কারা খুন করেছে গৌরী লঙ্কেশকে? পুলিশ যাদের ধরেছে শুধু তারাই এর পিছনে আছে? নাকি এর পিছনে আছে এক গভীর ষড়যন্ত্র? কর্ণাটক পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) তদন্তে যা উঠে আসছে তাতে ক্রমাগত পরিষ্কার হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ড এক গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশ৷
২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর গুলি করে খুন করা হয়েছিল কর্ণাটকের প্রখ্যাত সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে৷ কর্ণাটক পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) যাদের গ্রেপ্তার করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম কে টি নবীন কুমার পুলিশকে জানিয়েছে, হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে হত্যার প্রেরণা সে পেয়েছিল ‘হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি’ (এইচ জে এস) নেতা মোহন গৌড়ার কাছ থেকে৷ গোয়ায় ‘সনাতন সংস্থা’র সম্মেলনে তাকে নিয়ে গিয়েছিল এইচ জে এস নেতারাই৷ যেখানে আলোচনা থেকে সে বুঝেছিল, হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করতে হলে অস্ত্র ধরতে হবে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২৷০৬৷১৮)৷ গ্রেপ্তার হওয়া আর এক অভিযুক্ত পরশুরাম ওয়াগমোরের সাথে নিবিড় যোগাযোগ ‘শ্রীরাম সেনা’ প্রধান প্রমোদ মুথালিকের (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১৪৷০৬৷১৮)৷ ‘রাম সেনা’ সংগঠনের বিজয়পুরা জেলার সভাপতি রাকেশ মথ ফেসবুকে পরশুরাম ওয়াগমোরকে গান্ধীজির হত্যাকারী নাথুরাম গডসের মতোই ‘মহান’ বলে অভিহিত করে তার সাহায্যার্থে অর্থদানের আবেদন জানিয়ে চলেছেন৷ সাংবাদিকরা এ নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলে তাঁর নির্বিকার উত্তর, ‘নিজের ধর্মকে রক্ষা করতে ওয়াগমোর সঠিক কাজই করেছে’৷ এখন জানা যাচ্ছে গৌরী লঙ্কেশকে হত্যার আগে এই সংগঠনগুলির তত্ত্বাবধানে কয়েক মাস ধরে মহারাষ্ট্র এবং কর্ণাটকের সীমান্ত এলাকায় একদল যুবককে বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে৷ তদন্তকারীরা বলছেন, গৌরী লঙ্কেশের হত্যার পরিকল্পনা রচিত হয়েছিল এক বছর আগেই৷ সিটের তদন্তকারীরা জেনেছেন রাম সেনা এবং এইচ জে এস কর্তারা গৌরী লঙ্কেশকে হত্যার জন্য ওয়াগমোরকে পিস্তলটি দিয়েছিল ঘটনার সামান্য কিছুক্ষণ আগে৷ খুনের ১৫ মিনিটের মধ্যে তারা তা ফেরত নিয়ে নেয়৷ ব্যালিস্টিক বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত যে, এর আগে ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট পুনেতে যুক্তিবাদী লেখক নরেন্দ্র দাভোলকর, ২০১৫–র ১৬ ফেব্রুয়ারি মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে ৮১ বছরের বর্ষীয়ান যুক্তিবাদী নেতা গোবিন্দ পানসারে, একই বছরের ৩০ আগস্ট কর্ণাটকের ধারওয়াড়ে ৭৭ বছরের প্রবীণ শিক্ষাবিদ এম এম কালবুর্গির হত্যার কাজে ওই একই পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছিল (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৭৷০৯৷১৭)৷ অর্থাৎ, এই হত্যাগুলি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডেরই অংশ৷ গুলি নিশ্চয়ই এক বা একাধিক ব্যক্তি ছুঁড়েছে, কিন্তু ধর্মান্ধতার নেশায় এভাবে মাতাল করে তুলে নিরপরাধ যুবকদের নরহত্যাকারীতে পরিণত করল যারা তাদের শাস্তির কী হবে?
