শাসক বিজেপি ও সংঘ পরিবারের উদ্যোগে দেশ জুড়ে সংখ্যালঘু মানুষদের প্রতি যে ঘৃণা এবং অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরির ষড়যন্ত্র চলছে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর সাংবিধানিক কর্তব্য পালনের দাবি জানিয়ে সম্প্রতি দেশের ১০৮ জন অবসরপ্রাপ্ত আমলা (আইএএস, আইএফএস এবং আইআরএস) প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিতে দিল্লি, আসাম গুজরাট, হরিয়ানা, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডে সাম্প্রতিক অশান্তির প্রসঙ্গ তুলে তাঁরা লিখেছেন, যা ঘটছে তা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক নীতি এবং আইনের শাসনের পরিপন্থী। দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের আধিপত্যবাদ ক্রমশ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। উল্লেখ্য, এই প্রতিটি রাজ্যই বিজেপি শাসিত এবং দিল্লি রাজ্যের পুলিশ মোদি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে নিজেদের পোশাক, খাদ্যাভাস এবং সংস্কৃতি বজায় রাখতে পারেন, সে জন্য অবিলম্বে সরকারি পদেক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। নরেন্দ্র মোদির শাসনে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছাড়াও দলিত, দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেও যে ঘৃণার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে পরিকল্পিত ভাবে তাঁদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে চিঠিতে তার উল্লেখ করে এর প্রতিকারে সরকারকে দায়িত্ব পালনের দাবি জানিয়েছেন আমলারা।
তাঁরা বলেছেন, সর্বোচ্চ স্তরের রাজনৈতিক অনুমোদন ছাড়া এমনটা ঘটা সম্ভব নয়। জাহাঙ্গিরপুরীর সাম্প্রতিক ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ উপেক্ষা করে যে ভাবে কয়েক ঘণ্টা ধরে পে-লোডার দিয়ে বাড়ি-দোকান ভাঙা হয়েছে, তার পিছনে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিসন্ধি রয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ। শেষে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন, তাঁর পার্টির উদ্যোগে দেশ জুড়ে যে ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, তিনি যেন দলীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে তার অবসানে আন্তরিক ভাবে উদ্যোগী হন।
বিজেপি-আরএসএসের নেতৃত্বে পরিকল্পিত ভাবে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরবতা সচেতন প্রতিটি মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তাঁর নীরবতা যে অনুমোদনের নামান্তর তা বুঝতে হিন্দুত্ববাদের স্বঘোষিত রক্ষকদের অন্তত অসুবিধা হয়নি। তারই ফলে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ ক্রমাগত বেড়েছে এবং এক সময়ে এসে তা রাষ্ট্রীয় রূপ নিচ্ছে। মানুষের জীবনের মূল সমস্যাগুলি আগের থেকে অনেক তীব্র আকার নিলেও সেগুলিকে এর দ্বারা পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সমস্যাগুলির সমাধানে সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতাকে ঢেকে ফেলাও এই পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য।
বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, যেগুলিকে এতদিন ভারতের গর্ব হিসাবে তুলে ধরেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের বড় মানুষরা, সে-সবই আজ অতীতের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বের দরবারে ভারতের মর্যাদা ক্রমাগত ক্ষুন্ন হচ্ছে। বিজেপি-আরএসএসের দৌলতে আজ ভারতের এমন একটা পরিচয় বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, যেন বেশিরভাগ ভারতবাসীই গোঁড়া হিন্দু, প্রাচীনপন্থী এবং সংখ্যালঘুবিদ্বেষী। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিবাদহীনতা, সঙ্কীর্ণ ভোটসর্বস্ব রাজনীতির স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া প্রভৃতি কারণে এই ধারণাও ছড়াচ্ছে যেন দেশের সব মানুষ হিন্দুত্ববাদীদের এই ঔদ্ধত্যকে নীরবে মেনে নিচ্ছে। তাই কিছু যোগ্যতাহীন, বোধহীন বিরোধী নেতার হাতে এই সংগঠিত অনাচারের প্রতিরোধের ভার ছেড়ে দিয়ে দেশের নাগরিক সমাজ চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। তা হলে এই নীরবতাকে ধর্মীয় উগ্রবাহিনী তাদের সাফল্য হিসাবেই প্রচার করবে। এই অবস্থায় প্রাক্তন আমলারা যে ভাষায় তাঁদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন তা খুবই আশাব্যঞ্জক।
বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন সফল করার পথে দেশের এই শিক্ষিত নাগরিক সমাজ আজও এক গুরুতর বাধা। তাই বিজেপি-আরএসএস বাহিনীর আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য এই নাগরিক সমাজ। জনসমক্ষে তাঁদের দেশের শত্রু প্রতিপন্ন করার চেষ্টা নানা ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে তারা, তাদের সোসাল মিডিয়া টিম এবং অনুগামী টিভি চ্যানেলগুলি। এই অবস্থায় নাগরিক সমাজের অন্যান্য অংশকেও প্রতিবাদে এগিয়ে আসতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে, দেশ পরিচালনায় সরকারি অপদার্থতা, ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, আইনকে গায়ের জোরে অগ্রাহ্য করা, পরিকল্পিত ভাবে দাঙ্গা বাধানো, ধর্মের নামে ভণ্ডামি এ-সব কোনও কিছুকেই দেশের মানুষ নীরবে মেনে নিচ্ছে না। সোসাল মিডিয়ার মিথ্যাচার, টেলিভিশন মিডিয়ার অসত্য, বিকৃত ইতিহাস প্রচারের বিপরীতে সমস্ত ক্ষেত্রে সত্যকে তুলে ধরতে শিক্ষিত সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষিত নাগরিক সমাজ এগিয়ে এলে সাধারণ মানুষের বড় অংশটি, কোনও ধর্মের প্রতিই যাঁদের বিদ্বেষ নেই, বিজেপির ‘নতুন ভারত’কে যারা মেনে নিতে পারছেন না কিন্তু নানা কারণে চুপ করে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরাও সোচ্চার হবেন। তাই সবদিক থেকেই প্রাক্তন আমলাদের এই প্রতিবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।