স্কুলে, কলেজে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘর ভর্তি গরুতে হাসির বিষয় নয়, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকারের গো–রক্ষার জুলুমের সামনে মরিয়া হয়ে চাষিরা তাদের ফসল বাঁচাতে কয়েক হাজার গরু–বাছুরকে এমনভাবেই ঢুকিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন সরকারি অফিসে, স্কুলে৷
বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের রাজত্বে সাধারণ মানুষ তো কোন ছার, গো–রক্ষকরা পুলিশ অফিসারকে পিটিয়ে মারলেও সরকার নড়ে বসে না৷ মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত অক্লেশে বলে দেন, ইনস্পেক্টর সুবোধ সিংহের হত্যা একটা সামান্য দুর্ঘটনা৷ সরকার গো–রক্ষা নিয়ে বেশি চিন্তিত৷ এর আগে রাজস্থান, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডে বিজেপি–আরএসএসের মদতপুষ্ট গো–রক্ষা বাহিনীর তাণ্ডবে প্রাণ গেছে বেশ কয়েকজন দুধ ব্যবসায়ী ও সাধারণ চাষির৷ ঘরে গরুর মাংস রাখার গুজব ছড়িয়ে দিল্লির উপকণ্ঠেপরিকল্পিত গণপিটুনিতে প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়েছে মহম্মদ আখলাকের৷ কিছুদিন আগে রাজস্থানে গো–সন্তানদের গণপিটুনিতে দুধ ব্যবসায়ী আকবর খানের মৃত্যুর পর সামনে এসেছিল এক সাংঘাতিক সত্য৷
রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র কিংবা গুজরাটের মতো রাজ্যগুলিতে আরএসএস–বিজেপি–বিশ্বহিন্দু পরিষদ–বজরঙ্গ দলের মতো হিন্দুত্বের স্বঘোষিত অভিভাবক দলের নেতারা ‘গো–রক্ষা’র নামে লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়েছেন ক্ষমতায় থাকার সময়৷ শুধু রাজস্থানের আলোয়ারেই এদের পরিচালনায় বেশ কয়েকটি ‘গোশালা’ চালু হয়েছে৷ হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে যে কেউ রাজস্থানের হাট থেকে গরু, ছাগল, ভেড়া, উট যে কোনও পশুই কিনুক না কেন এই বাহিনীকে তোলা না দিয়ে তাদের উপায় নেই৷ টাকা আদায়ের জন্য এরা চালু করেছে ‘চেকপোস্ট’ যেখানে স্থানীয় থানার পুলিশও গো–রক্ষক বাহিনীর সাথে বখরার ভিত্তিতে পাহারা দেয়৷ পশু কিনে কেউ রাস্তা দিয়ে হেঁটে বা গাড়িতে গেলেই এরা ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ টাকা না পেলে কেড়ে নেয় গরু ভেড়া যা পায়৷ এমনকী গো–রক্ষার ধুয়ো তুলে নানা গ্রামে হানা দিয়ে গোরু কেড়ে আনে ওরা৷ টাকা দিয়ে ছাড়াতে পারে না যারা, তাদের পশুগুলিকে আবার বিক্রি করে দেয় এই ‘গো–রক্ষকরা’৷ এদের হাতে পশুপালক উপজাতিদেরও ছাড় নেই৷ ধর্মে হিন্দু ‘রাবারি’ উপজাতির মানুষরা গুজরাট থেকে হাঁটাপথে রাজস্থান এসে পশু কিনে আবার গুজরাটে ফিরে যান৷ বহুকাল ধরে তাঁদের এই জীবিকা চলছে৷ কিন্তু কয়েকবছর ধরে আলোয়ার পার হওয়ার সময় ‘গো–রক্ষা চেকপোস্টে’ তোলা না দিলে জোটে মারধোর৷ জোর করে টাকা কেড়ে নেওয়াটা গো–রক্ষকদের কাছে তো জলভাত৷ আকবর খানের মৃত্যুর পর রাবারি উপজাতির এক মোড়ল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাঁচতে গেলে ওদের টাকা না দিয়ে উপায় নেই (দ্য টেলিগ্রাফ ২৪ জুলাই, ২০১৮)৷
উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকার সমস্ত আইনি–বেআইনি কসাইখানা বন্ধ করে দেওয়ায় এবং কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার গবাদি পশুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের আইন আনার পর থেকে উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা এক মারাত্মক সংকটে পড়েছেন৷ বর্তমানে মেশিন–ট্রাক্টরের প্রচলন এতটাই বেড়েছে যে, চাষের কাজে গরু মোষের ব্যবহার প্রায় নেই৷ দুধ উৎপাদনের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পর কৃষকরা তাঁদের উদ্বৃত্ত গোরু–মোষ এতদিন বিক্রি করে দিতে পারতেন৷ কিন্তু সরকারি আইন এবং বিজেপি মদতপুষ্ট গো–রক্ষকদের মারের ভয়ে তাঁরা গরু মোষ নিয়ে কোথাও যেতে ভয় পাচ্ছেন৷ এদিকে ঘরে বসিয়ে গরু–মোষকে খাওয়ানোর সামর্থ্য তাঁদের নেই এবং সেটা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নেহাত অলাভজনক৷ স্বাভাবিক ভাবেই তারা গরু ছেড়ে দিচ্ছেন৷ ফলে বেওয়ারিশ গবাদি পশুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে৷ তারা রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে, চাষিদের ফসল খেয়ে নষ্ট করছে৷ চাষিরা অসহায়, কারণ কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে গরু আটকাতে গেলে সেই বেড়ায় যদি কোনও গরুর আঘাত লাগে তাতে গো–রক্ষকদের হাতে চাষি পরিবারের হেনস্থা এমনকী খুন হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা আছে৷ এদিকে ছেড়ে দেওয়া বেওয়ারিশ গরু ফসল নষ্ট করায় দুই কৃষক পরিবারে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে৷ আলিগড়, আগ্রায় মরিয়া চাষিরা বেওয়ারিশ গবাদি পশুর পাল ঠেকাতে অ্যাসিড ছুঁড়েছেন এমন ঘটনাও ঘটছে৷ বিপন্ন কৃষকরা গরুর পাল তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি স্কুলে ঢুকিয়ে গরুর পালকে বন্দি করে রাখছেন৷ উত্তরপ্রদেশের মথুরায় একটি স্কুলে ৮০০ গরুকে বন্দি করে তাঁরা পুলিশ ডেকেছেন৷ এমন ঘটনা বহু স্থানে ঘটছে৷ ক্ষতি হচ্ছে ছাত্রদেরও৷ বিপদে পড়েছেন ডেয়ারি চাষিরাও৷ আগে রাজস্থান–হরিয়ানায় নিয়মিত দুধেল গাইয়ের মেলা হত৷ তাঁরা সেখান থেকে প্রয়োজন মতো গরু কিনতে পারতেন৷ এখন গো–রক্ষকদের ভয়ে গরু নিয়ে কেউ রাস্তায় বার হতে পারে না৷ ফলে মেলাও বন্ধ৷
উত্তরপ্রদেশ সরকার গোশালা করার নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করছে৷ গো–রাজনীতির জোয়ারের টানেই বিজেপি ২০১৯–এর ভোট বৈতরণী পার হওয়ার পরিকল্পনা করছে৷ তাদের গো–রক্ষার ভণ্ডামিতে শুধু চাষিরা মরছেন তাই নয়, গবাদি পশুগুলিও চূড়ান্ত কষ্টে পড়ছে৷ রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানায় সম্প্রতি গোশালার অব্যবস্থায়, খাদ্য–জলের অভাবে প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার গবাদি পশু৷ তাতে বিজেপির কিছু আসে যায় না৷ তারা হিসাব করছে মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ভোটব্যাঙ্কের পকেটে পুরতে৷
ভোটব্যাঙ্ক হারানোর আশঙ্কায় কংগ্রেস এই গো–রাজনীতির বিরুদ্ধে কোনও কথা বলা দূরে থাক, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পালেই হাওয়া লাগাচ্ছে৷ কংগ্রেস সভাপতি মন্দিরে মন্দিরে পৈতে দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ বিজেপি–কংগ্রেস উভয়েরই নীতিহীন ভ্রষ্ট রাজনীতির শিকার হচ্ছেন ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ কৃষক– যাঁরা গবাদি পশুকে নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম দিন কাটিয়েছেন, তাদের ব্যবহার করেছেন, যত্ন করেছেন, আবার প্রয়োজনে বিক্রি করে দিয়েছেন৷ তাতে গরুর সংখ্যা কমেনি শুধু নয়, নিজের প্রয়োজনেই মানুষ গবাদি পশুর উন্নতিতে মন দিয়েছে৷ সাম্প্রদায়িক ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করায় কৃষকের স্বাভাবিক জীবনযাপনেই সংকট নেমে এসেছে৷ সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ির সস্তা রাজনীতির চমক যে সমাজের কী মারাত্মক ক্ষতি করে, এ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