কারা তারা? কর্ণাটকের চিকমাগালুর থেকে নির্বাচিত বিজেপি বিধায়ক জীবরাজ গৌরী লঙ্কেশের হত্যার পর বলেছিলেন, বিজেপি–আরএসএসের বিরুদ্ধে না লিখলে হয়ত গৌরী বেঁচে যেতে পারতেন (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮৷০৯৷১৭)৷ কী আশ্চর্য মিল কাশ্মীরের প্রখ্যাত সাংবাদিক সুজাত বুখারির নৃশংস হত্যার পর বিজেপি নেতাদের প্রতিক্রিয়ার সাথে বুখারির খুনের পর জম্মু–কাশ্মীরে বিজেপির সদ্য প্রাক্তন মন্ত্রী চৌধুরি লাল সিং বলেছিলেন, সাংবাদিকদের জন্যই বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষের মনে ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে, ফলে সাংবাদিকরা লক্ষ্মণরেখা ঠিক করে নিন কী করবেন? সুস্থভাবে বাঁচবেন, না সুজাত বুখারির মতো মরবেন? যে কেউ আরএসএস–বিজেপির বিরোধিতা করবে এই হল তাদের প্রতি বিজেপির বার্তা!
প্রধানমন্ত্রীর ভক্ত ‘রাম সেনা’ প্রধান প্রমোদ মুথালিক সম্প্রতি গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকে ‘একটা কুকুরের মৃত্যু’–র সাথে তুলনা করে বলেছেন, এই নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কেন বিচলিত হবেন? অবশ্যই তিনি শিখেছেন বিজেপির গর্ব নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে৷ যিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০২ সালের সংখ্যালঘু নিধন যজ্ঞে নিহতদের তাঁর ‘গাড়ির তলায় পড়ে যাওয়া কুকুরছানা’ বলতে পেরেছিলেন, কারণ এটাই হল আরএসএস–বিজেপির সংস্কতি৷
ঠিক এই সংস্কৃতি এবং মানসিকতাই ছড়াতে চায় আরএসএস–বিজেপি৷ তাদের ছাঁচে ঢালা চিন্তা করতে না চাইলেই দেশদ্রোহী তকমা জুটবে তাদের সংখ্যালঘু বিরোধী জিগিরে সামিল হতে না চাইলে, জাতীয়তাবাদের নামে প্রাচীন ভারত নিয়ে মিথ্যা গাল–গল্প প্রচারের বিরোধিতা করলে, যুক্তিবাদের চর্চা করতে চাইলে, পাকিস্তানের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ বা শিল্পী–সাহিত্যিক–গুণী প্রতি কেউ শ্রদ্ধা–সম্ভ্রম দেখালে, তাকে হেনস্থা করার ‘দেশপ্রেমিক’ কর্তব্যে সাড়া না দিলেই বিজেপি–আরএসএস–এর হুমকি জুটছে৷ বোঝা যায় জবরদস্তি মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার তালিবানি কায়দাটি তারা ভালই রপ্ত করেছে৷ বিজেপির আইনজীবী সেলের নেতা প্রশান্ত প্যাটেল উমরাও তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে ৪৯ জন সাংবাদিক, চিত্র পরিচালক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছেন এঁরা দেশদ্রোহী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তাঁদের উপর নজর রাখছে৷ এই দেশদ্রোহীদের তালিকায় অরুন্ধতী রায় থেকে অপর্ণা সেন এমন বহুজনের ঠাঁই হয়েছে৷
আরএসএসের চিন্তাবিদ গুরু গোলওয়ালকর চেয়েছিলেন, ভারতে বাস করতে হলে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে মাথা নিচু করে হিন্দুত্ববাদীদের পায়ের তলায় পড়ে থাকতে হবে৷ সেই পরিকল্পনারই কি রূপায়ণ হচ্ছে? হিটলার মুসোলিনির মতো ফ্যাসিস্ট মানবতা হত্যাকারীদের ভজনা করতেন আরএসএস নেতা হেডগেওয়ার, মুঞ্জে, গোলওয়ালকররা৷ যে ফ্যাসিস্ট একনায়ক দানবদের নীতি–নৈতিকতার কোনও বালাই ছিল না৷ সামান্যতম বিরোধিতাকেও সমূলে উৎখাত করতে আতঙ্কের পরিবেশ কায়েম করাটাই ছিল তাদের শাসন পদ্ধতি৷ সারা বিশ্বেই যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক মনন, মানবতার চর্চাকে পিষে মারতে চায় ফ্যাসিস্ট মতবাদ৷ এরা গণতন্ত্রের বিরোধী, উদারতার শত্রু৷ দেশপ্রেমের মিথ্যা গরিমার