বন্ধ চটকল খোলা, স্থায়ীকরণ, ন্যায্য মজুরির দাবিতে চটশিল্পে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক
চটশিল্পের সাথে যুক্ত ২১টি ইউনিয়ন আগামী ১ মার্চ থেকে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে৷ কেন এই ধর্মঘট? ২০১৫–র ত্রিপাক্ষিক চুক্তির তিন বছর মেয়াদ শেষ হবার পর ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ট্রেড ইউনিয়নগুলি যে ২২ দফা দাবিসনদ পেশ করেছিল, এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও সেই দাবিসনদের কোনও মীমাংসা হয়নি৷ কেন্দ্রের বিজেপি ও রাজ্যের তৃণমূল কোনও সরকারই দাবিসনদ মীমাংসার ক্ষেত্রে কোনও কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেনি৷ শ্রমিকদের স্বার্থের প্রতি সরকারের এই উদাসীনতা এবং নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে মুনাফালোভী চটকল মালিকরা শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত ও আইনসঙ্গত দাবিগুলি উপেক্ষা করে যাচ্ছে৷ সম্প্রতি রাজ্যের আটটি চটকলে ‘সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক’ জারি করে মিলগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ এই কারখানাগুলিতে প্রায় এক বছর যাবৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়ে আছে৷ পরিণতিতে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক পরিবার অর্ধাহার, অনাহারে সন্তান সন্ততিদের নিয়ে চরম দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে৷ চটকলগুলি খুলে উৎপাদন শুরু করার ব্যাপারে সরকার মালিকদের উপর কোনও চাপই দিচ্ছে না৷
বাস্তবে সরকার মালিকদের সেবাদাস হিসাবে কাজ করছে৷ মালিকদের খুশি করতে ২০০২ সালে সিপিএম সরকার কালাচুক্তি করে শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক ১৭২ টাকা থেকে কমিয়ে ১০০ টাকা করে দিয়েছিল৷ উৎপাদনভিত্তিক মজুরিনীতি চালু করে বাস্তবে বেতন কাটার ব্যবস্থা করেছিল যা শ্রমিক মহলে ‘কাটৌতি’ নামে পরিচিত৷ মালিকরা সে সময় শ্রমিকদের চার বছরের বর্ধিত মহার্ঘ ভাতার টাকা লুট করেছে৷ এ ছাড়া পিএফ, ইএসআই এবং গ্রাচুইটির প্রায় এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে৷ শ্রমিক ছাঁটাই এবং গেটবাহার চলেছে৷ বর্তমানে শ্রমিকদের পার্মানেন্ট না করে আজীবন বদলি এবং কন্ট্রাক্ট হিসাবে রেখে দিচ্ছে মালিকরা৷ বদলিতে ভর্তি হয়ে বদলি হিসাবেই অবসর নিচ্ছে– এর ফলে সামাজিক সুরক্ষা এবং বহু আইনি সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে৷ চটকলের শ্রমিকদের কোয়ার্টারগুলি কুখ্যাত কুলিলাইন হিসাবে৷ আলোবাতাসহীন এক চিলতে ঘর, না আছে উপযুক্ত নিকাশি ব্যবস্থা, না আছে পর্যাপ্ত শৌচাগার৷ শ্রমিকদের মনুষ্যেতর জীব হিসাবে গণ্য করে মালিকরা৷ এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি হল জীবনধারণ এবং বসবাসের উপযুক্ত কোয়ার্টার শ্রমিকদের থাকার জন্য দিতে হবে৷ এই অবস্থায় চটশিল্পের শ্রমিকরা বাধ্য হয়েছে ধর্মঘটের পথে যেতে৷ এবারের প্রস্তাবিত ধর্মঘটের মূল দাবিগুলি হল– আটটি বন্ধ চটকল খোলা, মাসিক নূ্যনতম মজুরি ১৮০০০ টাকা, পেনশন মাসে ৬০০০ টাকা করা, প্রতিটি কারখানায় ৯০ শতাংশ পার্মানেন্ট এবং ২০ শতাংশ স্পেশাল বদলি শ্রমিক রাখা ইত্যাদি৷
এই দাবিগুলি সম্পূর্ণরূপে গণতান্ত্রিক দাবি৷ অথচ এগুলি পূরণ করা নিয়ে সরকার ও মালিক পক্ষের দীর্ঘ টালবাহানা চলছে৷ এই অবস্থায় প্রয়োজন হল ঐক্যবদ্ধ, আপসহীন, দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম গড়ে তোলা৷ চটকল শ্রমিকদের লড়াই ও আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে৷ ঐক্যবদ্ধভাবে ৮৪ দিন পর্যন্ত একটানা ধর্মঘটের নজির সৃষ্টি করেছেন তাঁরা৷ ৮–৯ জানুয়ারিরর সারা ভারত ধর্মঘটেও চটশিল্পের শ্রমিকরা সর্বাত্মকভাবে অংশ নিয়েছেন৷ বর্তমান অবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি কারখানায় আন্দোলনের হাতিয়ার ‘শ্রমিক কমিটি’ বা ‘স্ট্রাইক কমিটি’ গড়ে তুলতে হবে৷ এই স্ট্রাইক কমিটিগুলির অনুমোদন ব্যতীত কোনও পরিস্থিতিতেই ধর্মঘট তুলে নেওয়া যাবে না৷ এ আই ইউ টি ইউ সি–র রাজ্য সম্পাদক কমরেড দিলীপ ভট্টাচার্য ধর্মঘট সফল করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, চটকল শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলি দীর্ঘদিন যাবৎবহেলিত হচ্ছে৷ ফলে প্রয়োজন হল ঐক্যবদ্ধ, আপসহীন, দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের৷ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই ধর্মঘট চালিয়ে যেতে হবে৷ এ আই ইউ টি ইউ সি অনুমোদিত বেঙ্গল জুট মিলস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন এই ধর্মঘট সফল করার জন্য চটকল শ্রমিকদের আহ্বান জানিয়েছে৷