‘গুজরাট আমিই বানিয়েছি’ বলে প্রচার করছেন প্রধানমন্ত্রী৷ কেমন গুজরাট বানিয়েছেন তিনি? ‘২০০২–এ ‘ওদের’ উচিত শিক্ষা দিয়েছি পাকাপাকি শান্তি ফিরে এসেছে রাজ্যে’–অমিত শাহ কথিত এই গুজরাটের কথাই কি বলতে চেয়েছেন মোদিজি?
‘ওদের’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে, সকলেই বুঝতে পারছেন৷ শুধু দেশের মানুষ বুঝতে পারছে না, যে গুজরাট গণহত্যা তাদের নেতৃত্বে সংঘটিত হওয়ার কথা বিজেপি নেতারা সুপ্রিম কোর্টে পর্যন্ত অস্বীকার করেছিলেন, তাদের রাজ্য সরকারের ভূমিকায় কয়েক হাজার মানুষ ধনে–প্রাণে মারা গেলেও অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের কোনও শাস্তি হল না, বিজেপি নেতাদের এই ভূমিকার জন্যই সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরবের মৌলবাদী খুনি যে যুবরাজ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর তুলনা শুনতে হল দেশবাসীকে, এইরকম একটা বিষয়কে তাদের শীর্ষনেতা হঠাৎ স্বীকার করে বসলেন কেন?
অমিত শাহ তো এই বলে ভোট চাইতে পারতেন, মোদির ‘বানানো’ গুজরাট শিক্ষায় এগিয়ে গিয়েছে, বলতে পারতেন সাধারণ মানুষের চিকিৎসা পরিষেবা উন্নত হয়েছে গুজরাটে, বেকার যুবকদের চাকরির অনেকখানিই সুরাহা হয়েছে, নতুন শিল্প–কারখানা গড়ে উঠছে, চাষিদের আর ঋণগ্রস্ত হতে হচ্ছে না, তারা ন্যায্য মূল্যে সার–বীজ কেনার সুযোগ পেয়ে চাষ করছে, মহিলারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন না৷
মোদিজির ‘বানানো স্বর্গরাজ্যে’ এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল৷ তা তো বললেন না তিনি৷ আসলে বলতে পারলেন না৷ কারণ, বাইরে তাঁরা যতই ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’, ‘গুজরাট মডেল’ এ সবের প্রচার তুলুন, গুজরাটের মাটিতে এই প্রচারের কানাকড়িও মূল্য নেই৷ তারা সাধারণ মানুষ–ছাত্র–যুব–কৃষক কারও স্বার্থে একটি পদক্ষেপও নেয়নি, দেখেছে পরম বন্ধু একচেটিয়া শিল্পপতি আম্বানি–আদানিদের স্বার্থ৷ তাই ধর্মের পালে বাতাস দিয়ে এর থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে চাইছেন বিজেপি নেতারা৷ শেষ পর্যন্ত তুরুপের তাস ধর্মীয় মেরুকরণকে আঁকড়ে ধরতে হল বিজেপি নেতাদের৷
গুজরাট ভোটে হিন্দু–মুসলিম, সংখ্যালঘু–সংখ্যাগুরুর মধ্যে বিভেদের ভয়ঙ্কর তাস খেলে বাজিমাত করার চেষ্টা করছেন তারা৷ একমাত্র এ ক্ষেত্রেই তারা নিত্যনতুন কায়দায় ‘উন্নয়ন’ ঘটিয়ে চলেছেন– কখনও গো–রক্ষার অজুহাতে, কখনও লাভ জেহাদের নামে, কখনও মন্দির–মসজিদ নিয়ে সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে৷ একত্রে বাস করা নানা ধর্ম–বর্ণের মানুষের পরস্পরের মধ্যে আবেগের দীর্ঘদিনের স্থায়ী সম্পর্ককে ধ্বংস করে তার উপর গড়ে তুলেছেন হিংসা–বিদ্বেষের ভয়াল প্রাচীর৷ যা দেখিয়ে নির্বাচন এলেই দুটি সম্প্রদায়ের মানুষকে একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা যায়, ভোটে ফয়দা লোটা যায়৷ তাই বারবার অস্বীকার করে যাওয়া গুজরাট গণহত্যার স্মৃতিকে আবারও উস্কে দিতে হল অমিত শাহকে৷
কেন্দ্রে আট বছর এবং গুজরাটে টানা ২২ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও অমিত শাহজি হাজার হাজার বেকার যুবককে চাকরির দিশা দেখিয়ে বলতে পারলেন না ওই দেখো এসে গেছে মোদিজির ‘আচ্ছে দিন’ ।অর্থনীতির ‘উন্নয়ন’ অবশ্যম্ভাবী বলে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন হাজার আশ্বাসবাণী দিলেও তাতে খিদে মিটছে না গরিব–মধ্যবিত্তের৷ ছাঁটাই হওয়া কোনও শ্রমিকের জীবনে এতটুকু আশার আলো কেউ দেখাতে পারছে না৷ সরকারের ভর্তুকির গল্প শুনে ঋণগ্রস্ত কৃষকদের পেট ভরছে না, মানুষকে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে দেশি–বিদেশি ধনকুবেরদের হাতে চিকিৎসাকে তুলে দেওয়ায় বহুমূল্য এই পরিষেবা কিনতে না পেরে মায়েরা সন্তানহারা হচ্ছেন, প্রিয়জনকে হারাতে বাধ্য হচ্ছে প্রায় প্রতিটি পরিবার৷ মহিলাদের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই৷ জিএসটি চাপানোর পর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্কট বেড়েছে৷ এ সব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে নতুন প্রজন্ম, প্রশ্ন তুলছেন সচেতন ভোটাররা৷ তারা গণহত্যার সময় অত্যাচারিতা বিলকিস বানোর অপরাধীদের জামিনের তীব্র বিরোধিতা করে তাদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি তুলছেন৷ তারা প্রশ্ন তুলছেন, ভুয়ো সংঘর্ষে খুনের মামলা, খোদ বিজেপি নেতা হরেন পাণ্ড্য হত্যা মামলার সঠিক মীমাংসা হল না কেন?
তার উত্তর নেই নেতা–মন্ত্রীদের কাছে৷ তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২০০২–এর গণহত্যার কথা তুলে সংখ্যালঘুদের কার্যত হুমকি দিয়েছেন এবং সংখ্যাগুরুদের মধ্যে নতুন সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে ভোট কুড়োতে চাইছেন৷ এভাবে দু’পক্ষেরই ভোট নিশ্চিত করার পুরনো নোংরা খেলাই আবারও খেলতে চাইছে বিজেপি৷ আর কোন শান্তির কথা বলছেন তারা? গণহত্যার পর যে শ্মশানের শান্তি নামে তার কথাই কি বলতে চাইছেন? তা তো বিজেপি শাসনে ইতিমধ্যেই সারা দেশে জারি হয়েছে৷