২০১৪ সালে বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দলের নেতারা ও তাদের মেন্টর আর এস এস হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা রূপায়ণের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে৷ এ জন্য, তারা ইতিহাস বিকৃত করছে, স্কুলের সিলেবাসে নানা অবৈজ্ঞানিক ও অনৈতিহাসিক তথ্য অন্তর্ভুক্ত করছে, ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানকে অপবিজ্ঞান প্রচারের কাজে লাগাচ্ছে৷ ভোপাল কেন্দ্রের বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে দাবি করেছিলেন, গোমূত্র ও পঞ্চগব্য খেয়ে তাঁর ক্যান্সার সেরে গেছে৷ কিন্তু তাঁর ক্যান্সার সারার কারণ অস্ত্রোপচার করে দু’টি স্তন কেটে বাদ দেওয়া, সে–কথা তিনি সচেতনভাবে গোপন করে গেছেন যাতে গোমূত্রের উপকারিতা প্রচার করা যায়৷ লখনউয়ের রামমনোহর লোহিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সের ডাঃ এস এস রাজপুত বলেছেন, ‘আমি তিনবার তাঁর স্তনে অস্ত্রোপচার করে ক্যান্সার আক্রান্ত স্থান কেটে ফেলে দিই৷’ প্রথম অস্ত্রোপচার করা হয় মুম্বইয়ের জে জে হাসপাতালে যখন তাঁর ডান স্তনে একটি টিউমার হয়৷ ২০১২ সালে আবার টিউমার হওয়ায় ভোপালের একটি বেসরকারি হাসপাতালে দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচার করে টিউমার আক্রান্ত তাঁর ডান স্তনের এক–তৃতীয়াংশ বাদ দেওয়া হয়৷ ২০১৭ সালে লখনউয়ে তাঁর হাসপাতালে তৃতীয়বার অস্ত্রোপচার করে ঠাকুরের (প্রজ্ঞা সিং) দু’টি স্তনই কেটে বাদ দেওয়া হয়৷ ফলে, তাঁর ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই৷ ডাঃ রাজপুতের কথা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ঠাকুরের দাবির সত্যতা নেই, হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডার প্রচারই ওই মিথ্যাচারের উদ্দেশ্য৷
দেশের প্রতিষ্ঠিত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, ক্যান্সারের চিকিৎসায় গোমূত্রের কোনও উপযোগিতা নেই৷ যেমন, অন্যতম প্রবীণ অঙ্কোসার্জন টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারের ডিরেক্টর ডাঃ রাজেন্দ্র বাদোয়ে বলেছেন, গোমূত্র বা ওই ধরনের কোনও ক্যান্সারের চিকিৎসায় বিন্দুমাত্র উপযোগিতার কোনও প্রমাণ কোনও গবেষণায় পাওয়া যায়নি৷ বিশ্বে কেবলমাত্র রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি এবং বর্তমানে ইমিউনোথেরাপি স্তন ক্যান্সারের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার স্বীকৃত পদ্ধতি৷ এই ধরনের দাবি মানুষকে ভুল পথে চালিত করবে৷ ওই সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর প্রবীণ ক্যান্সার সার্জন ডাঃ পঙ্কজ চতুর্বেদীও বলেছেন, এই ধরনের দাবি ক্যান্সারের রোগীদের ভুল পথে চালিত করবে৷ ওই সেন্টারের অ্যাকাডেমিক ডিরেক্টর ডাঃ শ্রীপদ বনভলি বলেছেন, স্তন ও ব্লাড ক্যান্সার বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসায় নিরাময় করা যায়৷ তিনি প্রশ্ন করেন, কেউ যদি দাবি করেন, গোমূত্র ক্যান্সার নিরাময় করে তা হলে তিনি কি কোনও গবেষণায় তা প্রমাণ করতে পারবেন? প্রিন্স অ্যালি খান ও ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালের প্রখ্যাত ক্যান্সার সার্জন ডাঃ সুলতান প্রধান বলেছেন, ঠাকুরের দাবি আদৌ সমর্থনযোগ্য নয়৷
হিন্দুত্ববাদীরা ‘গোমূত্র পানের নানা উপযোগিতা আছে’ বলে দাবি করে৷ প্রশ্ন হল, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কি পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দ্বারা পরিচালিত হবে, নাকি পৌরাণিক ধারণার দ্বারা পরিচালিত হবে? কোনও জিনিস খাওয়ার আগে, বিশেষত যদি তা ওষুধ হয়, ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার মানুষের ক্ষেত্রে তার উপযোগিতা আছে কি না এবং তা ক্ষতিকর কি না৷ গোমূত্রের ক্ষেত্রে এর কোনও উপকারিতা প্রমাণিত হয়নি৷ বরং কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে