছে। অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংস্কারগুলিকে বিজ্ঞানের নামে চালাতে চাইছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের যুক্তি কী? তাদের বক্তব্য, প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের গৌরবময় অতীত থাকা সত্তে্বও কেন আমরা গ্রিক চিকিৎসকের নামে শপথ নেব? সরকারের এ বক্তব্যও খুঁটিয়ে বিচার করে দেখতে হবে। এ কথা ঠিক, প্রাচীন ভারতে চিকিৎসার বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছিল। তবুও তা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিরিখে অনুন্নতই। আর দেশীয় গৌরবের প্রসঙ্গটি আবেগমুক্ত মন নিয়ে, যুক্তি দিয়ে বিচার করতে হবে। চিকিৎসক সংগঠন মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ডাঃ বিজ্ঞান বেরা বলেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনও দেশীয় সীমা নেই। এ বিষয়ে শরৎচন্দ্রের একটি চমৎকার বক্তব্য আছে, আইডিয়া পশ্চিমের কি উত্তরের সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা জাতির কল্যাণকর কি না। তা ছাড়া আর একটি বিষয় ভাবতে হবে। আজ যখন উন্নত আধুনিক চিকিৎসা এসে গেছে তখন কোনও দেশেই প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণের যৌক্তিকতা নেই। দেশীয় গৌরবের নামেও নয়। তাতে চিকিৎসাই মার খাবে।
এন এস সি-র সভায় ‘যোগা’-কে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, চিকিৎসকদের জন্য দশ দিনের যোগা ট্রেনিং-এর কথা বলা হয়েছে। এআইডিএসও-র মেডিকেল ইউনিটের আহ্বায়ক ডাঃ সামস মুসাফিরের বক্তব্য, আধুনিক চিকিৎসার সাথে প্রাচীন চিকিৎসার মিশ্রণ ঘটিয়ে যে ‘ক্রসপ্যাথি’ বা ‘মিক্সোপ্যাথি’ আনা হচ্ছে তার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ডাঃ সজল বিশ্বাসের সংযোজন, এর মধ্যে রয়েছে বৈজ্ঞানিক বিচার বিশ্লেষণের জায়গায় চিকিৎসা সংক্রান্ত বহু যুগ আগের প্রথাগত চিন্তা পদ্ধতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে চিকিৎসাকে মানুষের ভাগ্য-নির্ভর করে তোলার চেষ্টা। অর্থাৎ কপাল ভাল হলে রোগী বাঁচবে। চিকিৎসা বিজ্ঞান আজ যে জায়গায় পৌঁছেছে সেখানে আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ মানুষকে দিতে গেলে সরকারকেই তার দায়িত্ব নিতে হয়, তার জন্য উপযুক্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হয়। পরিকাঠামো তৈরি করতে হয়। যে দায়িত্ব পালন থেকে সরকার ক্রমাগত সরে যাচ্ছে। সরকার চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দিচ্ছে। আর সরকারি চিকিৎসা পদ্ধতিকে অবৈজ্ঞানিক প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে যুক্ত করে দিচ্ছে। বাঁচা-মরাকে মানুষের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই সরকারি হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি জ্যোতিষশাস্ত্র, তুকতাক ইত্যাদি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি চালু করে দিয়েছে। সেই পরিকল্পনাকে আরও বাড়াতে এবং বহুমুখী রূপ দিতেই সরকার মেডিকেল পাঠক্রমে মহর্ষি চরক শপথের অনুপ্রবেশ ঘটাতে চাইছে।
যাঁরা দেশীয় প্রাচীন চিকিৎসকের নামে শপথের কথা বলছেন, তাঁরাই চিকিৎসাকে মুনাফাবাজদের কব্জায় তুলে দিচ্ছেন। এর ফলে শপথটাই অর্থহীন হয়ে যাবে। চরকের সময় ভারতে পুঁজিবাদী অর্থনীতি কায়েম হয়নি। তখন চিকিৎসাকে মুনাফার পণ্য হিসাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হয়নি। সেবার মানসিকতা নিয়েই চিকিৎসকরা চিকিৎসা করেছেন। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও তার রক্ষক সরকারগুলি আজ শিক্ষা, চিকিৎসাকে পরিষেবা থেকে সরিয়ে মুনাফার পণ্যে পরিণত করেছে। আজ একজন চিকিৎসক তৈরি হতে ছাত্রছাত্রীকে কমবেশি দশ-বারো লাখ টাকা খরচ করতে হয়। স্বাভাবিকভাবে চিকিৎসক হওয়ার পর এই টাকা তাঁরা কী ভাবে কত দ্রুত তুলে আনবেন তা তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা হিসাবে দেখা দেয়। এর সঙ্গে মুনাফা ব্যবসায়ী বেসরকারি নার্সিং হোমগুলি অতি মুনাফা করার জন্য যে গলাকাটা বিল করে, বহু ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় খরচ করাতে বাধ্য করে, তাতে একটা বিরাট অংশের মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে যেতে বাধ্য হয়। এ সবই মেডিকেল এথিক্স বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের নৈতিকতার বিরোধী। শপথ কার নামে হবে, এই চিন্তায় যাঁরা এত উদ্বিগ্ন তাঁদের এ নিয়ে কোনও ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। শপথ যাঁর নামেই নেওয়া হোক চিকিৎসায় নৈতিকতা রক্ষা করতে হলে পুঁজিবাদী পরিচালনা থেকে চিকিৎসাকে মুক্ত করতে হবে। অবিলম্বে সরকার সেই ব্যবস্থা নিক।