প্রতিদিন একটার পর একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে৷ ধারাবাহিক মানব হত্যার নৃশংসতায় আঁতকে উঠছে ভারতবাসী৷ আর এই নৃশংস বর্বরতা ঘটে চলেছে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে৷ সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলার আনজার, গ্রামে সঙ্গে গোমাংস রয়েছে এই সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয় রিয়াজ খান নামে এক যুবককে৷ ঠিক পরের দিনই গুজরাটের রাজকোট জেলার শাপর শহরে জঞ্জাল কুড়োতে আসা এক দলিত যুবককে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়৷ উত্তরপ্রদেশের দাদরির মহম্মদ আখলাক থেকে শুরু করে নিত্যদিন কত যে ঘটনা ঘটে চলেছে তার ইয়ত্তা নেই৷
উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা হত্যালীলা চালিয়েই যাচ্ছে, কোনও ঘটনাতেই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেনি কেন্দ্র তথা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিজেপি সরকার৷ বরং কোথাও কোথাও হত্যাকারীদের আড়াল করা এমনকী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থনই প্রকাশ পাচ্ছে সরকারগুলির ভূমিকায়৷ হত্যাকারীদের দু’এক ক্ষেত্রে লোকদেখানো গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু তাদের শাস্তির খবর শোনা যায়নি৷ বিপরীত দিকে গোহত্যার বিরুদ্ধে আইন কঠোর করা হচ্ছে৷ মধ্যপ্রদেশে ২০১২ সালে আইন সংশোধন করে গোহত্যার শাস্তি তিন বছর থেকে বাড়িয়ে সাত বছরের কারাদণ্ড করা হয়েছে৷ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেত্রী সাধ্বী সরস্বতী বলেছেন, গোহত্যা রুখতে কেন্দ্রের বিশেষ আইন আনা উচিত যাতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যায়৷ যে দেশে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে গোরক্ষার নামে– সে কেমন দেশ, সে কেমন ভারতবর্ষ!
অনেক ঘটা করে, ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন দলিত সম্প্রদায়ের একজন৷ দেশের তাবড় তাবড় নেতা–মন্ত্রীরা দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরে ঘরে পাত পেড়ে খাওয়া–দাওয়া করলেন৷ সংবাদপত্রে, টিভির পর্দায় প্রচারের ঘনঘটায় মনে হতে লাগল, দলিতদের দুঃখ–যন্ত্রণার অবসান হয়ে গেল, দলিত–জনের দরিদ্র কুটিরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সুখ–পাখি কড়া নাড়ছে৷ কিন্তু এ নিছকই মরীচিকা নেতা–মন্ত্রীদের মিথ্যাচার, লোক ঠকানো৷ তাই চোর সন্দেহে দলিত সম্প্রদায়ের যুবককে পিটিয়ে মারলেও ‘দলিত’ রাষ্ট্রপতি কথা বলেন না৷ শুধুমাত্র চোর সন্দেহে স্বাধীন দেশের মানুষ খুন হয়ে যায়, কিন্তু এ দেশে নীরব মোদি, বিজয় মাল্যদের মতো যারা সন্দেহাতীতভাবে চুরি করে, আর যারা সেই চোরেদের দোসর তাদের শাস্তি হয় না৷
এ সমাজব্যবস্থায় এমনটাই স্বাভাবিক৷ তাই এ দেশে প্রকৃত চোরেরা শাস্তি পায় না, গরিবের হত্যাকারীরা শাস্তি পায় না৷ মাঝে মাঝে গেরুয়াবাহিনীর তাণ্ডব মাত্রাছাড়া হয়ে গেলে নেতা–মন্ত্রীরা ফাঁকা বুলির কিছু মলম মাখিয়ে ক্ষত চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু তাতে অবস্থার কোনও হেরফের হয় না৷ এই পরিকল্পিত হত্যা এবং আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টাকে যদি বন্ধ করতে হয়, তা হলে জাত–পাত ভিত্তিক কোনও সংগঠন তা পারবে না, ধর্ম–বর্ণ–জাতির ঊর্ধ্বে উঠে দরিদ্র–অত্যাচারিত মানুষের সম্মিলিত গণআন্দোলনই ধর্মব্যবসায়ীদের এই তাণ্ডব বন্ধ করতে পারে৷
(৭০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৭জুন, ২০১৮)