গোমূত্র পান করায় বিষক্রিয়া, গুরুতর সংক্রমণ ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা হতে পারে৷ সহজ যুক্তিতেই বোঝা যায়, গোমূত্রের সঙ্গে মানুষের মূত্রের মূলগত কোনও পার্থক্য নেই৷ আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তার কিছুটা হজম হয় এবং ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় অংশগুলি গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল ট্র্যাক্ট–এর মাধ্যমে শরীর থেকে নির্গত হয়৷ বিপাক ক্রিয়ার সময় উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থগুলি কিডনির ছাঁকনির মাধ্যমে মূত্ররূপে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়৷ অধিকাংশ স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটে৷ তাই গোমূত্রের রাসায়নিক উপাদানগুলি মূলত একই এবং এ কথার কোনও যুক্তি নেই যে গোমূত্র পানের উপকারিতা আছে৷ পশুপালন, ডেয়ারি ও মৎস্য মন্ত্রক এবং ২০১৬ সালে ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদের মতো দেশের ১৪টি ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারী লুধিয়ানার গুরু অঙ্গদ দেব ভেটেরিনারি এবং পশু বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২টি বিভাগও গোমূত্রের কোনও উপকারিতা খুঁজে পায়নি৷ স্পষ্টতই, গোমূত্র ও পঞ্চগব্যের উপকারিতা নিয়ে সঙঘ পরিবার যে প্রচার করছে তার পিছনে রয়েছে অন্ধবিশ্বাস, তার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই৷ এটি দেশকে মধ্য যুগে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়৷
তবে সঙঘ পরিবারের ভাবনায় প্রভাবিত গুজরাটের জুনাগড় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, তাঁরা গোমূত্রের সাহায্যে ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন৷ কিন্তু তাঁরা যে সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, তার কোনও প্রমাণ নেই৷ তবুও কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ মন্ত্রক চিকিৎসার ক্ষেত্রে গোমূত্র ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে৷ পিটিআই–এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর কেন্দ্রীয় আয়ুষ মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীপদ নায়েক বলেন, নাগপুরের গো–বিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের সঙ্গে যৌথভাবে কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিআইআইআর) তার অধীনস্থ পরীক্ষাগারগুলিতে গোমূত্রের অ্যান্টিক্সিডেন্ট ধর্ম এবং অসংক্রমণ ধর্ম ও ক্যান্সার চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করছে৷ ২০১৭ সাল থেকে গো–বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণাকে মৌলিক গবেষণার থেকেও জাতীয় ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ ওই বছর ২৫ এপ্রিল দিল্লি আইআইটির সঙ্গে যৌথভাবে ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ডিএসটি), ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োটেকনোলজি (ডিবিটি) এবং সি এস আই আর সায়েন্সিটিফিক ‘ভ্যালিডেশন অ্যান্ড রিসার্চ অন পঞ্চগব্য’ (সায়েন্টিফিক ভ্যালিডেশন অ্যান্ড রিসার্চ অন পঞ্চগব্য বা এসভিএআরওপি) নামক একটি জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করে৷ পঞ্চগব্যের নানা উপকারিতা হবে গবেষণার বিষয়৷ এ জন্য ১৯ জন সদস্য নিয়ে একটি জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ এই কমিটির চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ভূবিজ্ঞান বিভাগের মন্ত্রী হর্ষবর্ধন৷ এর কো–চেয়ারম্যান বিজয় পি ভাটকর, যিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত একটি এনজিও বিজ্ঞান ভারতী, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা রূপায়ণ করতে সচেষ্ট, তার জাতীয় সভাপতি৷ অন্য সদস্যরা হলেন