মোড়কে সাজানো অন্ধতা–উন্মত্ততা তাদের অন্যতম হাতিয়ার৷ ধর্মান্ধতা ও জাতিগত বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে ফ্যাসিস্টরা হাজার হাজার যুবককে নরদেহধারী অমানুষ এবং খুনে বাহিনীতে পরিণত করেছিল৷ যা দেখে রম্যাঁ রলাঁ, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্রের মতো মহান মানুষরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন৷ আজ ভারতে বিজেপি–আরএসএস সেই ফ্যাসিস্ট মানসিকতা বিস্তারের পথেই হাঁটছে৷ গৌরী লঙ্কেশ, সুজাত বুখারি, গোবিন্দ পানসারে, কালবুর্গি, নরেন্দ্র দাভোলকর সহ যুক্তিবাদীদের হত্যা এই পরিকল্পনার অংশ বলেই প্রধানমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে শুধু প্রতিবাদ করেনি তাই নয়, বরং হত্যাকারীদের প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে৷
ধর্মান্ধতা–জাতিবিদ্বেষের মাদক এই কাজে নিরীহ যুবকদের সহজ শিকারে পরিণত করে৷ এই মাদক গেলাতে পারলে একজন মানুষ সমস্ত মানবতা–যুক্তিবোধ বিসর্জন দিয়ে নরঘাতকে পর্যন্ত পরিণত হতে পারে৷ তাই সারা বিশ্বেই আজ ধর্মান্ধতা ও জাতিগত বিদ্বেষ নানা কায়েমী স্বার্থবাদীদের হাতে মানুষকে অমানুষে পরিণত করার কাজে হাতিয়ার৷ সম্প্রতি বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জে মুক্তমনা লেখক ও প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চুকে গুলি করে হত্যা করেছে এমনই উগ্র ধর্মধ্বজীরা৷ এর আগেও বাংলাদেশে একের পর এক লেখক, শিল্পী, ব্লগারদের হত্যা করা হয়েছে ধর্মরক্ষার নামেই৷ মধ্য প্রাচ্যের আইসিস, আফগানিস্তানের তালিবানরাও একই পথের পথিক৷ পার্থক্য শুধু সেখানে তারা ইসলাম ধর্মকে বাঁচানোর নামে এসব করছে৷ আর ভারতে হত্যা চলছে হিন্দুধর্ম রক্ষার অজুহাতে৷ কিন্তু তার দ্বারা কোনও ধর্মই বাঁচছে না, সবচেয়ে বড় কথা, মরছে মানুষ৷
ভারতে এই ধরনের দুষ্ট শক্তির সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি বিজেপি–আরএসএস হলেও কংগ্রেসও ভোটের স্বার্থে সুক্ষ্মভাবে ধর্মীয় অন্ধতাকে বাড়াতে সাহায্য করে চলেছে বহু দিন ধরেই৷ তাই এই সমস্ত খুনিদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে কিছু বিষোদগার করলেও কংগ্রেস এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করতে ভয় পায়, পাছে তাদের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক নষ্ট হয় যদিও ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষে মানুষে বিদ্বেষের পরিবেশ তৈরি করে একদিকে ভোটব্যাঙ্ক গোছানো অন্যদিকে জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যা থেকে মানুষের চোখ ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজে সব বুর্জোয়া দলের মধ্যে বিজেপিই চ্যাম্পিয়ান৷ তাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে যত মানুষের ক্ষোভ ফেটে পড়তে চাইছে ততই পুঁজিপতি শ্রেণি ও তাদের বিশ্বস্ত সেবক দলগুলি ধর্মীয় অন্ধতার উন্মত্ততায় মানুষকে মাতিয়ে দিতে চাইছে৷ যাতে পুঁজিপতিদের লাগামহীন মুনাফার স্বার্থে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র মানুষের উপর সীমাহীন অত্যাচার চালালেও প্রতিবাদ করার মতো মানুষই দেশে আর না থাকে৷ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই আজ মানুষের মতো কাজ৷ এই পথেই গৌরী লঙ্কেশ কিংবা সুজাত বুখারিদের খুনিদের শাস্তি দিতে সরকারকে বাধ্য করা যায়৷
(৭০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা ২৯ জুন, ২০১৮)