সিএসআইআর–এর প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল আর এ মাসেলকর, ডিএসটি, ডিবিটি, নতুন এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি মন্ত্রকের সেক্রেটারিরা, দিল্লি আইআইটির ডিরেক্টর, বিজ্ঞান ভারতীর সম্পাদক এ জয়কুমার, নাগপুরের গো–বিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের সুনীল মান সিংহ, সিএসআইআর, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ এবং সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন আয়ুর্বেদিক সায়েন্সেস–এর ডিরেক্টর জেনারেল প্রমুখ৷ গো–চিকিৎসা নিয়ে গবেষণার প্রধান চালিকা শক্তি হল দিল্লি আইআইটি, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুত্ববাদের চর্চা চলছে৷ ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সেখানে লাড্ডু বিতরণ করা হয়েছিল৷
গোমূত্র ও পঞ্চগব্যকে রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করার জন্য আয়ুষ মন্ত্রক যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেও এই সংক্রান্ত গবেষণা যথাযথভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে না৷ পরিবর্তে বলা হচ্ছে এই বিষয়ে পেটেন্ট নেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু কোনও কিছুর পেটেন্ট নেওয়ার অর্থ এই নয় যে তা মানবজাতির পক্ষে উপকারী৷ বিজ্ঞানসম্মতভাবে তা প্রমাণ করা দরকার৷ এই কাজটিকে আয়ুষ মন্ত্রক উপেক্ষা করছে৷ বোটানিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট ফর মেডিসিন্যাল অ্যান্ড অ্যারোমেটিক প্ল্যান্টস–এর সঙ্গে যৌথভাবে ডায়াবেটিসের একটি ওষুধ বিজিআর–৩৪ উদ্ভাবন করেছে৷ দাবি করা হচ্ছে, এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং বিপাক ক্রিয়া বৃদ্ধি করে৷ এই ওষুধটির বাণিজ্যিক উৎপাদক ও পরিবেশক এআইএমআইএল ফারমাসিউটিক্যাল–এর একজন কার্যনির্বাহী সঞ্চিত শর্মা বলেছেন, এটি ‘বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত’এবং ‘অ্যালোপ্যাথিক মান’ পূরণ করে৷ সিএসআইআর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর এস কে রাওয়াত বলেছেন, এআইএমআইএল এই ওষুধটির ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করেছে এবং এর সাফল্যের হার ৬৭ শতাংশ৷ কিন্তু ভারতের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রেজিস্ট্রি, যারা ভারতের সমস্ত ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রেকর্ড করে, তাদের কাছে এই ওষুধটির পরীক্ষার কোনও রেকর্ড নেই৷ অন্য দিকে কোনও প্রতিষ্ঠিত গবেষণা পত্রিকায় এইসব গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়নি৷ তা ছাড়া নয়া দিল্লির আগরওয়াল হাসপাতালে মাত্র ৪৮ জন রোগীর উপর এই ওষূধ প্রয়োগ করা হয়, যেখানে ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস আইন অনুযায়ী অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের ট্রায়াল অন্তত ৫০০ জনের উপর করতে হবে এবং তা হবে একাধিক জায়গায়৷ সুতরাং বিজিআর–৩৪ ‘বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত’ এবং ‘অ্যালোপ্যাথিক মান’ পূরণ করে– এই দাবিগুলির সত্যতা নেই৷
দুঃখের বিষয়, তাদের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা রূপায়ণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার মৌলিক গবেষণার অর্থ বরাদ্দ ২০০০ কোটি টাকা হ্রাস করেছে৷ ফলে সিএসআইআর–এর অধীনে দেশে যে ৩৮টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলি তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন৷ ২০১৫ সালে বিজ্ঞান মন্ত্রী হর্ষবর্ধনের নেতৃত্বে সিএসআইআর সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাদের বাজেটের ৫০ শতাংশ বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হবে৷ আশার কথা দেশের প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু বিজ্ঞানী এর প্রতিবাদ করেছেন৷